৬ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৮:৩৮

বগুড়ায় বাঁশ শিল্প বাঁচিয়ে রেখেছে অর্ধশতাধিক পরিবার

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

বগুড়ায় বাঁশ শিল্প বাঁচিয়ে রেখেছে অর্ধশতাধিক পরিবার

আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যেতে থাকা বাঁশ শিল্পকে আকড়ে ধরে এখনো জীবন ধারণ করছে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার ধাপের হাটের অর্ধশতাধিক পরিবার। বাঁশ থেকে তৈরি ডালা, কুলা, চালুন, খইচালা, জালি, ঝাপনি, চাঙ্গারি, বাচ্চাদের ছোট কুলাসহ হরেক রকমের পণ্য হাটে হাটে বিক্রি করে নিজেদের যেমন বাঁচিয়ে রেখেছেন, ঠিক তেমনি দেশীয় ঐতিহ্যবাহী পণ্যকে টিকেয়ে রেখেছেন পরিবারগুলো। বাঁশ দিয়ে তৈরি হরেক রকমের তৈজসপত্র প্রতি হাটে বিক্রি হয়ে থাকে প্রায় চার লাখ টাকার।

জানা যায়, অতীতে গ্রামে গঞ্জে বাঁশের তৈরি পণ্যসামগ্রীর কদর ছিল অনেক। এসব পণ্য শোভা পেত প্রত্যেক বাড়িতে। এছাড়া গৃহস্থালির নিত্য ব্যবহার দ্রব্যাদি, ডালা, চালুন, টোভা, কুবরি, ঝাকাসহ অসংখ্য জিনিস প্রতিটি সংসারে কাজের জন্য ব্যবহার হতো। অতীতে বাঁশের তৈরি তৈজসপত্রই ছিল সংসারের মূল ভরসা। কিন্তু কালক্রমে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাঁশ শিল্পে ভাটা পড়েছে। প্রযুক্তির ব্যবহার ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে বাঁশ শিল্প। বাঁশের তৈরি পণ্য বাঙালির পুরোনো ঐতিহ্য। পুরোনো এই ঐতিহ্য দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে।

কিন্তু পূর্ব পুরুষের ব্যবসাকে এখনো ধরে রেখেছেন জেলার দুপচাঁচিয়া উপজেলার কিছু মানুষ। পূর্ব পুরুষদের এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে তারা এখানো হাটে বিক্রি করছেন ঝুড়ি, ডালা, কুলা, চালুনি, হাতপাখাসহ নানা পণ্য। পৈতৃক এই পেশাকে ঘিরে ধরে আজো টিকে আছে পরিবারগুলো। বাঁশ থেকে তৈজসপত্র তৈরি করে গ্রামীণ ক্রেতাদের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এ ব্যবসায় মন্দাভাব থাকলেও বাঁশের পণ্যের চাহিদা গ্রামের মানুষের মাঝে এখনও বিদ্যমান রয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতেও দৃঢ় মনোবল নিয়ে বাঁশের পণ্য তৈরি ও তা বিক্রি করে অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করেছেন। বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার ধাপের হাট এলাকায় গ্রামের নারী পুরুষ মিলিয়ে তৈরি করছেন বাঁশের তৈজসপত্র। দিনে রাতে তৈরি হচ্ছে ডালা, কুলা, চালুন, খইচালা, জালি, ঝাপনি, চাঙ্গারিসহ বিভিন্ন কিছু। গ্রামের নারীরা সংসারের ফাঁকে ফাঁকে একমনে কাজ করে যাচ্ছেন বাঁশ শিল্পের।

বাঁশ শিল্পের কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রামের পুরুষরা বিভিন্ন বাগান থেকে ভালো ও লম্বামানের বাঁশ সংগ্রহ করে। পরে সেই বাঁশ প্রথমে চেচে পণ্যের আকার অনুযায়ী কেটে নেয়। কেটে নেওয়া অংশ থেকে বাঁশের পাতলা ও চিকন চাচ তৈরি করে তা দিয়ে ডালা, কুলা, চালুনসহ বিভিন্ন কিছু তৈরি করে। একজন কারিগর দিনে ৪ থেকে ৫টি বড় মাপের ডালি তৈরি করতে পারে। পাইকারদের কাছে এই ডালা বিক্রি করেন ৭০ থেকে ৮০ টাকা করে। আর খোলা বাজারে এই ডালা বিক্রি হয় ১০০ থেকে ১২০ টাকা। আর ভালোমানের পাকা বাঁশের ডালা বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা করে। দিনে কাজ করে একেকজন নারী শ্রমিক ৩০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা আয় করতে পারে। প্রতি মাসে একেক জন নারী শ্রমিক ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় করে থাকে। কারিগড়রা আরো জানান, প্রতি বৃহস্পতিবার ধাপের হাটে হাট বসে এই হাটে প্রায় ৪০টির মতো দোকান বসে। দোকানিরা প্রতি হাটবারে প্রায় চার লাখ টাকার বাঁশ থেকে তৈরি পণ্য বিক্রি করে থাকে।

ধাপেরহাট এলাকার বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম জানান, এই হাটে দীর্ঘ দিন ধরে বাঁশের তৈরি পণ্য বেচাকেনা হয়ে আসছে। বাঙালির ঐতিহ্য এসব পণ্য এখনো এলাকার ঘরে ঘরে ব্যবহার হয়ে আসছে। বাঁশের তৈরি বাহারি পণ্যও বেচাকেনা হয়ে থাকে ভালো। হাটে বেশ কিছু পাইকার আসেন। যারা পাইকারিভাবে কিনে নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে দেন।

বাঁশ শিল্পের ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবসা শুরু করছেন। প্রতি হাটে ৭-৮ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করেন। এছাড়াও গ্রামে ফেরি করে বাঁশের তৈরি এসব পণ্য বিক্রি করেন। তাতে তার ভালো আয় হয়। গড়ে মাসে তিনি ১ লাখ ১০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করেন। যা থেকে খরচ বাদ দিয়ে আয় হয় মাসে ২৫ হাজার টাকা। এসব পণ্য গ্রামেই বেশি প্রচলন রয়েছে। গৃহস্থালি কাজে এগুলো বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে।

হাটের আরেক ব্যবসায়ী মো. জাকারিয়া জানান, ধাপের হাটে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে বাঁশের তৈরি পণ্যের ব্যবসা করছেন। এখানে প্রতিটি পণ্য যেমন-প্রতি পিস ডালা বিক্রি হয় ৭০ টাকা, কুলা ১০০ টাকা, চালুন ৮০ টাকা, ডালি ১০০ টাকা, ঝাঁপি ৪০ টাকা থেকে ১০০ টাকা খুচরা মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। এই হাটে প্রচুর ক্রেতা আসেন। তারা তাদের চাহিদামতো পণ্য কিনে থাকেন। তাছাড়া এখন বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকাররা এসে বাঁশের তৈরি পণ্য কিনে নিয়ে যান। এসব বাঁশের তৈরি করা পণ্যসামগ্রীগুলো নিজেরাই তৈরি করেন। বর্তমানে বাজারে সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় লাভের অংশ কিছুটা কমে গেছে। বিশেষ করে প্লাস্টিক পণ্যের দৌরাত্ম্যের কাছে তাদের হাতের তৈরি শিল্প মার খেয়ে যাচ্ছে।

হাটে বাঁশের তৈরি পণ্য কিনতে আসা হযরত আলী জানান, পরিবারে সারা বছরই বাঁশের তৈরি এসব পণ্য ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে গৃহস্থালি কাজে এগুলো বেশি জরুরি। পুরোনো এই ঐতিহ্য এখনও ধরে রাখা হয়েছে। বাপ-দাদারাও তাদের সংসারে বাঁশের তৈরি ডালা, কুলা, চালুন, ঝাঁপি, হুচা ব্যবহার করেছিলেন। তবে বর্তমান আধুনিক যুগে বাঁশের বিকল্প এখন প্লাস্টিকের অনেক পণ্য তৈরি করা হচ্ছে। যার ফলে শহরের বেশির ভাগ মানুষ বাঁশের তৈরি এসব পণ্যের ব্যবহার ভুলে গেছেন। বাঁশ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এই পেশার সাথে এখনও অনেক পরিবার জড়িয়ে আছেন।

বিডি প্রতিদিন/এমআই

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর