বগুড়ায় বিষাক্ত মদপানে দফায় দফায় প্রাণহানি হলেও একরকম দাপটের সাথেই ব্যবসা চালিয়ে গেছেন অভিযুক্ত পারুল হোমিও ল্যাবরেটরীজ। মায়ের নামে পারুল হোমিও ল্যাবরেটরীজ গড়ে তিন ভাই বিষাক্ত মদ বিক্রি ও ছড়িয়ে দিয়ে প্রাণহানি করে আসলেও মূলত তাদের কোন শাস্তি হয়নি। ২০০০ সালে ২২ জনের মৃত্যুর পর ২০২১ সালে মৃত্যু হলো ২০ জনের। তারপরও পারুল হোমিও ল্যাবরেটরীজটি দাঁড়িয়ে আছে।
বগুড়ায় গ্রেফতারকৃত চার হোমিও ব্যবসায়ীকে দ্বিতীয় দফায় আদালতের মাধ্যমে তিন দিনের রিমান্ড নেওয়া হয়েছে। আগের নেওয়া দুই দিনের রিমান্ড শেষে শুক্রবার বগুড়ার চীফ জুডিশিয়াল আদালতে গ্রেফতারকৃত চারজনকে প্রেরণ করে ৬ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। আদালতের বিজ্ঞ বিচারক মো. ওমর ফারুক ৩দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। জেলা পুলিশ বলছে প্রথম দফায় ২দিন রিমান্ড নিয়ে কোন তথ্য না পাওয়ার কারণে দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
বগুড়ার বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন থেকে গ্রেফতারকৃত চার হোমিও ব্যবসায়ী সহ জেলা শহরের বিভিন্ন আনাচে কানাচে গড়ে ওঠা অবৈধ হোমিও ওষুধ ব্যবসায়ীদের শাস্তি দাবী করেছে। সেই সঙ্গে অ্যালকোহল বিক্রির প্রতি কঠোর বিধি নিষেধ প্রয়োগে দাবী জানিয়েছে।
বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার ফয়সাল মাহমুদ জানান, তাদের নিয়ে অভিযান ও জিজ্ঞাসাবাদে আরও কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে। সে তথ্য পেতেই আবারো তিনদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। গ্রেফতারকৃত চারজন ইচ্ছাকৃত ভাবে তথ্য গোপন করছে। এর আগে তাদের প্রত্যেকের ২ দিনের করে রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ডে নিয়ে বৃহস্পতিবার ৪ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১ টায় জিজ্ঞাসাবাদে দেওয়া তথ্য মত জেলা শহরের নাটাইপাড়ায় অভিযান চালিয়ে ১ হাজার ৫০০ লিটার রেক্টিফাইট স্পিরিটসহ বিপুল পরিমাণে হোমিওপ্যাথি ওষুধ তৈরির সরঞ্জাম জব্দ করেছে বগুড়া সদর থানা পুলিশ।
বগুড়ায় গত ৩১ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিষাক্ত মদ পানে জেলা শহরের পুরান বগুড়া, তিনমাথা, ছিলিমপুর, ফুলবাড়ি, কালিতলা, কাটনারপাড়াসহ জেলার শাজাহানপুর উপজেলা, সারিয়াকান্দি উপজেলা ও কাহালু উপজেলা মিলিয়ে ২০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও জেলা পুলিশ বিভাগ থেকে ৮ জনের কথা সাংবাদিকদের জানানো হয়।
২ ফেব্রুয়ারি রাতে বগুড়া সদর থানা পুলিশ সদস্যরা অভিযান চালিয়ে বিষাক্ত মদ বিক্রির অভিযোগে গ্রেফতার করে বগুড়া জেলা শহরেরে করতোয়া হোমিও হলের স্বত্বাধিকারী ও নাটাপাড়ার বাসিন্দা শহিদুল আলম সবুর (৫৫), শহরের ফুলবাড়ি মধ্যপাড়ার পারুল হোমিও ল্যাবরেটরিজের স্বত্বাধিকারী মো. নুরুন্নবী (৫৮), শহরের গালাপট্টির মুন হোমিও হলের স্বত্বাধিকারী ও জেলা শহরের ছোটকুমিড়ার বাসিন্দা আব্দুল খালেক (৫৫), গালাপট্টি এলাকার হাসান হোমিও হলের কর্মচারী ও জেলা শহরের আকাশতারা এলাকার বাসিন্দা আবু জুয়েলকে (৩৫)।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বগুড়া সহ উত্তরের ২২ জেলায় হোমিও ওষুধ তৈরির কাজে ব্যবহারের জন্য রেকটিফাইড স্পিরিটি (আরএস) বিক্রির অন্যতম ডিলার বগুড়ার ফুলবাড়ীস্থ পারুল হোমিও ল্যাবরেটরিজ। এর মালিক ওই এলাকার বাসিন্দা তিন ভাই নূরে মোহাম্মাদ, নূর আলম ও নূর নবী। এর মধ্যেকার নূর মোহাম্মাদ ২০০৭ সালে র্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর থেকে ঢাকায় একই ব্যবসা শুরু করে কোটি কোটি টাকা আয় করেন। আর গত ২ ফেব্রুয়ারি বর্তমান স্বত্বাধিকারী মো: নুরুন্নবী (৫৮)কে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এদিকে বগুড়ার সদর থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, কয়েক দশক ধরে বগুড়ায় একটি চক্র হোমিও ওষুধের আড়ালে বিষাক্ত মদ বা অ্যালকোহলের সাথে রেক্টিফাইট স্পিরিট মিশিয়ে বিষাক্ত মদ তৈরি করে কম দামে নিম্ন-আয়ের মানুষের মাঝে বিক্রি করতো। কমদামে পেয়ে নিম্ন-আয়ের মানুষ বিষাক্ত মদ পান করতো।
আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বগুড়ার ফুলবাড়ি এলাকার নুর মোহাম্মদ এর পারুল হোমিও ল্যাবরেটরিজ পর্দার আড়ালে বিষাক্ত মদ তৈরি করে বিভিন্ন হোমিও ওষুধের দোকানে কম মূল্যে বিক্রি করতো। বিষাক্ত মদ পান করে এর আগে বগুড়ায় ২০০০ সালে ২২ জন মারা যান। ২২ যুবক মারা যাওয়ার ঘটনাতে পুলিশি তদন্তে পারুল হোমিও ল্যাবরেটরীজের নাম উঠে আসে। ওই সময় পারুল হোমিও মালিক তিন ভাই বিএনপি করার কারণে কৌশলে ছাড় পেয়ে যায়।
বগুড়া জেলা পুলিশ বিভাগ থেকে আরা জানানো হয়েছে সর্বপ্রথম ১৯৯৮ সালে পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে গাইবান্ধা জেলায় বিষাক্ত মদ পানে ৭১ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। সেই সময় গাইবান্দার রিপা হোমিও ওষুধের দোকানের নাম উঠে এলেও পুলিশের তদন্তে বগুড়ার পারুল হোমিও ওষুধের কারখানার সন্ধান পায়। ওই সময় পুলিশের তদন্তে দেখা যায় গাইবান্ধায় সরবরাহকৃত বিষাক্ত মদগুলো বগুড়ার পারুল হোমিও ল্যাবরেটরীজ সরবরাহ করেছিল। এই মামলায় রিপা হোমিও হলের ১০ বছর জেল হয়।
মামলার আগেই রিপা হোমিও হলের তৎকালীন মালিক দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। বিএনপি নেতা হওয়ার কারণে পারুল হোমিও ল্যাবরেটরীজের মালিক নুর মোহাম্মদ মামলা থেকে পার পেয়ে যান। বিষাক্ত মদের সর্বশেষ ছোঁবল গত ৩১ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২০ জনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেলেও জেলা পুলিশ বলেছে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে এই নুর মোহাম্মদকে ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে র্যাব-১২ বগুড়ার সদস্যরা অভিযান চালিয়ে ৩৬ বোতল অ্যালকোহলসহ গ্রেফতার করেছিল।
এদিকে বৃহস্পতিবার বগুড়া শহরের সাতমাথায় জেলা যুব ইউনিয়ন ও শুক্রবার জেলা শহরের ফুলবাড়িতে পারুল হোমিও কারখানার সামনে এলাকাবাসী মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে পারুল হোমিও ওষুধের দোকানটি স্থায়ীভাবে অনুমোদন বাতিল ও কারখানা মালিকদের কঠোর শাস্তি দাবী করে।
বিডি প্রতিদিন/আবু জাফর