সোমবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

ফেনীতে চলছে মাটি কাটার ধুম যাচ্ছে অবৈধ ইটভাটায়

জমির বেগ, ফেনী

ফেনীতে চলছে মাটি কাটার ধুম যাচ্ছে অবৈধ ইটভাটায়

ফেনীর এমন কোনো ইউনিয়ন নেই যেখানে কৃষি জমির মাটি কাটা হচ্ছে না। প্রশাসন, পুলিশ, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইটভাটাগুলোর জন্য প্রকাশ্যে জেলার প্রায় প্রতিটি এলাকা থেকে ফসলি জমির ওপরের অংশের মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে কিছু অসাধু মাটি ব্যবসায়ী। জেলার ফুলগাজী ও পরশুরামে রাতের আঁধারে অন্যের জমির মাটি বলা-কওয়া ছাড়া কেটে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে একাধিক। এ নিয়ে সালিশের ঘটনাও ঘটেছে। পরশুরামের বাসিন্দা মিন্টু জানান, যেভাবে মাটি কেটে ইটভাটাগুলোতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কৃষিকাজের জন্য অদূর ভবিষ্যতে পার্শ¦বর্তী দেশ ভারত থেকে  হয়তো মাটি আমদানি করতে হবে।  মাটি ব্যবসায়ীরা কোথায়ও কোথায় এক একটি জমি থেকে ১৫-২০ ফুট গভীর পর্যন্ত মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এভাবে মাটি কাটায় অনেক ফসলের জমি পুকুরে পরিণত হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী জমির আইল ভেঙে পড়ছে। বাধ্য হয়ে পাশের জমির মালিক ও মাটি বিক্রি করে দিচ্ছে। ঠেকায় বিক্রি করায় দাম পাচ্ছে কম। আর যেখানে কৃষি জমির ওপরের অংশের মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। কয়েক বছর সেখানে হচ্ছে না চাষাবাদ। এতে হতাশ হয়ে পড়ছেন কৃষকরা। তাদের অভিযোগ, এ বিষয়ে অভিযোগের পরও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ফেনী জেলায় ছোট-বড় মিলে রয়েছে ১০৮টি ইটভাটা। এর মধ্যে মাত্র ছয়টির পরিবেশ ছাড়পত্র থাকলেও বাকি ১০২টির কোনো বৈধ কাগজপত্রই নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এসব ইটভাটার প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয় মাটি। কিন্তু সেই মাটির জোগান দিতে গিয়ে কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে প্রতিনিয়ত কৃষি জমির উপরিভাগের উর্বর মাটি কেটে নিয়ে তৈরি হচ্ছে ইট। সরেজমিন দেখা যায়, দাগনভূঞা উপজেলার এয়াকুব ইউনিয়নের দেবরামপুর গ্রামের একটি কৃষিযোগ্য জমির মাটি প্রায় ২০ ফুট গভীর করে মাটি কেটে নেওয়া হয়েছে ইটভাটায়। ফলে পাশের জমির মাটি এ জমির গর্তে ভেঙে পড়ছে। বাধ্য হয়ে পাশের জমির মালিকও বিক্রি করে দিয়েছেন তার ফসলি জমির মাটি। পাশের এলাকা বাদামতলী, পূর্বচন্দ্রপুর ইউনিয়নের একই অবস্থা। ফেনী সদর উপজেলা, পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া, সোনাগাজী উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নের সর্বত্রই এমন চিত্র। বড় বড় পিকআপ ও ট্রাক্টর দিয়ে মাটি বহনের কারণে শুধু ফসলি জমির ক্ষতিই নয়, গ্রামীণ সড়কগুলোও হয়েছে বেহাল। স্থানীয় প্রভাবশালী ও জনপ্রতিনিধিরা এসব ব্যবসার সুবিধাভোগী হওয়ায় তারা দেখেও না দেখার ভাব করছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, তারা পুলিশ বা প্রশাসনকে মাটি কাটার বিষয় সুস্পষ্ট অভিযোগ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই মাটি ব্যবসায়ী ও দালালরা তা জেনে যায়। দাগনভূঞার এক যুবক জানান, যতটুকু জানি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পুলিশকে অভিযানের বিষয় অবহিত করে ফোর্স চাইলে এক শ্রেণির অসাধু পুলিশ সদস্যও মাটি ব্যবসায়ীদের তা সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেয়। পরে মাটি ব্যবসায়ী ও দালালরা তাদের ফোন নম্বরে ফোন করে বা সরাসরি গিয়ে হুমকি-ধমকি দেয়। আরেক যুবক জানান, তিনি পুলিশকে খবর দেওয়ার কিছুক্ষণ পর মাটি ব্যবসায়ী তাকে ফোন দিয়ে হুমকি দেয়। সুতরাং যা বোঝার তাই বুঝে গেলাম।  স্থানীরা জানান,  তারা সাধারণ মানুষ হওয়ায় প্রভাবশালী এসব সিন্ডিকেট তাদের বাধা বা প্রতিবাদ আমলেই আনে না। গত বৃহস্পতিবার রাতে পরশুরামে রাতের আঁধারে                অবৈধভাবে ফসলি জমির মাটি কাটার অপরাধে পুলিশ পাঁচটি পিকআপ ও দুটি পাওয়ার ট্রলি জব্দ করে। পরশুরাম থানা পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) পার্থ প্রতিম দেব বলেন, অবৈধভাবে রাতের আঁধারে ফসলি জমির মাটি কাটার অপরাধে মাটিভর্তি দুটি গাড়িসহ সাতটি গাড়ি জব্দ করা হয়েছে।

দাগনভূঞা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদা আক্তার তানিয়া বলেন, মাটি কাটার এ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে উপজেলা প্রশাসন থেকে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তাঁর কার্যালয়ের আশপাশেই মাটি ব্যবসায়ীদের সোর্স রয়েছে। তারা সম্ভবত নিয়মিত তাঁকে নজরদারিতে রেখেছেন। তিনি উপজেলার কোথায়ও মাটি কাটার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগেই মাটি ব্যবসায়ীরা খবর পেয়ে যান ও ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। ফেনী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. একরাম উদ্দিন বলেন, এমনভাবে মাটি কাটা চলতে থাকলে জেলার খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হবে। জেলা প্রশাসন আবু সেলিম মাহমুদ-উল হাসান  বলেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। অবৈধভাবে মাটি কাটায় গত ছয় মাসে ফেনীতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ২১টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এ সময় ১৮টি মামলা হয়েছে। ৯ লাখ টাকা জরিমানা আদায়সহ ১৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ খবর