২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১০:৫৬

পঞ্চগড়ে নৌ-দুর্ঘটনা : বেঁচে ফিরে আসা শিশুদের দিন কাটছে আতঙ্কে

সরকার হায়দার, পঞ্চগড়

পঞ্চগড়ে নৌ-দুর্ঘটনা : বেঁচে ফিরে আসা শিশুদের দিন কাটছে আতঙ্কে

সারাক্ষণ দাদীর সাথেই সময় কাটতো তনুশ্রীর। ঘুমাতো দাদীর সাথেই। কাহিনী শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতো। ২৫ সেপ্টেম্বর দাদি আর গ্রামের আরও দুজন সম্বন্ধীয় দাদির সাথে মহালয়া পূজা দেখতে যায় সে। সারা পথ উদগ্রীব। কখন পৌঁছাবে মন্দিরে ? আউলিয়ার ঘাটে নৌকায় উঠেই আনন্দ যেন থামেনা তার।

কিন্তু এমন বিভীষিকা অপেক্ষা করছে ভাবতেও পারেনি সে। একটু পরেই নৌকাটি কাঁত হয়ে যায়। তীর্থযাত্রীরা পড়ে যায় করতোয়ার গভীর জলে। তনুশ্রী জানায় পানির ভেতরে কে যেন তার চুল ধরে টানছিল। তারপর সে তলিয়ে যায়। পানির নিচেই সাঁতার কাটতে থাকে সে। একটু পর কে যেন তাকে তুলে আনে ডাঙ্গায়। পরে সে শুনে তার প্রিয় দাদি প্রমিলা রায় নিখোঁজ। পরদিন দাদির মরদেহ পাওয়া যায়।

কাঁদতে কাঁদতে এমন করেই বর্ণনা করছিলো বিভীষিকা ময় নৌকাডুবির ঘটনা। তার চোখে মুখে আতংক। কৃষক বাবা যামিনী রায়ের প্রথম সন্তান তনুশ্রী লক্ষীগড় ডাঙ্গাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণীতে পড়ে। সে সাঁতার জানতো। তার পরিবার জানায়, দাদির শোকে আর ভয় আতংকে তনুশ্রী নিথর হয়ে গেছে। বাড়ির কারো সাথে কথা বলে না। কিছু খায় না।  

মাড়েয়া স্কুল এন্ড কলেজের ৮ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মিঠুন রায়ের মা জানান, ছেলেটাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেই। ঘণ্টাখানেক পড়ে শুনি নৌকা ডুবে গেছে। পরে ঘটনাস্থলের দিকে এগিয়ে যেতে গিয়ে দেখি ভেজা কাপড়ে ছেলে ফিরে আসছে। আমার ছেলে এখন নিঝুম হয়ে গেছে। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মিঠুন জানায় মাঝে মাঝে শরীর কাঁপে। রাতে ঘুম আসেনা। খালি নৌকার কথা মনে পড়ে।

বড়বোন ঈশিতা ডুবে যাবার সময় ছোট ভাই দর্পন টেনে তুলেছিল। তারা দু’জনেই মাড়েয়া স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থী। তারা জানায় একদম ভালো লাগে না। তাদের বাবা-মা জানান, ছেলেটা স্কুলে যায় না। মেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। পড়ালেখা করতে পারে না। 

পঞ্চগড়ের মাড়েয়া বামুন হাট ইউনিয়নে করোতোয়া-ঘোড়ামাড়া নদীর মিলন স্থলে আউলিয়ার ঘাটে নৌকা ডুবির ঘটনায় ফিরে আসা শিশুরা এমন আতংক আর ভয়ের মধ্যেই দিন পার করছে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে ভয়ানক এই নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। ডুবে যাবার পর এ পর্যন্ত ৬৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আরও কয়েকজন এখনো নিখোঁজ। এই যাত্রীদের মধ্যে অনেকে সাতরে তীরে এসে নিজের জীবন বাঁচিয়েছেন। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে অনেকে বেঁচে গেছেন। ঠিক কতোজন এভাবে বেঁচে ফিরে এসেছেন তার তথ্য পাওয়া যায়নি। এদের মধ্যে অনেক শিশুও রয়েছে। এই শিশুদের মধ্য থেকে আতংক এখনো কাটেনি। এদের শরীর ও মনে ঘটনার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশংকা করছেন পরিবারের সদস্যরা। 

পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মনোয়ার হোসেন জানান, এ ঘটনায় শিশুদের মনো-জাগতিক পরিবর্তন ঘটতে পারে। যা তার ভবিষ্যৎকে ওলট-পালট করে দিতে পারে। এর প্রভাব থেকে নিরাপদ রাখতে শিশুদের কাউন্সিলিং করতে হবে। তাদের আনন্দ দিতে হবে। কোথাও ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) দীপকংর রায় জানান, ভয়ানক এই স্মৃতি শিশুদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তাদের জন্য কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

বিডি প্রতিদিন/আবু জাফর

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর