ধরণ পাল্টে গেলেও, চিরায়ত বাংলার মেলার তেমন পরিবর্তন হয়নি। কালক্রমে নানা আনন্দ আর উৎসবের মধ্যে দিয়ে পালন হয়ে আসছে মেলা। দেশের নানা প্রান্তে নানা ঘটনায় মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। নবান্ন উপলক্ষ্যে বগুড়া জেলার কয়েকটি এলাকায় এবার হয়ে গেল মাছ মেলা। মেলায় ছিল হরেক রকমের ও আকারের মাছ। মেলায় পসরায় থাকতো মেলা পণ্য আর এবার মেলার প্রধান পণ্যই ছিল মাছ এবং মেলাকে কেন্দ্র করে ছিল গ্রামের ঘরে ঘরে উৎসবের আমেজ।
জানা যায়, নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করেই প্রতিবছর বগুড়া জেলার শিবগঞ্জের মহাস্থান ও উথলি, মোকাকমতলা, নন্দীগ্রাম উপজেলার রণবাঘা ও ওমরপুরে এবং কাহালু উপজেলা বাজারে মাছের মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম নয়, ক্রেতা-বিক্রেতাদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে মাছ মেলা। কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাছ মেলা বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের পদচারনায় মুখরিত ছিল। মেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামের ঘরে ঘরে উৎসবের আমেজ। শুধু মাছ আর সবজিই নয়, মেলার আবহের জন্য সেখানে শিশু- কিশোরদের খেলনার দোকান বসেছে। সেই সঙ্গে মিষ্টান্ন ও দইয়ের একটি বড় বাজারও বসেছে মেলা চত্বরে। এক কেজি থেকে শুরু করে ২০ কেজি ওজনের বাঘাইড়, বোয়াল, রুই, কাতলা, চিতল, ব্লাক কার্প, সিলভার কার্প, ব্রিগেড কার্পসহ নানা রকমের মাছ বিক্রি হয় এ মেলায়।
বগুড়ার শিবগঞ্জ সহ জেলার বিভিন্ন স্থানে মেলায় নতুন আলু সহ শাক-সবজি, মিষ্টান্ন, দই, মাটির তৈরী খেলার দোকানও সহ বিভিন্ন পণ্যর পসরাও সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা। এক দিনে মাছের বেচাকেনা হয় কোটি টাকার ওপরে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নবান্ন উৎসবকে ঘিরে শিবগঞ্জের উথলী মাছ মেলা প্রায় ২’শ বছরের ঐতিহ্যবাহী। শিবগঞ্জের আশেপাশের ২২ টি গ্রামের মানুষের ঘরে ঘরে উৎসবের আয়োজন হয় এই মেলাকে ঘিরে। প্রতি বাড়িতেই মেয়ে-জামাইসহ স্বজনদের নবান্নের মেলা থেকে কেনা বড় মাছ ও নতুন সবজি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। মেলায় ঘুরতে গিয়ে শ্বশুর ও জামাইরা কেনেন মাছ। যার মাছ যত বড় হবে সে তত সম্মানিত হবেন। পরিবারে সেদিন তার গ্রহণযোগ্যতাও হবে বেশি। আবার মাছ বিক্রেতারা যে যত বড় মাছ তুলতে পারবে মেলায় তার কদরও একটু বেশি হবে। শিবগঞ্জের মহাস্থান, উথলি, মোকামতলা মেলায় এক হাজার মণের বেশি মাছ কেনাবেচা হয়েছে। রুই-কাতলা ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও মাঝারি আকারের মাছ ২০০ টাকা থেকে সাতশ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এছাড়া ২৪০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা দরে ব্লাককার্প, বিগহেড ও সিলভার কার্প মাছ বেচাকেনা হয়। নবান্ন উপলক্ষে সেখানে মাছের মেলা বসলেও জমি থেকে নতুন তোলা অন্যান্য শাক-সবজির পসরাও সাজানো হয় মেলা চত্বরে। এই মেলায় নতুন আলু বিক্রি হয়েছে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা কেজি দরে। এ ছাড়াও মিষ্টি আলু ও কেশর (ফল) প্রতি কেজি দেড়শ' টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে।
শিবগঞ্জের উথলী এলাকার মাছ ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম জানান, তিনি গাবতলী উপজেলার ডাকুমারা এলাকায় নিজ উদ্যোগে মাছ চাষ করেন। এবার তাঁর পুকুরে চাষ করা একটি ১২ কেজির ওজনের কাতলা এনেছিলেন। ১ হাজার টাকা কেজি বিক্রি করেছেন। প্রতিবছরই এখানে মেলা বসে। মেলায় এখন প্রধান পণ্য হয়েছে মাছ। দুই শতাধিক মাছ ব্যবসায়ি তাদের মাছ নিয়ে বসেছে।
শিবগঞ্জ উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামের মোমিন মিয়া জানান, মেলায় ছোট-বড় মিলে দুই শতাধিক মাছের দোকান বসেছে। প্রত্যেক বিক্রেতা অন্ততঃ ৫ থেকে ১০ মণ করে মাছ বিক্রি করেছেন। মেলায় মাছ সরবরাহের জন্য সেখানে রাত থেকে ২০টি আড়ৎ খোলা হয়। সেসব আড়ৎ থেকে স্থানীয় বিক্রেতারা পাইকারি দরে মাছ কিনে মেলায় খুচরা বিক্রি করেন।
বগুড়ার শিবগঞ্জের উথলী বাজারের ইজারাদার শিশির জানান, আগে মেলাটি ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা ব্যাপকতা লাভ করেছে। শুধু আশেপাশেরই নয় পুরো শিবগঞ্জ উপজেলার মানুষ এখানে নবান্নের বাজার করতে আসেন। মাছের মেলার খবর পেয়ে শহর থেকেও অনেকে সেখানে ছুটে যান মাছ কিনতে। এবার মেলায় দেড় হাজার মণের বেশি মাছ কেনাবেচা হয়েছে বলে তিনি জানান।
বগুড়ার শিবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র তৌহিদুর রহমান মানিক বলেন, নবান্নের মেলা কেন্দ্র করে বছরের এই দিনে এলাকার হিন্দু মুসলিম সব বাড়িতে জামাই মেয়েসহ স্বজনদের অ্যাপায়ন করা হয়, সর্বত্র উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। যুগযুগ ধরে এই উৎসব চলে আসছে। আগে মাছ এতটা না থাকলেও কালক্রমে মাছের পসরা বেড়েছে। পৌরসভা থেকে মেলা কমিটিকে সহযোগিতা করা হয়।
এদিকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উৎসবের পঞ্জিকা অনুসারে বৃহস্পতিবার অগ্রহায়ণের এইদিনে নবান্ন উৎসব পালন করে নন্দীগ্রাম উপজেলাতেও। প্রতিবছর এ উৎসবকে ঘিরে বগুড়ার নন্দীগ্রামের ওমরপুর, রণবাঘায় মাছের মেলা বসে। এছাড়াও উপজেলার নাগরকান্দি, হাটকড়ই, ধুন্দার ও নন্দীগ্রামে মাছের মেলা বসেছে। মাছ মেলায় অনেক জেলে, মাছ খামারি, মাছ ব্যবসায়ি তাদের মাছ নিয়ে এনেছেন। উপজেলাজুড়ে প্রতিটি বাড়িতেই মেয়ে-জামাইসহ স্বজনদের আগে থেকেই দাওয়াত দেওয়া হয়।
বিডি-প্রতিদিন/ সালাহ উদ্দীন