মঙ্গলবার, ২৩ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

স্বাস্থ্যসেবায় সংকট চট্টগ্রামে

মুমূর্ষু হলেই দৌড়াতে হয় ঢাকা

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম  

স্বাস্থ্যসেবায় সংকট চট্টগ্রামে

চট্টগ্রাম নগরের খাজা রোডের অটোরিকশাচালক কামাল উদ্দিন। তিন মাস আগে দুর্ঘটনায় তার এক পায়ে মারাত্মক আঘাত পান। ভর্তি করা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। প্রায় এক মাস চিকিৎসা চলে সেখানে। এরপর চিকিৎসক পরামর্শ দেন ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যেতে। কিন্তু সে সামর্থ্য ও সক্ষমতা কোনোটিই রোগীর নেই। এরই মধ্যে ভালো পায়েও ইনফেকশন হয়।  এক মাস পর কেটে ফেলতে হয় তার পা। জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্তদের ৯০ শতাংশেরই প্রয়োজন হয় ব্র্যাকিথেরাপি। মেশিনটি চট্টগ্রামে কেবল চমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগে আছে। কিন্তু গত বছরের ৬ জুন থেকে এ মেশিনটি নষ্ট। ফলে এখন ব্র্যাকিথেরাপি দরকার হলে রোগীদের দৌড়াতে হচ্ছে ঢাকায়। কেবল আঘাতপ্রাপ্ত কিংবা ক্যান্সার রোগী নয়, অগ্নিদগ্ধ, জটিল শিশুস্বাস্থ্য, কিডনি, গাইনি, প্রশ্রাবের সমস্যা, নিউরো সার্জারিসহ বিভিন্ন রোগে সংকটাপন্ন হলেই নিয়ে যেতে হয় ঢাকায়। পথেই মারা যান অনেক রোগী। 

পা হারানো কামাল উদ্দিন বলেন, ঢাকায় যেতে পারলে আমার পা হারাতে হতো না। আঘাতপ্রাপ্ত পাটি এখানে ভুল চিকিৎসায় কেটে ফেলতে হয়। ভালো পায়েও ইনফেকশন হয়। ঢাকায় গিয়ে চিকিৎসার সামর্থ্য না থাকায় এ ভাগ্যবরণ করতে হয়েছে। নাম প্রকাশ না করে জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত এক নারী বলেন, চিকিৎসক প্রায় দুই মাস আগে তাকে বলেছেন ব্র্যাকিথেরাপি নিতে। কিন্তু চমেক হাসপাতালের মেশিন নষ্ট হওয়ায় তা পারছেন না। ঢাকা গিয়ে ব্র্যাকিথেরাপি নেওয়ার সামর্থ্যও নেই। এখন ওষুধ খেয়েই দিন পার করছি। স্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা আন্দোলন চট্টগ্রামের সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়া বলেন, চট্টগ্রামে অপ্রতুল স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও চট্টগ্রামে স্বাস্থ্যসেবার এমন হাল আমাদের অবাক করে। সংকট নিরসনে জেনারেল হাসপাতালকে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করা, চমেক হাসপাতালের হৃদরোগ, ক্যান্সার, শিশু সার্জারি, নিউরো সার্জারি ও অর্থোপেডিকসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোয় শয্যা ও জনবল সমৃদ্ধ করা এবং প্রতিদিন অপারেশন চালু রাখা খুবই দরকার। একই সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে স্পর্শকাতর রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থাও জরুরি। তা হলে অন্তত গরিব ও অসহায় রোগীদের বিপাকে পড়তে হবে না। এখন সামর্থ্যবানরা ঢাকায় যেতে পারলেও দুর্ভোগ পড়তে হয় গরিবদের।  চমেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. রফিক উদ্দিন আহমেদ বলেন, ফুসফুসে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হলেই তাকে ঢাকায় প্রেরণ করতে হয়। কিন্তু ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ দগ্ধ হওয়া রোগীও এখানে সুস্থ হচ্ছে। সবকিছু নির্ভর করে রোগী দগ্ধ হওয়ার ওপর। কিন্তু এখানে শয্যা ও জনবল সংকটের কারণে অনেকেই অন্যত্র চলে যায়।  চমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আলী আসগর চৌধুরী বলেন, ক্যান্সার চিকিৎসায় কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি ও সার্জারি করা হচ্ছে। দৈনিক ১০০ জনেরও বেশি রোগীকে রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়। রাত ১১টা পর্যন্ত চলে চিকিৎসা। তবে এখনো পেট সিটি স্ক্যানসহ ক্যান্সারের কিছু জরুরি চিকিৎসা চট্টগ্রামে হয় না। নতুন ভবন নির্মাণ হলে সেখানে ক্যান্সারের সমন্বিত চিকিৎসা চলবে। নিউরো সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. মাজেদ সুলতান বলেন, এ বিভাগে অনেক ক্রিটিক্যাল রোগীর অপারেশন হয়। তবে নানা কারণে ব্রেইনের কিছু অপারেশন করা সম্ভব হয় না। এ সংকট নিরসনে চেষ্টা চলছে।    

চমেক হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, অর্থোপেডিকস বিভাগে ৮৮টি শয্যা থাকলেও নিয়মিতই ভর্তি থাকে ২ শতাধিক রোগী। তাছাড়া, একটি অপারেশনের জন্য সিডিউল নিয়ে দুই মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এ ওয়ার্ডে দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার মতো গুরুতর রোগীর চিকিৎসা করা হয়। অথচ এখানে নেই পা বা হাড় জোড়া লাগানোর মতো সক্ষমতা। নেই যন্ত্রপাতি এবং অভিজ্ঞ চিকিৎসক। সংকটাপন্ন পায়ের চিকিৎসা মানেই কেটে ফেলা।  

চমেক হাসপাতালে ২০১২ সালে ২৬টি শয্যা নিয়ে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু এখানে নেই কোনো আইসিইউ ও অপারেশন থিয়েটার। ৩০ শতাংশের বেশি দগ্ধ হলেই সংকটাপন্ন রোগীকে ঢাকায় নিয়ে যেতে হয়। পথেই মারা যান অনেক রোগী।  অথচ চট্টগ্রামে আছে অন্তত ৬০টি শিপ ইয়ার্ড। শিল্পটির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ৫০ হাজার মানুষ। এখানে আছে প্রায় ৫০০ গার্মেন্টস। এসব তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন অন্তত ৮ লাখ কর্মী। এখানে আছে দেশের বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর। এসব ক্ষেত্রে প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনা ঘটে।

হাসপাতালের ক্যান্সার ওয়ার্ডে শয্যা আছে ৪৫টি। প্রতিনিয়তই শয্যার বাইরে রোগী ভর্তি থাকে। হাসপাতালে নেই পেট সিটি স্ক্যান, আইসোটপ (তেজস্ক্রিয়া শনাক্তকরণ মেশিন)। আইসোটপ নির্ণয় করা হয় কেবল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ৭ কোটি টাকা মূল্যের একমাত্র ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনটি এক বছর ধরে একটি পার্টসের অভাবে অচল পড়ে আছে। ওয়ার্ডে সংকট স্বাস্থ্য সহকারীর, ওয়ার্ড চলে আউটসোর্সিং দিয়ে। আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ পেয়ে তারা রোগীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সংকটাপন্ন রোগীদের নিয়ে যেতে ঢাকা বা সিরাজগঞ্জে ক্যান্সার হাসপাতালে।

সংকট আছে নিউরো সার্জারি বিভাগেও। ব্রেইনের মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনের জন্য দৌড়াতে হয় ঢাকায়। এর মধ্যে আছে, ব্রেইনের এনিউরিসম সার্জারি, পিটুইটারি টিউমার সার্জারি, এটলান্টো-এক্সিয়াল ডিসলোকেশন সার্জারি ও স্কাল বেইস নিউরো সার্জারি।

হৃদরোগ বিভাগেও আছে নানা সংকট। অচল ইটিটি মেশিন, দুর্ভোগ পোহাতে হয় ইকোকার্ডিওগ্রাফি করাতে। মেলে না এনজিওগ্রামের শিডিউল। ১০০ শয্যার হৃদরোগ বিভাগে দৈনিক ভর্তি থাকে অন্তত ২০০ রোগী। দৈনিক ২০০ এনজিওগ্রাম করার চাহিদা থাকলেও করা হয় মাত্র চার থেকে পাঁচটি। অন্যদের সিডিউল নিয়ে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়।

শিশুস্বাস্থ্য ও শিশু সার্জারি বিভাগেও আছে সংকট। শিশু সার্জারি বিভাগে ৬৪টি শয্যা থাকলেও নিয়মিত ভর্তি থাকে ১২০ থেকে ১৩০ জন। ওয়ার্ডে মুমূর্ষু ও গুরুতর শিশু রোগীকে নিয়ে যেতে হয় ঢাকায়। জটিল সার্জারি করার অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরও রয়েছে সংকট।   

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর