শনিবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

শুঁটকিপল্লীতে হতাশা

মোশাররফ হোসেন বেলাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

শুঁটকিপল্লীতে হতাশা

অবৈধভাবে মৎস্য আহরণের প্রভাবে ক্রমেই কমছে দেশীয় প্রজাতির মাছের সংখ্যা। এক সময় নদ-নদীতে প্রচুর পরিমাণ দেশীয় মাছ থাকলেও এখন তা অনেকটাই কমে গেছে। এমনিতে করোনার কারণে গত দুই বছর মৎস্য আহরণ ও শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণে জড়িতরা ভালো নেই। তার ওপর দেশীয় প্রজাতি মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ায় এই পেশার সঙ্গে জড়িতদের জীবন ও জীবিকার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বছরের এ সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুরের মেঘনা নদীর পূর্ব পাড়ে জেলেপল্লীতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের ভরপুর থাকত। যা দিয়ে এখানকার শুঁটকিপল্লীতে চলত নানা প্রকার শুঁটকি উৎপাদনের কাজ। তবে বর্তমান মৌসুমে দুই মাস পার হয়ে গেলেও নদী নালা ও খাল বিলে পর্যাপ্ত মাছ না পাওয়ায় এখনো জমে উঠেনি শুঁটকিপল্লী। মাছ সংকটের কারণে এক সময়ের জমজমাট এই পল্লী এখন অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। নেই পাইকারদের আনাগোনা। প্রায় দুই হাজারের বেশি শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। একসময় ঐতিহ্যবাহী এই শুঁটকিপল্লীতে দেড় শতাধিক ডাঙ্গি (মাচা) ছিল। বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫০/৬০টিতে। সরেজমিন দেখা যায়, জেলেপল্লীতে শ্রমিক ও মালিকরা অনেকটাই অবসর সময় পার করছেন। বেশির ভাগ ডাঙ্গিই শুঁটকি শূন্য। কেউ কেউ সীমিত পরিমাণ মাছ রৌদ্রে শুকাচ্ছেন। তাদের চোখে মুুখে হতাশার ছাপ। শুঁটকি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতরা জানান, প্রতিটি মাচায় আগে প্রতিদিন ১০/১২ লাখ টাকার মাছ কেনাবেচা হতো। এখন তা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫০/৬০ হাজার টাকায়। এমনিতে করোনার কারণে বিপাকে থাকা ব্যবসায়ীরা ভালো নেই। তার ওপর মাছ সংকটের কারণে এই শিল্প হুমকির সম্মুখীন। শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণে জড়িত সুমন দাস বলেন, এবার ভরা মৌসুমে অধিকাংশ ডাঙ্গি (মাচা) খালি। নদ-নদীতে মাছ কম থাকায় জেলেরা মাছ ধরতে পারছে না। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার শুঁটকির পরিমাণ একেবারে কম। শুঁটকি ব্যবসায়ী রাহুল দাস বলেন, গত বছর প্রতিদিন ৪/৫ লাখ টাকার মাছ কিনতাম। এবার প্রতিদিন ৪০ হাজার টাকার মাছ কিনতে হচ্ছে। শৈল, গজার, টাকি, গনিয়া, চান্দা বালিয়ারা পাওয়া গেলেও এবার শুধু পুঁটি আর টেংরা মাছ কিনছি প্রতিদিন। শুঁটকিপল্লীর শ্রমিক সুবীর দাস ও ডলি রানী দাস বলেন, এবার পর্যাপ্ত পরিমাণ মাছ না পাওয়ায় আমাদের অনেক শ্রমিকই বেকার হয়ে পড়েছে। মালিকই যদি ঋণগ্রস্ত হয় তাহলে আমরা কীভাবে বাঁচব। এদিকে মৎস্য সংকট দূর করতে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা তাজমহল বেগম বলেন, মৎস্য সম্পদ রক্ষায় আমাদেরকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে অবৈধ মৎস্য আহরণ ও মা মাছ শিকার থেকে জেলেদের বিরত থাকতে হবে। কারণ মা মাছের ডিম থেকে প্রচুর পরিমাণ মাছ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। তাই মা মাছকে ডিম পাড়ার সুযোগ দিতে হবে। তাই মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে জেলেদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি যারা অবৈধভাবে মৎস্য শিকার করছে তাদেরকে আইনের আত্ততায় আনা হচ্ছে। চলতি মৌসুমে অবৈধ মৎস্য শিকারিদের বিরুদ্ধে ১৫৯টি অভিযান ও ২২টি মোবাইল কোর্ট এবং ৫৭ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া শুঁটকিপল্লীতে কর্মরতদের জীবন মান উন্নয়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ঐতিহ্যবাহী এই শুঁটকিপল্লীতে ভাদ্র মাস থেকে শুরু হয় ডাঙ্গি (মাচা) তৈরির কাজ। এরপর আশ্বিন থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত বছরের পাঁচ মাস চলে এখানে শুঁটকি উৎপাদনের কাজ। এখানকার শুঁটকির গুণগতমান ভালো হওয়ায় দেশ-বিদেশে এর বেশ কদর রয়েছে। শুঁটকি ব্যবসায়ী কামাল মিয়া জানান, পুঁজির অভাবে আমরা এখন আর আগের মতো ব্যবসা করতে পারছি না। আগে মাছের দাম কম ছিল। দিন দিন মাছের দাম যেমনি বাড়ছে তেমনি শ্রমিকের মজুরিও বাড়ছে।

তাই অনেকেই এই ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। লালপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও আশুগঞ্জ উপজেলা সমবায় সমিতির সভাপতি মো. মোরশেদ মাস্টার জানান, পুঁজির অভাবে প্রান্তিক শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকারীরা ব্যবসায় সুবিধা করতে পারছেন না। সরকার শুঁটকি উৎপাদনকারীদের সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ দিয়ে সহযোগিতা করলে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তনের পাশাপাশি শুঁটকি উৎপাদন দ্বিগুণ হবে। এদিকে লালপুরের শুঁটকি ব্যবসায়ীরা দাবি করেন কম সুদ ও জামানতবিহীন ব্যাংক ঋণ প্রদান করা হলে প্রান্তিক শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকারীদের ভাগ্যের পরিবর্তন আসবে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। তাই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এখানকার শুঁটকি ব্যবসায়ীরা।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর