শুক্রবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৪ ০০:০০ টা

রসুল (সা.)-এর বিদায় হজ

মাওলানা আবদুর রশিদ

রসুল (সা.)-এর বিদায় হজ

হিজরি দশম সনে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজব্রত পালনের সিদ্ধান্ত নেন। এ উদ্দেশ্যে হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি লক্ষাধিক মুসলমান সমভিব্যহারে মক্কায় রওনা হন। এটাই তাঁর জীবনের শেষ হজব্রত পালন এবং এ জন্যই একে হুজ্জাতুল বেদা বা বিদায় হজ বলা হয়। এ সময় তাঁর সব বিবি তাঁর সঙ্গী হলেন। হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিনায় কোরবানি দেওয়ার জন্য একশত প্রাণী সঙ্গে নিলেন।

হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধুলহুলায়ফা নামক স্থানে পৌঁছে রাতযাপন করলেন। পর দিন তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা হজের পোশাক বা ইহ্রাম পরিধান করলেন। একাদশ দিনে তিনি পবিত্র মক্কা শহরে প্রবেশ করলেন। মক্কায় পৌঁছে তিনি কাবাগৃহের দিকে রওনা হলেন। কাবাগৃহে এসে সাতবার তিনি এ গৃহের চতুর্দিক প্রদক্ষিণ করলেন। এরপর মোকামে ইব্রাহিম নামক স্থানে প্রার্থনা করলেন। অতঃপর তিনি সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝখানে সাতবার দৌড়ালেন। যেসব সঙ্গীর সঙ্গে কোরবানি করার মতো কোনো প্রাণী ছিল না, তারা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশে মাথা নেড়া করলেন। জিলহজের অষ্টম দিনে হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা ছেড়ে মিনায় গেলেন এবং সেখানে রাতযাপন করলেন। সকালে নামাজান্তে তিনি কাসওয়া নামক উটে আরোহণ করে তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে আরাফাতের দিকে অগ্রসর হলেন। হজ সম্পন্ন করে তিনি আরাফাত পাহাড়ের চূড়ার উপর দাঁড়িয়ে সমবেত মুসলমানদের লক্ষ্য করে খুতবা দিলেন। এটাই ছিল তাঁর সর্বশেষ খুতবা বা উপদেশ বাণী। এ খুতবার মাধ্যমে তিনি একটি আদর্শ মুসলিম সমাজের চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরলেন। শ্রোতৃমণ্ডলীকে তিনি অজ্ঞতার যুগের শ্রেণিবৈষম্য, নারী ও দাসদের প্রতি অন্যায়-অবিচার, ধনী মহাজনদের দ্বারা সাধারণ লোকের শোষণ-নির্যাতন, প্রাচীন রীতিনীতি প্রভৃতি অসামাজিক কার্যকলাপের মূলে কুঠারাঘাত করার আহ্বান জানালেন।

খুতবার প্রারম্ভে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে মহান প্রতিপালক আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন। অতঃপর জনমণ্ডলীকে উদ্দেশ করে বললেন-

'হে জনগণ। আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ কর; কারণ বুঝতে পারছি না যে, আগামী বছর আমি তোমাদের সঙ্গে এখানে মিলিত হতে পারব কিনা।' 'সাবধান, ধর্ম সম্বন্ধে বাড়াবাড়ি করো না। এ বাড়াবাড়ির ফলে তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।'

'হে লোকসকল, স্মরণ রেখ, তোমাদের আল্লাহ এক, তোমাদের (আদি) পিতা এক। হুঁশিয়ার! কোনো আরবের ওপর অনারবের যেমন প্রাধান্য নেই, তেমনি অনারবের ওপর আরবেরও কোনো প্রাধান্য নেই; কোনো শ্বেতাঙ্গের ওপর যেমন কৃষ্ণাঙ্গের প্রাধান্য নেই, তেমনি কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গেরও কোনো প্রাধান্য নেই, পরস্পরের মাপকাঠি হচ্ছে একমাত্র খোদাভীতি বা সৎকর্ম।'

'হে আমার ভক্তবৃন্দ, তোমাদের স্ত্রীদের ওপর তোমাদের যেরূপ অধিকার আছে, তোমাদের ওপরও তাদের সেরূপ অধিকার রয়েছে। তোমরা স্বীয় পত্নীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করো। নিশ্চয়ই আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তোমরা তাদের গ্রহণ করেছ এবং তাঁরই আদেশ মতো তাদের তোমাদের জন্য বৈধ করে নিয়েছ।' 'দাস-দাসীদের প্রতি সর্বদা সদয় ব্যবহার করো। তোমরা যা খাবে, তাদের তা-ই খাওয়াবে, যা পরবে, তাই পরাবে। যদি তারা কোনো অন্যায় করে এবং তা যদি তোমাদের নিকট অমার্জনীয় হয়, তবে তোমরা তাদের পরিত্যাগ কর; কিন্তু তাদের সঙ্গে কর্কশ ব্যবহার কর না, কারণ তারাও আল্লাহর সৃষ্টি এবং তোমাদেরই মতো মানুষ।'

'এ দিন ও এ মাস যেরূপ সবার জন্য পবিত্র, সেরূপ তোমাদের জীবন ও সম্পত্তি মহাপ্রভুর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পূর্ব পর্যন্ত পরস্পরের নিকট পবিত্র ও হস্তক্ষেপের অনুপযুক্ত।

'স্মরণ রেখ, তোমাদের একদিন আল্লাহর নিকট হাজির হতে হবে এবং তিনি তোমাদের নিকট তোমাদের কাজের হিসাব চাইবেন।'

'অন্ধকার যুগের সব রক্ত (অর্থাৎ প্রতিশোধগ্রহণীয় রক্ত) বাতিল করা হলো। আর সর্বপ্রথমে আমি আমার বংশের রাবিয়া ইবনে হারেসের রক্ত বাতিল ঘোষণা করলাম।

'অন্ধকার যুগের সব সুদ বাতিল ঘোষণা করা হলো। সবার আগে আমাদের গোত্রের আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের সব সুদ আজ আমিই রহিত করে দিলাম।'

'হে জনমণ্ডলী, আমার বাক্য শ্রবণ কর এবং তা বুঝতে চেষ্টা কর। জেনে রাখ, সব মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। তোমরা একই ভ্রাতৃমণ্ডলীর অন্তর্ভুক্ত। অনুমতি ব্যতীত কেউ কারও কোনো কিছু জোর করে নিতে পারবে না।' 'তোমাদের পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহর কালাম (কোরআন শরিফ) এবং তাঁর প্রেরিত রসুলের চরিত্রাদর্শ (হাদিস) রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা এগুলোর অনুশীলন করবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।' ভাষণের শেষ পর্যায়ে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের মূল বুনিয়াদ সম্পর্কে পুনরায় তাগিদ দিয়ে বলেন : 'তোমরা তোমাদের পরওয়ারদিগারের ইবাদত করবে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে, রমজানে রোজা রাখবে এবং আমি যা নির্দেশ দিয়েছি তা পালন করতে থাকবে। এর দ্বারা তোমরা তোমাদের পরওয়ারদিগারের জান্নাতে প্রবেশ করবে।'

এ পর্যন্ত বলার পর হজরত রসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঊর্ধ্বে দৃষ্টিপাত করে বললেন, 'হে প্রভু! আমি কি তোমার বাণী জনগণের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি?' জনতা সমবেত কণ্ঠে জবাব দিল, 'হ্যাঁ, আপনি আমাদের নিকট সব কথা পৌঁছে দিয়েছেন।'

জনতার জবাব শুনে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চোখেমুখে তৃপ্তির আভাস দেখা দিল; আকাশের দিকে মুখ তুলে তিনি আবেগজড়িত কণ্ঠে তিনবার বলে উঠলেন, 'হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক।' এ সময় তাঁর নিকট অহী নাজিল হলো :

'হে মুহাম্মদ, আজ আমি তোমার ধর্মকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমার উপর আমার নিয়ামত পূর্ণ করে দিলাম। ইসলামকে তোমার ধর্ম বলে মনোনীত করলাম। (সূরা মায়দা)

হজরতের কণ্ঠ পুনরায় গম্ভীর হয়ে উঠল। তিনি সবাইকে উদ্দেশ করে বললেন :

'আমার এ বাণী আজ যারা উপস্থিত আছ তারা, যারা উপস্থিত নেই তাদের নিকট পৌঁছে দেবে। উপস্থিত ব্যক্তিদের অপেক্ষা অনুপস্থিত লোকরাই আমার উপদেশ অধিক স্মরণ রাখতে সক্ষম হবে।'

লেখক : ইসলামী গবেষক।

 

 

 

সর্বশেষ খবর