সময় যতই যাচ্ছে ততই পাল্টে যাচ্ছে জীবন চিত্র। দিন দিন যোগ হচ্ছে নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা। বর্তমান এই যুগে গ্রামের সেই ঐতিহ্য ঘানির ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ বিলুপ্তের পথে। অধিকাংশ গ্রাম থেকেই হারিয়ে গেছে ঘানির শব্দ। সেসব জায়গা দখল করেছে যান্ত্রিক যান। একসময় সরিষা থেকে তেল তৈরির একমাত্র ভরসা ছিল গরুর ঘানি। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় ও নিত্যনতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কার হওয়ায় মানুষ এসব সহজতর যন্ত্রপাতিই বেছে নিয়েছে। আর এসব যন্ত্রপাতির ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে নামকরা পুরনো শিল্প গরুর ঘানি। গরুর ঘানি বাদ দিয়ে বিদ্যুৎচালিত আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে অল্প খরচ ও সময়ের মধ্যেই অধিক তেল উৎপাদন করা হচ্ছে। যার কারণে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ঘানি শিল্প। এ শিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে। যার কারণে এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন অনেকে। আবার পূর্বপুরুষদের পেশা হিসেবে ধরে রেখেছেন কয়েকজন। হাতীবান্ধা উপজেলার ফকিরপাড়া ইউনিয়নের পশ্চিম ফকির পাড়া গ্রামের তেলি শফিকুল ইসলামের বাড়িতে বাপ দাদার আমল থেকে গরু দিয়ে ঘানি টেনে সরিষার থেকে তেল বের করে বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছে। পরিবারের স্ত্রী-সন্তান, মা মিলে সাতজন। জায়গা জমি বলতে ২ বিঘা জমি। অভাবের সংসার। সংসার চলত ঘানির তেল বিক্রি করে। কিন্তু যান্ত্রিক যুগে ঘানি শিল্প অচল হয়ে যাওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। বাধ্য হয়ে অনেকে ছাড়ছে বাপ দাদার পেশা। অনেকে আবার মূলধনের অভাবে হাতে গোনা কয়েকজন অন্য পেশায় যেতে না পেরে আঁকড়ে ধরে আছে এ পেশা। ওই গ্রামে একটি পরিবার এখনো ঘানি টানছে গরু দিয়ে। ঘানি ভাঙা তেলের চাহিদা ব্যাপক। এই খাঁটি সরিষার তেল যাচ্ছে দেশ এবং দেশের বাইরে। জেলা শহরের বড়খাতা ও বাউরা বাজারে সপ্তাহে দুই দিন ঘানি টানা সরিষার তেল বিক্রি হচ্ছে আজও। ঘানির খাঁটি সরিষার তেল প্রচুর চাহিদা থাকলেও বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ঘানির তেল বিক্রি করে আগের মতো আর লাভ হচ্ছে না। বাবা, দাদা ও নানার পেশা ধরে রাখতে শফিকুল ইসলাম ঘানি শিল্প ধরে রেখেছেন। গ্রামগঞ্জে খাঁটি সরিষার সংগ্রহ করে। গরুর সাহায্যে ঘানির তেল বের করছেন। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার পশ্চিম ফকিরপাড়া গ্রামে টিনশেড একটি ঘরে একটি গরু দিয়ে ঘানি ঘুরছে, সরিষা ভাঙছে আর ফোঁটা ফোঁটা তেল পড়ে জমা হচ্ছে পাত্রে। পাত্র ভরে গেলে তা নিয়ে মাটির কলসিতে রাখছেন তারা। এরপর বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেন। চোখের সামনে তৈরি হচ্ছে খাঁটি তেল। ১৫ কেজি সরিষায় ৫ লিটার তেল বের হয়। সরিষা থেকে তেল বের হয়ে গেলে তৈরি হয় গরুর খাদ্য খৈল। ঘানির মালিক তেলি শফিকুল ইসলাম বলেন, বাপ দাদার আমল থেকে ঘানির তেল বের করে সংসার চালাচ্ছি। অত্র এলাকার তিন ইউনিয়নের মধ্যে আমার ঘানি টিকিয়ে রেখেছি। ঘানি তেল বিক্রি করে সংসার চলছে। তেলের চাহিদা থাকলেও জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের মতো আর লাভ হয় না। আমি এনজিও ব্র্যাক থেকে ১ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে গরু কিনে তা ঘানি কাজে ব্যবহার করছি। এখনো এনজিওর লোন পরিশোধ হয়নি। সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা করেন তাহলে এই ঘানি শিল্পকে টিকিয়ে রাখব। তিনি আরও বলেন, অন্যান্য তেলের থেকে ঘানি ভাঙা তেলের দাম বেশি এবং চাহিদাও বেশি। বাজারে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এখনো ছুটে আসেন ঘানির তেল কিনতে। আমার এই খাঁটি সরিষার তেল সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, তুরস্ক, কানাডা, ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় যায়। ঘানির তেলের ঝাঁজ ও গন্ধ আলাদা। আমরা সব সময় খুচরা তেল বিক্রি করে থাকি। প্রতি লিটার তেল বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ টাকা এবং কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা দরে।