- আবারও নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনের লড়াইয়ে সেই অ্যান্ড্রু কুমো
- বিরলে চালককে হত্যা করে ভ্যান ছিনতাই
- প্রাইভেট কারের সাথে সংঘর্ষে অটোরিকশা খালে, যুবক নিহত
- এনসিপির কর্মসূচিতে হামলার তীব্র নিন্দা বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের
- পাকিস্তানি এয়ারলাইনসের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করল যুক্তরাজ্য
- নীলফামারীতে ‘জুলাই শহিদ দিবস’ পালিত
- বরিশালে ডেঙ্গু জ্বরে বৃদ্ধার মৃত্যু
- ব্লকেড সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান নাহিদের
- শ্রীবরদীতে বন্য হাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে চেক বিতরণ
- ইরান আরও কঠোর জবাব দিতে প্রস্তুত, আয়াতুল্লাহ খামেনির হুঁশিয়ারি
- বগুড়ায় কৃষকদের মাঝে বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ
- চীনের সমর্থনের প্রশংসা করল ইরান
- তিস্তায় ১২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে : পরিবেশ উপদেষ্টা
- ইসরায়েলি হামলায় সিরিয়ার সেনা সদর দফতরে বিস্ফোরণ
- পলাতক ৮ আসামিকে হাজির হতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ
- দুঃখ লাগে, মুক্তিযুদ্ধকে ভুলিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা লক্ষ্যণীয় : হাফিজ উদ্দিন
- সীমান্ত হত্যায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ভারতীয় আইনে বিচার চাইলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
- ‘পরস্পরের প্রতি সম্মান রেখে নতুন বাংলাদেশে রাজনীতি করা উচিত’
- সারা দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্লকেড কর্মসূচি ঘোষণা
- আওয়ামী দোসররা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে : ফখরুল
চ্যালেঞ্জেও রপ্তানিতে আশা
বিশ্বজুড়ে মন্দা এবং দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মাঝেই সাফল্য দেখিয়ে চলেছে রপ্তানি খাত। এই সাফল্যে ভর করেই শক্তিশালী হচ্ছে রিজার্ভ, কাটছে ডলারসংকট। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সর্বশেষ পরিসংখ্যানেও রপ্তানির বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অগ্রগতির চিত্র উঠে এসেছে। সংস্থার ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিভিউ ২০২৪’ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশ রপ্তানি করে ৪৭.২ বিলিয়ন বা চার হাজার ৭২০ কোটি ডলারের পণ্য। রপ্তানি শেয়ার দাঁড়ায় ০.১৯ শতাংশ। এতে বৈশ্বিক রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান একধাপ এগিয়ে হয় ৫৮তম। ২০২৩ সালে অবস্থান ছিল ৫৯তম, রপ্তানি হয় চার হাজার ৪২৩ কোটি ডলারের পণ্য।
এলডিসি উত্তরণে চ্যালেঞ্জ ও প্রস্তুতি

বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে। ৫০ বছর পর নভেম্বর ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তীর্ণ হবে। যেহেতু ভুটান ২০২৩ সালে উত্তীর্ণ হয়েছে, এবং বাংলাদেশের সঙ্গে নেপালও একই সময়ে এই গ্রুপ থেকে উত্তীর্ণ হবে, দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র আফগানিস্তানই তখনো স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে থেকে যাবে। যেকোনো বিচারে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ মাইলফলক একদিকে যেমন বাংলাদেশ ও তার জনগণের ইতিবাচক আর্থ-সামাজিক অর্জনের পরিচয় বহন করে, অন্যদিকে এ উত্তরণের সঙ্গে অনেক চ্যালেঞ্জও বাংলাদেশকে মোকাবেলা করতে হবে।
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিগত সময়ে এসব দেশের জন্য প্রযোজ্য অনেক সুবিধা ভোগ করেছে। যেমন-বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে শুল্কমুক্ত, কোটামুক্ত বাজার সুবিধা (যা থেকে দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৭০ শতাংশ লাভবান হয়ে থাকে), বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মেধাস্বত্ব চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ছাড়, বাণিজ্য শক্তি বৃদ্ধিতে আর্থিক-কারিগরি সহায়তা, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিভিন্ন অ্যাগ্রিমেন্ট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ ও পার্থক্যমূলক সুবিধাপ্রাপ্তি ইত্যাদি। বাংলাদেশের বিভিন্ন খাত, বিশেষ করে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতসহ বিভিন্ন রপ্তানি পণ্য ও দেশীয় ওষুধশিল্প এসব সুবিধা ব্যবহার করে প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ পেয়েছে এবং দেশি ও বিদেশি বাজারে নিজ নিজ অবস্থান শক্তিশালী করেছে।
তৈরি পোশাক খাতে বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে শুল্কমুক্ত বাজারে প্রবেশাধিকারের বড় ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। শুধু উন্নত দেশ নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, জাপানের সঙ্গে ভারত, চীনসহ বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশও বাংলাদেশকে প্রায় সব পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দিয়েছে। এসবই বাংলাদেশের রপ্তানি, কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। উৎপাদন, বিনিয়োগ, প্রণোদনা, ভর্তুকি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিভিন্ন শর্ত প্রতিপালনের ক্ষেত্রেও স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে শৈথিল্য দেখানো হয়, যার সুযোগও বাংলাদেশ পেয়েছে।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর এসব দেশের জন্য প্রত্যক্ষভাবে প্রযোজ্য বিভিন্ন সুবিধা আর থাকবে না। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডা, চীনসহ বেশ কিছু দেশ শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার কিছু সময়ের জন্য (দু-তিন বছর) সম্প্রসারিত করে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর উত্তরণকে টেকসই করতে সহায়তা করার কথা বলেছে। এ সুবিধা যে সীমিত ও সাময়িক, তা বিবেচনায় রাখতে হবে। মেধাস্বত্ব আইনের ক্ষেত্রে শৈথিল্য ২০২৬-এর পরে আর থাকবে না। পেটেন্ট/লাইসেন্স মানতে হবে, বিশেষত পেটেন্ট আওতাধীন ওষুধের ক্ষেত্রে।
বাজার প্রবেশাধিকার, বাণিজ্য সহজীকরণ, মান নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্য উৎপাদন সহায়তা এসবের ক্ষেত্রে উত্তরণ-পূর্ব দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এ ধরনের একটি নিকট ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ স্মুথ গ্র্যাজুয়েশন স্ট্র্যাটেজি (মসৃণ উত্তরণ কৌশল) প্রণয়ন করেছে। যার মাধ্যমে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণকে টেকসই করার জন্য সুনির্দিষ্ট বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে; সময়াবদ্ধভাবে বিভিন্ন অংশীজনের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টনও করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ কৌশলের বাস্তবায়ন নিরীক্ষণের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উত্তরণ প্রস্তুতি কর্মকাণ্ডকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশকে বাজার সুবিধানির্ভর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা থেকে দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতানির্ভর প্রতিযোগিতা সক্ষমতার রূপান্তর নিশ্চিত করতে হবে। উৎপাদন পর্যায়ে শ্রম অধিকার, জেন্ডার অধিকার, পরিবেশ সংরক্ষণ এসব বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশকে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়-বহুপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী ও অগ্রণী হতে হবে। এ প্রচেষ্টা চলমান আছে, একে আরো বেগবান করতে হবে। মান নিয়ন্ত্রণ, মেধাস্বত্ব আইনের প্রয়োগ, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কিত পরিবেশ উন্নয়নে বিশেষভাবে যত্নবান হতে হবে। এসব ক্ষেত্রে যেসব উদ্যোগ গৃহীত হচ্ছে, তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করতে হবে। এসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা, অর্থায়ন ও জনবল দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে। সব ক্ষেত্রেই সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
এর আগে যে আটটি দেশ স্বল্পোন্নত থেকে উত্তরণ করেছে তাদের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার, জনসংখ্যা, আমদানি রপ্তানিসহ বিভিন্ন সূচকে ব্যতিক্রমী ও বৃহৎ। বস্তুতপক্ষে এই প্রথম একটি বৃহৎ স্বল্পোন্নত দেশ উত্তরণ করতে যাচ্ছে। যেকোনো বিচারে, বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বড় অর্জন ও গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এ উত্তরণ অর্জিত সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে বিশ্ববাজারে ও বিশ্ব অর্থনীতিতে বৃহৎ পরিসরে অংশগ্রহণের একটি সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। ক্রেডিট রেটিং, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ঋণ সুদহার ইত্যাদির ক্ষেত্রে তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি করে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করার তাগিদ সৃষ্টি করবে। অন্যদিকে এ উত্তরণের পর বাংলাদেশকে বহুবিধ নতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বর্তমান পরিস্থিতিতে বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। মার্কিন পাল্টাপাল্টি শুল্ক বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যকে বিপৎসংকুল করার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ এমন একটা সময়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ করতে যাচ্ছে, যখন একটা প্রতিকূল বিশ্ব পরিস্থিতি ক্রমে দৃশ্যমান হচ্ছে।
এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে তার পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও নতুন ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখিত মসৃণ উত্তরণ কৌশলের বাস্তবায়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। নিকট ভবিষ্যতের এ গুরুত্বপূর্ণ বাঁক অতিক্রম করার সামর্থ্য অর্জনের বিকল্প বাংলাদেশের সামনে নেই। তাই যথাযথ প্রস্তুতিরও বিকল্প নেই।
লেখক : সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)
উন্নয়নশীল হলে রপ্তানিতে চাপ বাড়বে, প্রস্তুত নয় সিমেন্টশিল্প
এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় বাংলাদেশের উত্তরণ নিয়ে আশাবাদের পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে নানা শঙ্কাও। প্রভাব পড়বে সিমেন্ট খাতেও। গণমাধ্যমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে কথা বলেন ক্রাউন সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোল্লা মোহাম্মদ মজনু।
প্রশ্ন: এলডিসি উত্তরণে সিমেন্টশিল্পে কতটা প্রভাব পড়বে?
মোল্লা মোহাম্মদ মজনু: সিমেন্টশিল্প সরাসরি রপ্তানিনির্ভর নয়। তবে আমাদের বড় ক্রেতা গার্মেন্টস খাত। তারা যখন এক্সপানশন করে, নতুন ভবন তৈরি করে, তখনই আমাদের পণ্য বেশি যায়। এলডিসি-পরবর্তী সময়ে গার্মেন্টস খাতের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। শুল্ক সুবিধা হারানো, কঠোর বাজার প্রতিযোগিতা ও ভর্তুকি হ্রাসের কারণে যদি গার্মেন্টস খাত উৎপাদন বা সম্প্রসারণে পিছিয়ে পড়ে, তাহলে সিমেন্ট খাতও সেই প্রভাব থেকে রেহাই পাবে না। আমরা গার্মেন্টসের ডায়িং ইন্ডাস্ট্রিতেও নিয়মিত পণ্য দিই। ওরা যদি নতুন প্রকল্প না নেয়, তাহলে আমাদের ব্যবসাও সংকুচিত হবে।
প্রশ্ন: রপ্তানিতে কী ধরনের বাধা অনুভব করেন?
মোল্লা মোহাম্মদ মজনু: ক্রাউন সিমেন্টের মাধ্যমেই ২০০৩ সালে বাংলাদেশ থেকে সিমেন্ট রপ্তানির সূত্রপাত। একমাত্র আমাদেরই রয়েছে পরপর দুবার স্বর্ণপদকসহ মোট তিনবার জাতীয় রপ্তানি পদক অর্জনের গৌরব। বর্তমানে মোট সিমেন্ট রপ্তানির ৪৬ শতাংশ ক্রাউন সিমেন্টের দখলে। তবু কাঙ্ক্ষিত সহায়তা এখনো মেলে না। রপ্তানির ক্ষেত্রে আগাম শুল্ক ফেরত পাওয়াটা এখনো অত্যন্ত জটিল। এতে আমাদের পুঁজি আটকে থাকে। এলডিসি অবস্থায় যেটা ছিল, আমরা চাই উন্নয়নশীল হলেও যেন অন্তত এই অংশে সহায়তা অব্যাহত থাকে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সিমেন্ট রপ্তানির জন্য দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করা প্রয়োজন। ভারত, মায়ানমার, নেপাল, ভুটান-সবখানেই আমাদের পণ্যের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু বাধা হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, সীমান্ত জট এবং আন্তর্দেশীয় সমঝোতার অভাব।
প্রশ্ন: জ্বালানিসংকট ও উচ্চ সুদ কতটা বাধা?
মোল্লা মোহাম্মদ মজনু: এলডিসি-পরবর্তী সময়ে রপ্তানির প্রতিযোগিতা বাড়বে, তাই উৎপাদন খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। কিন্তু দেশে গ্যাস সরবরাহের ঘাটতি ও ঋণের উচ্চ সুদ হার সেই প্রতিযোগিতায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা গত ১৬ বছরে ১০ শতাংশ সময়ও গ্যাস পাইনি। কয়লা ব্যবহার করতে হয়, যার খরচ বেশি, আবার পরিবেশদূষণও হয়। অন্যদিকে ১২-১৩ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে কেউ শিল্প চালাতে পারবে না। বিদেশে শিল্প-কারখানা ৪-৫ শতাংশ সুদে ঋণ পায়, ফলে তাদের উৎপাদন ব্যয় অনেক কম।
প্রশ্ন: রপ্তানিতে বন্দরের সীমাবদ্ধতা কেমন?
মোল্লা মোহাম্মদ মজনু: সীমান্তে ট্রাক আটকে থাকা, স্থলবন্দরে ধীরগতির কার্যক্রম, পণ্য খালাসে দীর্ঘসূত্রতা—এসবই সিমেন্ট রপ্তানির ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক। ভারতের অংশে অবকাঠামো যেভাবে উন্নত হয়েছে, আমাদের এখানে তার ধারেকাছেও যাওয়া হয়নি। আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকি, অথচ রপ্তানির জন্য কোনো আলাদা সহায়তা মেলে না।
প্রশ্ন: স্থানীয় বাজারে সিমেন্টের চাহিদা কেমন?
মোল্লা মোহাম্মদ মজনু: ২০০০ সালে মাথাপিছু সিমেন্ট ব্যবহার ছিল ৪৫ কেজি। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১০ থেকে ২১৫ কেজিতে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী এটি এখনো খুবই কম। চীনে এই হার এক হাজার ৭০০ কেজি, ভারতে ৪৫০ কেজি। আমাদের জনসংখ্যা ও গৃহায়ণের হার বিবেচনায় ভবিষ্যতে এই চাহিদা ৮০০ কেজি ছাড়িয়ে যেতে পারে। তখন যদি কাঁচামাল আমদানি, উৎপাদন সক্ষমতা ও সরবরাহ ঠিক না থাকে, তাহলে বড় সংকট তৈরি হবে।
প্রশ্ন: আপনাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মোল্লা মোহাম্মদ মজনু: সিমেন্টশিল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিশাল। আমরা শিল্পের আঁতুড়ঘরেই আছি। এই জনবহুল দেশে শিল্প ও প্রযুক্তি ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমরা নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এসব প্রকল্প শুধু ব্যবসার জন্য নয়, কর্মসংস্থান ও সিএসআরের মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখার জন্যও। আমরা থাকি বা না থাকি, এই শিল্প থাকবে। এলডিসি উত্তরণ মানেই শুধু সুবিধা হারানো নয়, বরং সেটি সামাল দেওয়ার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত থাকতে হবে। রপ্তানি টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, সহজ শর্তে ঋণ, জ্বালানির নিশ্চয়তা এবং স্থলবন্দর উন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে। তা না হলে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় আমরা পিছিয়ে পড়ব।
ইলেকট্রনিক পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে নীতির ধারাবাহিকতা জরুর
‘মেড ইন বাংলাদেশ’ পণ্য নিয়ে বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশে পৌঁছে গেছে ওয়ালটন। লক্ষ্য বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গ্লোবাল ইলেকট্রনিকস ব্র্র্যান্ডের তালিকায় স্থান করে নেওয়া। ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম মাহবুবুল আলম গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, আমদানিকারকদের চেয়ে যাতে স্থানীয় শিল্প বেশি সুবিধা পায় সেটি নিশ্চিত করা দরকার।
প্রশ্ন: আপনাদের কম্পানি কী কী পণ্য রপ্তানি করছে, কত দেশে যাচ্ছে?
এস এম মাহবুবুল আলম: গাজীপুরের চন্দ্রায় ওয়ালটন কারখানায় সর্বাধুনিক ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্টে তৈরি ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগযুক্ত রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, বেভারেজ কুলার, এয়ারকন্ডিশনার, টেলিভিশন, ওয়াশিং মেশিন, কম্প্রেসর, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, বৈদ্যুতিক পাখা বা ফ্যানসহ বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রিক্যাল, হোম ও কিচেন অ্যাপ্লায়েন্সেস এবং প্রযুক্তিপণ্য রপ্তানি করা হচ্ছে। বর্তমানে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ওশেনিয়া ও ইউরোপের অর্ধশতাধিক দেশের বাজারে রপ্তানি হচ্ছে ওয়ালটন পণ্য। ওয়ালটনের তৈরি কম্প্রেসর রপ্তানির বড় একটি বাজার হচ্ছে ইউরেশিয়া খ্যাত দেশ তুরস্ক। এ ছাড়া ইউরোপের দেশগুলোতে ওয়ালটনের তৈরি টেলিভিশন ব্যাপক রপ্তানি হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটান ওয়ালটন পণ্যের অন্যতম রপ্তানি গন্তব্য।
প্রশ্ন: বিদেশে পণ্যের বাজার তৈরিতে আপনারা কিভাবে কাজ করছেন?
এস এম মাহবুবুল আলম: গত দশকের মাঝামাঝি থেকে ওইএমের (অরিজিনাল ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার) আওতায় এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণ করে ওয়ালটন। টেকসই পণ্য, উচ্চ গুণগত মান, এআই, আইওটিসহ সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও ডিজাইনের কারণে ওই সব দেশের বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় ওয়ালটনের পণ্য অন্যান্য ব্র্যান্ডের চেয়ে এগিয়ে থাকায় অতি অল্প সময়ের মধ্যে বৈশ্বিক ক্রেতাদের আস্থা জয় করে নিতে সক্ষম হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চলতি দশকের শুরু থেকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গ্লোবাল ইলেকট্রনিকস ব্র্র্যান্ডের তালিকায় স্থান করে নেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ইউরোপ, আমেরিকা, ওশেনিয়াসহ উন্নত বিশ্বের বাজারে নিজস্ব ব্র্যান্ড বিজনেস সম্প্রসারণে কাজ করছে ওয়ালটন। বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও ফিচারের উদ্ভাবনী পণ্যের পাশাপাশি ইউরোপ ও আমেরিকার স্ট্যান্ডার্ড, আবহাওয়া, ক্রেতাদের চাহিদা ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া এসিসি, জানুসি ইলেকট্রোমেকানিকা ও ভার্ডিকটার- অর্ধশতাধিক বছরের ঐতিহ্যবাহী এই তিন ইউরোপীয় ইলেকট্রনিকস ব্র্যান্ডের কম্প্রেসর, এসি-ফ্রিজসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিকস পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাজারজাত করতে যাচ্ছে ওয়ালটন। ওয়ালটনের ব্র্যান্ড বিজনেস সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বড় বড় মেলায়ও অংশ নিয়ে ভালো সাড়া পাচ্ছে ওয়ালটন।
প্রশ্ন: পণ্যের গুণগত মান ও উদ্ভাবনে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে ওয়ালটন?
এস এম মাহবুবুল আলম: একটি প্রযুক্তিপণ্যে ক্রেতার আস্থা তৈরি হয় তার গুণগত মানের ওপর। এ বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও মেশিনারিজ স্থাপন থেকে শুরু করে উন্নতমানের বেসিক কাঁচামাল বা কম্পোনেন্টস ব্যবহার এবং কঠোরভাবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণের মাধ্যমে পণ্যের উচ্চ গুণগত মান নিশ্চিত করছে ওয়ালটন। ফ্রিজ, এসি ইত্যাদি পণ্যে আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) বেইসড ব্যাপক বিদ্যুৎসাশ্রয়ী ইনভার্টার প্রযুক্তিসহ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-সমৃদ্ধ বিশ্বের সর্বাধুনিক ও উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ও ফিচারের ব্যবহার করছে ওয়ালটন। আমাদের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগ প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করছে।
প্রশ্ন: রপ্তানি আরো বাড়াতে সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
এস এম মাহবুবুল আলম: দেশি শিল্পোদ্যোক্তারা সরকারের নীতি সহায়তাকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে দেশে ইলেকট্রনিকস শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটিয়েছেন। ওয়ালটনসহ যেসব কম্পানি এগিয়ে এসেছে, তাদের প্রচেষ্টায় এই খাত এখন ভালো অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। একসময়ের সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর দেশের ইলেকট্রনিকস পণ্যের বাজার এখন স্থানীয় উৎপাদননির্ভরতায় চলে এসেছে। এই খাতের আমদানিনির্ভরতা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় বছরে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। এই খাতে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হওয়ার পাশাপাশি প্রযুক্তিশিল্পের দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে। বৈশ্বিক বাজারে ওয়ালটন তথা ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগযুক্ত প্রযুক্তিপণ্য ব্যাপক সুনাম অর্জন করছে। প্রযুক্তিপণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণে এই খাতের অসাধারণ সাফল্য বজায় রাখতে শিল্পবান্ধব পলিসি সাপোর্ট অব্যাহত রাখা অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে পলিসিগত কিছু পরিবর্তনও দরকার। যেমন- পরিবেশবান্ধব ও এনার্জি ইফিশিয়েন্ট পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির ক্ষেত্রে আরো বেশি প্রণোদনা দরকার।
প্রশ্ন: শুল্কমুক্ত সুবিধায় ইলেকট্রনিক পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকার কী করতে পারে?
এস এম মাহবুবুল আলম: পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি এবং সেখানে ইলেকট্রনিকস খাতের সব পণ্য অন্তর্ভুক্ত থাকলে আমাদের সুবিধা হয়। অনেক সময় দেখা যায়, দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে ইলেকট্রনিকসের মাত্র একটি বা দুটি পণ্যের নাম উল্লেখ থাকে। দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য রপ্তানির তালিকায় ইলেকট্রনিকস খাতের সব পণ্য অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে আরেকটু দৃষ্টি দিলে রপ্তানির নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হবে এবং রপ্তানির পরিমাণ আরো দ্রুত বাড়বে। ওয়ালটনের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বে ভিআরএফ ও চিলার কমার্শিয়াল এসি উৎপাদনকারী নবম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। শুধু তাই নয়, শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশের বাজারে ওয়ালটন এখন কমার্শিয়াল এসি (চিলার) রপ্তানিও করছে। কিন্তু বিদ্যমান পলিসিতে কমার্শিয়াল ভিআরএফ এসির বেসিক কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চহারে শুল্ক দিতে হচ্ছে, যার ফলে উচ্চ প্রযুক্তির ভিআরএফ এসি দেশে উৎপাদনে খরচ বেশি পড়ছে। এই দিকে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি দেওয়া উচিত। আমদানিকারকদের চেয়ে যেন স্থানীয় শিল্প বেশি সুবিধা পায় সেটি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
প্রশ্ন: বিশ্বজুড়ে পরিবেশবান্ধব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। ওয়ালটন কিভাবে কাজ করছে?
এস এম মাহবুবুল আলম: জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়ন নিয়ে মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন, যার পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক বাজারে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিপণ্যের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। পরিবেশ সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও ইউএনডিপির সমন্বয়ে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে ওয়ালটন। বিশ্বে ওয়ালটনই প্রথম পরিবেশ অধিদপ্তর এবং ইউএনডিপির সমন্বয়ে ফ্রিজ ও এসির কম্প্রেসরে ক্ষতিকারক সিএফসি ও এইচসিএফসি গ্যাস ফেজ আউট প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এর ফলে বায়ুমণ্ডলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে ওয়ালটন ফ্রিজ ও এসির কম্প্রেসরে ব্যবহার করা হচ্ছে বিশ্বস্বীকৃত পরিবেশবান্ধব আর৬০০এ এবং আর-৩২ ও আর-২৯০ রেফ্রিজারেন্ট। এ ছাড়া পণ্য উৎপাদনে পরিবেশবান্ধব উপকরণ ও খুচরা যন্ত্রাংশ ব্যবহার করছে ওয়ালটন। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব পণ্য উৎপাদনে ওয়ালটন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি এসডিজি ব্র্যান্ড চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি আমরা। এ ছাড়া টেকসই ক্লিন এনার্জি উদ্যোগের জন্য ওয়ালটন অর্জন করেছে ‘এসডিজি ব্র্যান্ড চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড-২০২৫’, বর্ষসেরা সবচেয়ে টেকসই ইলেকট্রনিক পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, ‘অনারেবল মেনশন’ ব্র্যান্ড, টানা দুইবার গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড এবং জাতীয় পরিবেশ পদকেও ভূষিত হয়েছে ওয়ালটন।
সমুদ্রে মৎস্য আহরণে পুঁজির ঝুঁকি নিতে হবে সরকারকে

দেশের মৎস্য খাতে বিশাল সম্ভাবনা গভীর সমুদ্র। অথচ মৎস্য উৎপাদনে মাত্র সাত লাখ টন আসে সমুদ্র থেকে এ খাতের চ্যালেঞ্জ ও করণীয় নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন র্যানকন গ্রুপের সি-ফিশিং ডিভিশনের সিইও তানভীর শাহরিয়ার রিমন।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের সমুদ্রে ও গভীর সমুদ্রে মৎস্য খাতের সম্ভাবনা কেমন?
তানভীর শাহরিয়ার রিমন: বর্তমানে দেশে বছরে প্রায় ৪৫ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপন্ন হয়, যার মাত্র সাত লাখ টন আসে সমুদ্র থেকে। অথচ পরিসংখ্যান বলে, সাগরে সাত মিলিয়ন টন মাছ আছে। সেই হিসাবে প্রাকৃতিক উৎপাদনের বিপরীতে আহরণ মাত্র ১০ শতাংশ। বর্তমানে আমাদের সামুদ্রিক জলসীমায় আমরা যে মাছ আহরণ করি তার প্রায় ৭০ শতাংশ মাছই হলো মাইগ্রেন্ট ফিশ যেমন-চাপিলা, কলম্বো, চন্দনা, আইলা ইত্যাদি। এই খাতে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে-এসব মাছ যদি কখনো হারিয়ে যায় বা আমাদের জলসীমায় যদি না আসে তাহলে আমাদের দেশের বাণিজ্যিক মিড ওয়াটার ট্রলারগুলো যথেষ্ট হুমকির মুখে পড়বে। এ জন্য সাগরের ইকো সিস্টেম ঠিক রাখতে সমন্বিত উদ্যোগে কাজ করতে হবে আমাদের। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭১ সালে আমাদের সমুদ্রে ৪৭৫টি মাছের প্রজাতি ছিল, এখন তা নেমে এসেছে ৩৯৪টিতে। এর পেছনে আছে অপরিণত মাছ ধরা, অতিরিক্ত আহরণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং দূষণ। এসব বিষয়েও সতর্ক হতে হবে।
প্রশ্ন: গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার বাস্তব চিত্র কী?
তানভীর শাহরিয়ার রিমন: আমাদের সমুদ্রসীমা ও ইইজেড (এক্সক্লুসিভ অর্থনৈতিক অঞ্চল) যথেষ্ট বড়। কিন্তু বাস্তব চিত্র হলো, ১০ মিটার গভীরতায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ, ১০ থেকে ৪০ মিটারে জেলেরা কাঠের নৌকা দিয়ে মাছ ধরেন, আর ৪০ মিটার থেকে তার অধিক এলাকায় শিল্পভিত্তিক ট্রলার চলে। বর্তমানে দেশে প্রায় ২০০টি শিল্প ট্রলার ও ৬৮ হাজার ছোট নৌকা আছে। সমস্যা হলো, অনেক জেলে অনুমোদিত সীমা অতিক্রম করে শিল্প ট্রলারের এলাকায় চলে আসেন এবং অবৈধ জাল ব্যবহার করেন, যা ইকোসিস্টেমের জন্য হুমকি। এটি রোধে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ দরকার। আমাদের সমুদ্র এলাকার মোট পরিমাণ ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার, যার প্রায় চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় আমাদের দেশের জাহাজগুলো মৎস্য আহরণ করে থাকে, তা ছাড়া আমাদের সামুদ্রিক জলসীমায় প্রায় আশির দশকের দিকে দেশি এবং বিদেশি ব্যবস্থাপনায় সার্ভে করে কয়েকটি ফিশিং গ্রাউন্ড সৃষ্টি করা হয়, আশির দশকের পর আর কোনো নতুন ফিশিং গ্রাউন্ড তৈরি হয়নি। তাই সময় এসেছে আবার সার্ভে করে নতুন নতুন ফিশিং গ্রাউন্ড তৈরি করার, অন্যথায় ভবিষ্যতে আমাদের সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
প্রশ্ন: নীতিগত ও প্রশাসনিক বাধাগুলো কী কী?
তানভীর শাহরিয়ার রিমন: জাহাজ প্রতিস্থাপন ও মালিকানা পরিবর্তন সহজীকরণ প্রয়োজন, আইইউইউ ফিশিং মনিটরিং আরো জোরদার করা প্রয়োজন, চড়া ব্যাংক সুদের হার এই খাতের জন্য অযৌক্তিক। ব্যাংক ভর্তুকি ও নীতিগত সহায়তা বাড়ানো প্রয়োজন। তা ছাড়া নতুন মৎস্য নীতিমালা অনুযায়ী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে বটম ট্রলিং জাহাজগুলোকে প্রতিস্থাপন করে মিডওয়াটর ট্রলারে রূপান্তর করতে হবে। তাই প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া আরো সহজীকরণ করতে হবে। তা ছাড়া, লাইসেন্স বা মালিকানা পরিবর্তন প্রক্রিয়াও আরো সহজীকরণ করা প্রয়োজন।
প্রশ্ন: সরবরাহব্যবস্থায় প্রধান চ্যালেঞ্জ কী?
তানভীর শাহরিয়ার রিমন: বেশির ভাগ ট্রলার পুরনো, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব। দুই বছরে ডিজেলের দাম ৩২ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু মাছের দাম তেমন বাড়েনি। ভালো কোল্ড স্টোরেজের অভাব রয়েছে। নতুন মাছের প্রজাতি, মাছ ধরার এলাকা বা প্রযুক্তি- এই তিনটি বিষয়ে সরকারি উদ্যোগে গবেষণা অত্যন্ত প্রয়োজন।
প্রশ্ন: সম্প্রতি মৎস্য মন্ত্রণালয় ফিশিং ব্যান ৬৫ দিনের পরিবর্তে ৫৮ দিন করেছে। এতে ইতিবাচক কোনো দৃষ্টান্ত আছে?
তানভীর শাহরিয়ার রিমন: অবশ্যই, আমরা মনে করি এটা ভালো সিদ্ধান্ত হয়েছে। কৌশলগত এই সিদ্ধান্তে আমাদের মৎস্য খাত উপকৃত হবে। ফিশিং ব্যান প্রিওডে আর্টিসান বা বোটের নাবিকদের সরকার নানা রকম আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের বাণিজ্যিক ট্রলারের নাবিকদের ওই সময় তাঁদের বেতন, বোনাস, খাদ্য ভাতা ইত্যাদি দিতে চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়। তাই বাণিজ্যিক ট্রলারগুলোর নাবিকদেরও সরকারি উদ্যোগে প্রণোদনা দেওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া আমি মনে করি আমাদের ফিশিং ব্যানের সময়কালে ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধে ফ্লেক্সিবিলিটি থাকা প্রয়োজন। কারণ তখন আমাদের মৎস্য ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ থাকে।
প্রশ্ন: সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক জাহাজ সরাসরি ইউরোপে মাছ রপ্তানির অনুমতি পেয়েছে বলে আমরা জেনেছি, আপনাদের কোনো জাহাজ কি এই মানদণ্ডে পৌঁছতে পেরেছে?
তানভীর শাহরিয়ার রিমন: হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে সরাসরি জাহাজ থেকে ব্লক ফ্রোজেন মাছ রপ্তানির অনুমতি মিলেছে। সরাসরি জাহাজ থেকে ব্লক ফ্রোজেন মাছ এবং চিংড়ি ইউরোপের বাজারে রপ্তানির সুযোগ এই প্রথম এলো। মাত্র পাঁচটি জাহাজ এই অনুমতি পেয়েছে, যার মধ্যে আমাদের রয়েছে দুটি জাহাজ। আমাদের আরেকটি জাহাজ অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এখানে সরকারের সংস্থাগুলোর ভূমিকা ছিল ইতিবাচক। এতে আমাদের রপ্তানি বাজার বড় হবে। আন্তর্জাতিকমানে রপ্তানি সম্ভব হবে এবং বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হবেন।
প্রশ্ন: বিনিয়োগ আকর্ষণে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
তানভীর শাহরিয়ার রিমন: বিনিয়োগ আকর্ষণে লাইসেন্স প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ করতে হবে। আধুনিক বন্দর, কোল্ড চেইন ও লজিস্টিক হাব গড়ে তুলতে হবে। মাছের উৎস থেকে রপ্তানি পর্যন্ত ট্রেসেবিলিটি নিশ্চিত করতে হবে। পিপিপি মডেলে আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি ও দক্ষতা আমদানি করতে হবে। সরকারের উচিত পুঁজি ঝুঁকির কিছু অংশ ভাগ করে নেওয়া, এটা রপ্তানিতে সাবসিডি বাড়ানোর মাধ্যমে করা যায়। কিন্তু উল্টো এখন সাবসিডি কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে এবং চিংড়ি রপ্তানিতে সাবসিডি কমেছেও। এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। কারণ বৈশ্বিক চিংড়ির বাজারে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। চাষকৃত ভেনামি চিংড়ি রপ্তানিতে ভারত, ভিয়েতনাম, ইকুয়েডর অনেক এগিয়েছে। ভেনামির চাহিদাও বেড়েছে অনেক। ফলে আমাদের সাগর থেকে আহরণকৃত অর্গানিক চিংড়ির দাম বিশ্ববাজারে পড়ে গেছে। বলতে পারেন অর্ধেক হয়ে গেছে। এই অবস্থায় সামুদ্রিক চিংড়ি খাত বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখে আছে। তাই প্রণোদনা না কমিয়ে বিনিয়োগকারীদের পাশে থাকা উচিত। ওয়ান-স্টপ সার্ভিস, কর ছাড় ও সহজ শর্তে ঋণ প্রদান দরকার। এ ছাড়া আমি মনে করি, সাগরে মৎস্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় ফিশিং গ্রাউন্ড থেকে নানা রকম ক্ষতিকারক বর্জগুলো তুলে আনা প্রয়োজন।
রপ্তানিতে ঋণ খরচ কমাতে সুদহারে প্রণোদনা দরকার

রপ্তানি খাত বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবসার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রপ্তানি খাতে ব্যাংকের অর্থায়ন, সহায়তা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলেছেন শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ
প্রশ্ন: ব্যাংক ব্যবসায় রপ্তানি খাত কতটা গুরুত্ব বহন করে?
মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ: বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে রপ্তানি একটি মৌলিক চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত, যা জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আর্থিক স্থিতিশীলতায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। ব্যাংকগুলো রপ্তানি-সম্পর্কিত কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, বাণিজ্যিক সহায়তা এবং বৈদেশিক লেনদেন পরিচালনায় বিভিন্ন সেবা প্রদান করে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জোরদারে সহায়ক ভূমিকা রাখে। রপ্তানি খাত শুধু ব্যাংকের লাভজনক কার্যক্রম নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতির গতিপ্রবাহে প্রাণসঞ্চারকারী এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান। যেমন-বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত হিসেবে তৈরি পোশাক ব্যাংকিং খাতের নিবিড় সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। কাঁচামাল আমদানি থেকে শুরু করে রপ্তানি বিল সংগ্রহ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ব্যাংকগুলোর সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ ব্যাংকের আরোপ করা এলসি মার্জিন সার্কুলারের বিষয়ে আপনার মতামত কী?
মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ: বাংলাদেশ ব্যাংক লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) মার্জিন বৃদ্ধির মাধ্যমে কিছু পণ্যের আমদানিতে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। এ সিদ্ধান্তের মূল লক্ষ্য হলো অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করা, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুরক্ষা করা এবং সম্ভাব্য মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। স্বল্প মেয়াদে এ পদক্ষেপ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক হলেও, দীর্ঘ মেয়াদে এটির আমদানিনির্ভর ব্যবসা ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কিছু নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এই নীতির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। ব্যবসা ও শিল্প খাতের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত বিঘ্ন এড়াতে এবং অর্থনৈতিক গতিশীলতা বজায় রাখতে বেসরকারি খাতের সঙ্গে নিয়মিত সংলাপ ও স্বচ্ছ যোগাযোগ নিশ্চিত করাই হবে সময়োচিত পদক্ষেপ। সেটি করা হচ্ছে, এরই মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে শিথিল করা হয়েছে।
প্রশ্ন: দেশের আমদানি ও রপ্তানিতে পার্থক্যের কারণ ও সমাধান কী হতে পারে?
মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ: বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানির পরিমাণের মধ্যে বিরাট পার্থক্যের প্রধান কারণ হলো বাণিজ্য ঘাটতি, যেখানে আমদানির পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে রপ্তানিকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এই বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা একাধিক কাঠামোগত ও নীতিগত কারণ দ্বারা প্রভাবিত। তা সমাধানে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। যেমন—রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ করতে হবে। ওষুধ, চামড়াজাত পণ্য, কৃষি পণ্য, আইটি এবং পাটজাত পণ্যের মতো খাতে রপ্তানির সম্প্রসারণ ত্বরান্বিত করতে হবে। ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পে বিনিয়োগ-তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল ও উপকরণ দেশেই উৎপাদনের মাধ্যমে আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে। এ ছাড়া বাজার সম্প্রসারণসহ আরো নানা পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
প্রশ্ন: নীতিগতভাবে সরকার কী করতে পারে?
মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ: বাংলাদেশে বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস এবং রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক নীতিগত ও কাঠামোগত সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে সরকার। শুল্ক সংস্কার, রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের রপ্তানি সক্ষমতা বাড়ানোর নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ সরকার আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত শুল্ক ও অশুল্ক বাধা হ্রাসে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। ব্যাবসায়িক খরচ কমাতে এবং রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে শুল্ক কাঠামো পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে; নির্দিষ্ট পণ্যে শূন্য শুল্ক সুবিধা দেওয়া হয়েছে; শুল্ক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনতে ডিজিটাল ও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে।
প্রশ্ন: ট্রাম্পের শুল্কনীতি বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার ও ব্যাংক ব্যবসায় কেমন প্রভাব ফেলবে?
মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ: ট্রাম্প প্রশাসনের পারস্পরিক শুল্কনীতির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি রপ্তানির ওপর প্রস্তাবিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। বাংলাদেশের রপ্তানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে এর গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এই সিদ্ধান্ত শুধু রপ্তানি প্রবাহকে বিঘ্নিত করবে না, বরং ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতেও নেতিবাচক চাপ তৈরি করবে।
প্রশ্ন: ব্যাংকঋণের সুদহার বৃদ্ধি পেলে রপ্তানিতে কী ধরনের প্রভাব পড়ে?
মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ: ব্যাংকঋণে সুদের হার বৃদ্ধি পেলে রপ্তানিকারকদের ঋণ গ্রহণের খরচ বৃদ্ধি পায়, যা রপ্তানি প্রতিযোগিতা এবং পরিমাণ হ্রাসের কারণ হতে পারে। এই প্রভাব প্রশমিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ভর্তুকিযুক্ত রপ্তানি ঋণ, বিকল্প অর্থায়নের ব্যবস্থা সম্প্রসারণ এবং রপ্তানি প্রবৃদ্ধির জন্য একটি স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করার মতো লক্ষ্যভিত্তিক হস্তক্ষেপ বিবেচনা করতে পারে। উচ্চ সুদের হার রপ্তানিমুখী শিল্পে বিনিয়োগ কমিয়ে দিতে পারে, কারণ মূলধন ব্যয় বেড়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ বিলম্বিত হয়। এ ছাড়া সুদের হার পরিবর্তন বিনিময় হারের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, যা রপ্তানির প্রতিযোগিতাকে প্রভাবিত করে। যেমন—উচ্চ সুদের হার বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করলে স্থানীয় মুদ্রার মূল্য বেড়ে যায় এবং রপ্তানি পণ্য আরো দামি হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন: এ ক্ষেত্রে করণীয় কী হতে পারে?
মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ: বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য ভর্তুকিযুক্ত সুদের হার প্রণোদনা দিতে পারে, যা রপ্তানিকারকদের ঋণ খরচ কমিয়ে তাঁদের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান শক্ত করবে। যেমন- মার্কিন ডলারে ইডিএফ সুবিধা পূর্বের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া। বিকল্প অর্থায়নের প্রচার- রপ্তানি ফ্যাক্টরিং, ফোরফাইটিংয়ের মতো বিকল্প অর্থায়ন ব্যবস্থা উৎসাহিত করতে হবে, যা ঐতিহ্যবাহী ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরতা কমাবে। এ ছাড়া মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং পূর্বাভাসযোগ্য বিনিময় হার নিশ্চিত করে একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখা জরুরি, যা রপ্তানিকারকদের পরিকল্পনা ও বিনিয়োগে সহায়ক হবে। সর্বোপরি রপ্তানি খাতে সুদের হার ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে মুদ্রানীতিতে প্রয়োজনীয় সমন্বয় করা যেতে পারে।
সহায়তা পেলে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্য রপ্তানি কয়েক গুণ বাড়বে

বর্তমানে দেশের কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য বিশ্বের ১৪৮টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এই খাতের সম্ভাবনা ও নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলেছেন প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ইলিয়াছ মৃধা।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য শিল্পের সম্ভাবনা কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
ইলিয়াছ মৃধা: বাংলাদেশের কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। এটি অনেকটাই প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে খরচ বেড়ে যায়। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়ে থাকে কৃষিকাজ করে। গ্রামীণ অর্থনীতিকে সহযোগিতা এবং বেকার ও নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হলে অবশ্যই কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পের দিকে নজর দিতে হবে। এই শিল্পের স্থানীয় বাজার বড় করতে পারলেই রপ্তানি বাজার বড় হবে।
প্রশ্ন: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই খাতে রপ্তানি আয়ে কী ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে?
ইলিয়াছ মৃধা: বিশ্ববাজারে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে কয়েক বছর ধরে অনেক ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যে আমাদের পড়তে হচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ পরিস্থিতি, দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং ট্রাম্প প্রশাসনের বাড়তি শুল্ক আরোপে রপ্তানি বাণিজ্য হোঁচট খেয়েছে। এর পরও আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আমরা নতুন নতুন বাজার খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছি। আমরা এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কমিউনিটিকে টার্গেট করেই পণ্য রপ্তানি করব। আমরা সেভাবেই পণ্যের ডিজাইন, প্রাইসিং, গুণগত মান উন্নত করার দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি, যাতে আমরা মূলধারার বাজারে প্রবেশ করতে পারি। সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি।
প্রশ্ন: প্রাণ গ্রুপ বর্তমানে কতটি দেশে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি করছে?
ইলিয়াছ মৃধা: বর্তমানে আমরা ১৪৮টি দেশে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি করছি। বিশেষত উপসাগরীয় দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করছি। আগে ভারতে সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি হতো।
প্রশ্ন: আন্তর্জাতিক বাজারে গুণগত মান ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রাণ কী ধরনের মান নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অনুসরণ করে?
ইলিয়াছ মৃধা: রপ্তানি করতে হলে অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের পণ্য উৎপাদন করতে হবে। তাই বিশ্বের সর্বশেষ প্রযুক্তির সরঞ্জাম আমরা বাংলাদেশে নিয়ে আসছি। বিভিন্ন দেশ থেকে দক্ষ লোকজন এনে আমাদের কর্মীদের দক্ষ করছি, যেন আমরা আন্তর্জাতিক মানের পণ্য রপ্তানি করতে পারি।
প্রশ্ন: বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় কোন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন?
ইলিয়াছ মৃধা: আমাদের দেশ থেকে পণ্য রপ্তানি করলে ১২০ দিনের মধ্যে ফরেন কারেন্সি আনতে হয়, এখন দেখা যাচ্ছে একটি পণ্য উৎপাদন করে যখন রপ্তানি করছি সে দেশে পৌঁছাতেই আড়াই থেকে তিন মাস চলে যাচ্ছে। সাধারণত সে দেশে যাওয়ার পর রপ্তানিকারক পণ্য বিক্রি করে টাকা দেবে। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টাকাটি আসছে না। ফলে এখানে ‘ওভারডিউ’ হয়ে যাচ্ছে আড়াই থেকে তিন মাস। আমি সরকারকে বলব, ১২০ দিনের পরিবর্তে অন্তত ১৮০ দিন যাতে বিবেচনা করা হয়।
প্রশ্ন: রপ্তানি উপযোগী প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরিতে মান নিয়ন্ত্রণ ও সার্টিফিকেশন নিয়ে কী ধরনের জটিলতা আছে?
ইলিয়াছ মৃধা: আমাদের দেশে সার্টিফিকেশন সংস্থা নেই, ফলে আমাদের বিদেশি কনসালট্যান্ট বা বিদেশি এজেন্সির ওপর নির্ভর করতে হয়। এটি আমাদের জন্য ব্যয়বহুল। যদি সরকারের কোনো সংস্থার মাধ্যমে এই ফ্যাসিলিটিগুলো দেওয়া হতো তাহলে আমরা খুবই কম খরচে এগুলো নিতে পারতাম।
প্রশ্ন: সরকার কী ধরনের সহায়তা দিচ্ছে এই খাতকে এগিয়ে নিতে?
ইলিয়াছ মৃধা: সরকার প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি খাতের জন্য আলাদা করে কোনো সহায়তা দিচ্ছে না। রপ্তানিতে আগে নগদ সহায়তা ছিল ২০ শতাংশ, সেটি নামিয়ে এখন ১০ শতাংশে নিয়ে এসেছে। এ ছাড়া আমাদের প্রণোদনা হিসেবে বছরে সম্মানসূচক রপ্তানি ট্রফি দেওয়া হয়। এটি পেয়ে আমরা অনুপ্রাণিত হই। তবে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বিভিন্ন জায়গায় রপ্তানি মেলার আয়োজন করছে। এসব মেলায় আমরাও অংশগ্রহণ করছি। এতে দেশের পণ্যের প্রচার ও প্রসার ঘটছে। নতুন নতুন বাজার উন্মোচন করতে সক্ষম হচ্ছি।
প্রশ্ন: এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে কী ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার?
ইলিয়াছ মৃধা: বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ভ্যাট-ট্যাক্স সুবিধা ও নিরবচ্ছিন্ন পানি, গ্যাস-বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের বিনিয়োগের নিশ্চয়তা দিতে হবে। এখন আমরা যখন নতুন প্রজেক্ট করতে যাচ্ছি তারা আমাদের বাংলাদেশে রাজনৈতিক সরকার না আসা পর্যন্ত ঋণ সহায়তা দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছে। তাই আমাদের দেশে অতিদ্রুত রাজনৈতিক সরকার আসা উচিত।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ কি কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বড় কোনো মাইলফলক ছুঁতে পারবে?
ইলিয়াছ মৃধা: এরই মধ্যে কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছুঁয়েছে। যদিও তা পোশাক খাতের তুলনায় খুবই অল্প। এই খাতকে উৎসাহিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে যদি সহযোগিতা করা হয় তাহলে আগামী কয়েক বছরেই এই খাতের রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে।
প্রশ্ন: ভবিষ্যতে প্রাণ গ্রুপের রপ্তানি সম্প্রসারণের পরিকল্পনা কী?
ইলিয়াছ মৃধা: আমরা প্রতিনিয়তই নতুন নতুন পণ্য যুক্ত করছি। আমরা আগামী দিনগুলোকে লক্ষ্য করে বিশ্বমানের কনফেকশনারি পণ্য, বিস্কুট ইত্যাদি উৎপাদন করছি। এগুলোর রপ্তানির বাজার প্রচুর উন্মুক্ত। আমরা যদি এখানে আরো কাজ করি তাহলে রপ্তানির দ্বার আরো উন্মোচিত হবে। আমাদের রপ্তানির হার আরো কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।
প্রশ্ন: ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার এবং অর্থনৈতিক স্থবিরতায় বিনিয়োগের পরিবেশ কেমন দেখছেন?
ইলিয়াছ মৃধা: বর্তমানে ব্যাংকঋণের সুদের হার ১৪-১৫ শতাংশে উঠে গেছে। পাশের দেশে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিট। আসিয়ান দেশগুলোতে সুদের হার মাত্র ৪-৫ শতাংশ। ফলে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় যদি টিকে থাকতে চাই তাহলে অবশ্যই আমাদের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটের মধ্যে রাখতে হবে।
সৌজন্যে - কালের কণ্ঠ।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ

এনসিপির গাড়িবহরে ফের নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের হামলা, রণক্ষেত্র গোপালগঞ্জ
৩ ঘণ্টা আগে | রাজনীতি

মুজিববাদীরা মুক্তিযুদ্ধকে কলুষিত করেছে, গোপালগঞ্জকেও কলুষিত করেছে: নাহিদ ইসলাম
৪ ঘণ্টা আগে | রাজনীতি