পৃথিবীতে গাছের সংখ্যা কমে গেছে। তাই বৃষ্টি হয় না। বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম বৃষ্টি, কৃত্রিম গাছ আর কৃত্রিম পাখির ডাকের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু কৃত্রিম গাছের সবুজে প্রাণ নেই, পাখির ডাকে সুর নেই আর বৃষ্টির ফোঁটা যেন মেশিনের নিঃশ্বাস। এই কৃত্রিম প্রকৃতি মানুষকে অস্থির করে তোলে। চার পাশে কাচ, লোহা আর শব্দের ভিতর প্রকৃতির ছোঁয়া না পেয়ে মানুষ ক্লান্ত, বিমর্ষ।
ভার্চুয়াল এক পার্কে দাঁড়িয়ে আছে তানিম। মাত্র বারো বছর বয়স ওর। তানিম হঠাৎ বলল, ‘মা, কোনো পাখি ডাকে না কেন?’ মা বললেন, ‘তুমি তো জানো, এখন আর প্রকৃত পাখি নেই। সব কিছুই সাউন্ড-সিমুলেশন। গাছও কৃত্রিম।’ তানিম বলল, ‘কিন্তু ইন্টারনেটে আমি পড়েছি। এক সময় মানুষ মাঠে খেলত, গাছে ফল ধরত আর আকাশ থেকে টুপটাপ করে বৃষ্টি নামত।’ মা বললেন, ‘হ্যাঁ তানিম, সেটা অনেক আগের কথা। এখন আমরা শুধু টিকে আছি, বেঁচে নেই।’ তানিম চুপ করে যায়। চোখে জমে থাকে একরাশ বিস্ময় আর এক ফোঁটা কান্না।
স্কুলে ঢুকতেই আজকের বিষয়-‘আধুনিক কৃত্রিম প্রকৃতি’। শিক্ষক বোর্ডে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এই হচ্ছে ট্রিনো-বট। এটি একটি কৃত্রিম গাছ, যার ভিতরে অক্সিজেন জেনারেটর লাগানো আছে।’ একটি রোবোটিক গাছ ছাত্রদের সামনে ঘুরে বেড়ায়। পাখির ডাক শুনিয়ে দেয় একটি ছোট যন্ত্র। তানিম হাত তুলে প্রশ্ন করল, ‘স্যার, যদি কৃত্রিম গাছ এত ভালো হয় তাহলে প্রকৃত গাছ কেন আর লাগানো হয় না?’ স্যার চিন্তিত মুখে বললেন, ‘কারণ এই পৃথিবীর মাটি এখন মৃত। এখানে কিছু জন্মায় না। অতিরিক্ত কংক্রিট, প্লাস্টিক আর দূষণ মাটিকে মৃত করে দিয়েছে। বিজ্ঞান যতই এগিয়েছে, প্রকৃতি ততই পিছিয়েছে।’ তানিমের বুকের ভিতর কেমন ব্যথা করে ওঠে।
তানিম বাড়ি ফিরে নিজের বানানো ছোট গবেষণাগারে বসে। অনেকগুলো পুরোনো বই ঘেঁটে খুঁজে বের করে কীভাবে একটু উর্বর মাটি বানানো যায়। তানিম কৃত্রিম রাসায়নিক ছাড়াই জৈব উপাদান আর ব্যাকটেরিয়া দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে। তানিম বলে, ‘আমি যদি একটু উর্বর মাটি বানাতে পারি, যদি সেখানে বীজ জন্মায়-তাহলে হয়তো আবার সব ফিরিয়ে আনতে পারব।’ তানিম রাতের পর রাত জেগে থাকে। পুরোনো পানি জমানো, বায়ো-ডাস্ট থেকে কম্পোস্ট বানানো-সব নিজে নিজে করে।
এক দিন সকালে মা তানিমকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। ‘তানিম! উঠে পড়ো, দেখো গাছের চারা। তানিম ছুটে যায়। পুরোনো কাঁচের বয়ামের ভিতরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একটুখানি সবুজ! তানিম উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘আমি পেরেছি! মা আমি পেরেছি!’ মা হাসিমুখে বললেন, ‘তুমি পারবে। আমি জানতাম।’
এই খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ভাইরাল হয়-‘এক শিশু তৈরি করেছে উর্বর মাটি!’ গবেষণা কেন্দ্রগুলো তানিমকে ডাকে। তানিম নিজের আবিষ্কার সবার সঙ্গে ভাগ করে নেয়। তানিমের উদ্যোগে তৈরি হলো এক নতুন প্রজেক্ট-‘সবুজ পৃথিবী আবার (Green Earth Again)’
বিশ্বজুড়ে তৈরি হলো :
‘গাছ লাগানোর স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র’
‘পাখির পুনর্বাসন প্রকল্প’
‘বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের কৃত্রিম হ্রদ’
এক বছরের মাথায়, পৃথিবীর নানান প্রান্তে ছোট ছোট সবুজ গাছ মাথা তোলে। নতুন প্রজন্ম হাতে তুলে নেয় গাছের বীজ। কেউ এখন মাটিকে মৃত ভাবে না। সবাই মাটিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে।
পাঁচ বছর পর, সেই ধূসর পৃথিবী আর নেই। আকাশে মেঘ জমে। হঠাৎই হালকা বৃষ্টি নামে। কেউ কৃত্রিম স্প্রের আওয়াজ শুনতে পায় না। এই বৃষ্টি একেবারে সত্যিকারের। পাখিরা ডাকছে। শিশুরা ঘাসে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। গাছের পাতায় শিশির জমে আছে। তানিম এখন তরুণ। গাছতলায় বসে একদল শিশুকে গল্প শোনায়- ‘এই গাছটা একটা ছোট্ট চিন্তা থেকে এসেছিল। আমি শুধু চেয়েছিলাম সত্যিকারের বৃষ্টি দেখতে, ‘পাখির ডাক শুনতে। তোমরা যদি চাও, এই পৃথিবী আবার সবুজ হবেই।’ শিশুরা হাত তুলে বলে, ‘তানিম ভাইয়া, আপনি আমাদের হিরো!’ তানিম হাসে। বলে, ‘হিরো তো প্রকৃতি, আমি শুধু ওর পাশে দাঁড়িয়েছি।’