চট্টগ্রামে বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডাকা ধর্মঘট রোগী ও স্বজনদের প্রায় ২৪ ঘণ্টা জিম্মি করে, চরম ভোগান্তি শেষে ধর্মঘট স্থগিত করেছে বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান সমিতি।
সোমবার দুপুরের দিকে এ ধর্মঘট স্থগিত করা হয়। বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ম্যাক্স হাসপাতালের পরিচালক ডা. লিয়াকত আলী এ ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘প্রশাসন ও বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দের পরামর্শে ধর্মঘট বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এখন থেকে সব হাসপাতাল খোলা থাকবে। রোগীদের অসুবিধার জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি।’
সোমবার সকালে একাধিক হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, নগরের প্রায় সব হাসপাতাল-ল্যাবে অভিন্ন ব্যানার টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব সেবা কেন্দ্রের প্রবেশ পথও বন্ধ ছিল। তবে দুপুরের পর হাসপাতালের সেবা শুরু হয়। চট্টগ্রাম নগর ও জেলায় ৫০৬টি বেসরকারি হাসপাতাল ও রোগ নিরূপনী কেন্দ্র আছে।
তবে বেসরকারি হাসপাতাল বন্ধকালীন সময়ে প্রধান সেবাকেন্দ্র চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল এবং চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে রোগীদের চাপ কয়েকগুণ বেড়েছে। এ দুই হাসপাতালে ছিল রোগীদের উপচে পড়া ভিড়।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত রবিবার বিকেল ৫টা থেকে সোমবার দুপুর ১টা পর্যন্ত চমেক হাসপাতালের ৪০টি ওয়ার্ডের এক হাজার ৩১৩ শয্যায় প্রায় চার হাজার ৫০০ রোগী ওয়ার্ডে ভর্তি হন। সাধারণ সময়ে এই সংখ্যা থাকে দুই হাজার ২০০ থেকে ৪০০। জরুরি বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৬০০ রোগী চিকিৎসাসেবা নিলেও গত রবিবার বিকেল থেকে দুপুর পর্যন্ত এক ১০০ রোগী সেবা নিয়েছেন। এর মধ্যে আজই এসেছেন প্রায় ৫০০ রোগী।
চমেক হাসপাতালের ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ডা. বহ্নি চক্রবর্তী বলেন, ‘আউটডোর-ইনডোর মিলে প্রায় চার হাজার ৫০০ রোগী দুপুর পর্যন্ত সেবা নিয়েছেন। সাধারণ সময়ে নেয় দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার।’
আজ সকালে চমেক হাসপাতালের শিশুস্বাস্থ্য বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, ৭০ শয্যার ওয়ার্ডে ভর্তি ছিল দ্বিগুণ। শয্যা সংকুলান না হওয়ায় ফ্লোরে বেড দিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ বিভাগে আজ সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১০০ শিশু ভর্তি হয়েছে। শ্বাসকষ্ট নিয়ে দেড় বছরের শিশু সন্তানকে পটিয়া থেকে আনা মা ফাতেমাতুজ জাহান বলেন, ‘শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় কন্যা সন্তানকে নিয়ে বেসরকারি একটি হাসপাতালে ভর্তি করতে যাই। কিন্তু গিয়ে দেখি ওই হাসপাতাল বন্ধ। তাই এখন চমেক হাসপাতালে নিয়ে আসি। এখানে শয্যা না পাওয়ায় ফ্লোরে রাখা হয়।’
সাতকানিয়া উপজেলা থেকে আসা রোগী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক কষ্ট করেই একজন চিকিৎসকের সিরিয়াল নাম্বার নিয়েছি। কিন্তু এখন দেখি চেম্বার বন্ধ। আবার কিভাবে যে নাম্বার নেব সে চিন্তায় আছি।’
চমেক হাসপাতালের উপ পরিচালক ডা. আখাতারুল ইসলাম বলেন, রোগী বাড়লেও সকলের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কোনো রোগীকে সেবা থেকে বঞ্চিত করা হয়নি। আমরা বলব, সবাই যেন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে আসেন।’
অন্যদিকে, চট্টগ্রামের অন্যতম সরকারি সেবাকেন্দ্র জেনারেল হাসপাতালেও বেড়েছে রোগীর চাপ। গত রবিবার বহির্বিভাগ থেকে মোট সেবা নেয় ৭১৯ জন, সোমবার দুপুর পর্যন্ত সেবা নেয় এক হাজার ২৭ জন। একই ভাবে জরুরি বিভাগেও গত রবিবারের চেয়ে আজ দ্বিগুণ রোগী সেবা গ্রহণ করেন।
প্রসঙ্গত, গত রবিবার দুপুরে ত্রুটিপূর্ণ লাইসেন্সে অদক্ষ-অনভিজ্ঞ ডাক্তার-নার্স দ্বারা পরিচালিত ম্যাক্স হাসপাতালকে ১০ লাখ এবং সিএসসিআর হাসপাতালকে চার লাখ টাকা জরিমানা করেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম। এর প্রতিবাদে বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান সমিতি হঠাৎ করেই চট্টগ্রামে বেসরকারি হাসপাতালে সেবা বন্ধের ঘোষণা করে। এরপর থেকে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা রোগীরা চরম বিপাকে পড়েন। রোগীদের জিম্মি করে হাসপাতাল মালিকদের এই ধর্মঘট নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন ভুক্তভোগীরা।
তাছাড়া গত ২৮ জুন দৈনিক সমকালের চট্টগ্রাম ব্যুরোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রুবেল খানের মেয়ে রাইফা খানকে গলায় ব্যথা নিয়ে ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ২৯ জুন রাতে মৃত্যু হয়। এর পর রুবেল খান ভুল চিকিৎসায় মেয়ের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। পরে ঘটনা তদন্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং সিভিল সার্জন থেকে পৃথক দুটি কমিটি করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্তে ম্যাক্স হাসপাতালের ১১টি অনিয়ম-ত্রুটি শনাক্ত করে। তাছাড়া সিভিল সার্জনের নেতৃত্বাধীন কমিটিও কর্তব্যরত চিকিৎসক, নার্স ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা এবং গাফিলতির প্রমাণ পাওয়ার কথা বলে তিন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দুই চিকিৎসককে চাকরিচ্যুত করে।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন