রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ব্যক্তি নয়, ন্যায্যতার পাশে দাঁড়ান

প্রভাষ আমিন

ব্যক্তি নয়, ন্যায্যতার পাশে দাঁড়ান

বাংলাদেশ একটি বিভক্ত রাষ্ট্র। ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সবাই বিভক্ত। চারদিকে বিভক্তি আর অসহিষ্ণুতা। আওয়ামী লীগ বিএনপিকে সহ্য করতে পারে না, বিএনপি জাসদকে সহ্য করতে পারে না। কথায় কথায় ডাক্তারদের সঙ্গে সাংবাদিকদের লেগে যায়। র‌্যাবের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয় পুলিশ। পুলিশ সুযোগ পেলে সাংবাদিকদের পিটিয়ে দেয়। ধর্মীয় সংখ্যাগুরুরা সুযোগ পেলেই সংখ্যালঘুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ক্ষমতাশালীরা দুর্বলদের ওপর অত্যাচার করে। ধনীরা দরিদ্রদের শোষণ করে। এরকম নানামুখী বিভক্তি, বৈষম্য আমাদের বারবার দুর্বল করে, আরও দুর্বল করে। আমাদের চারপাশে নিরাপত্তাহীনতার মিহিন চাদর বিছানো। এই নিরাপত্তাহীনতা বোধ থেকেই আমরা সংগঠিত হই; কখনো দলের ব্যানারে, কখনো ধর্মের আবরণে, কখনো পেশার দোহাই দিয়ে। বহুমুখী বিভক্তির মধ্যে এই সংগঠিত হওয়ার, একত্রিত হওয়ার প্রবণতা অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু সমস্যাটা হয় তখন; যখন আমরা দলে-ধর্মে-পেশায় সংগঠিত হতে গিয়ে একমুখী হয়ে যাই, যুক্তি মানতে চাই না, প্রশ্ন করতে ভুলে যাই, আইন মানতে চাই না, নিজেকেই শ্রেষ্ঠ বলে মনে করি, বিবেক বন্ধক দিই সংগঠনের কাছে।

বাংলাদেশে দুর্ঘটনা ঘটালেও কোনো ট্রাক ড্রাইভারকে গ্রেফতার করা যায় না। গ্রেফতার করলেই ট্রাক ড্রাইভাররা ধর্মঘট করে সব অচল করে দিতে চান, অন্তত চেষ্টা করেন, হুমকি দেন। দোষ শুধু ট্রাক ড্রাইভারদের নয়, আমরা সব পেশার মানুষই মননে-আচরণে সংগঠিত ট্রাক ড্রাইভার। যৌক্তিক কারণে কোনো সাংবাদিককে গ্রেফতার করলেও আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বলে ক্ষেপে উঠি, রাস্তায় নেমে মানববন্ধন করি। যেন সাংবাদিকরা আইনের ঊর্ধ্বে, তারা যেন কোনো বেআইনি কাজ করতেই পারেন না। তাই সাংবাদিকরা সব সময় বুক ফুলিয়ে চলেন, কাউকে পরোয়া করেন না, আইন মানেন না। জানেন কেউ কিছু বললে, সাংবাদিকরা তার পাশে দাঁড়িয়ে যাবে, তোলপাড় হয়ে যাবে দেশজুড়ে। আবার উল্টো ঘটনাও ঘটে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাভার প্রতিনিধি নাজমুল হুদাকে গ্রেফতার করা হয় ভুল সংবাদ প্রচার করে গার্মেন্ট শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টির অভিযোগে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আনতে না পেরে তার বিরুদ্ধে এখন প্যান্ট চুরির মামলা দেওয়া হয়েছে। এটা অবশ্যই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ। শাহবাগে দায়িত্ব পালনের সময় পুলিশ পিটিয়ে শুইয়ে দিয়েছে এটিএন নিউজের দুই সাংবাদিককে।

নিজে সাংবাদিক বলেই প্রথম সাংবাদিকদের কথা বললাম। কিন্তু নিজের পেশার মানুষকে আইনের ঊর্ধ্বে থাকা ধোয়া তুলসী পাতা মনে করার এই প্রবণতা সব পেশার মানুষের মধ্যেই আছে। কোনো ডাক্তার ভুল চিকিৎসা করলে অভিযোগও করা যায় না, মামলা করা তো অনেক পরের কথা। ডাক্তাররা এমনভাবে প্রতিক্রিয়া দেখান, যেন তারা কখনই ভুল চিকিৎসা করেন না, আর করলেও তার কোনো বিচার করা যাবে না। ডাক্তাররাও ট্রাক ড্রাইভারদের মতো ধর্মঘট করে অচল করে দেন হাসপাতাল। পুলিশের অন্যায় চাপা দিতে সবচেয়ে সক্রিয় থাকে পুলিশরাই। শাহবাগে পুলিশ দুই সাংবাদিকের ওপর বর্বর হামলা চালালেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাফাই গেয়ে বলছেন, ধাক্কাধাক্কি হয়েছে। গত সপ্তাহে মানব পাচার মামলায় গ্রেফতার হওয়া এক আইনজীবী দম্পতিকে জামিন না দেওয়ায় চট্টগ্রামের আদালতে আইন হাতে তুলে নেন আইনজীবীরাই। বিক্ষোভ-ভাঙচুর করে আইনজীবীরা আদালতের কাছ থেকে জামিন আদায় করে নেন। এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘আইনজীবীদের কাজ অপরাধীদের রক্ষা করা নয়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা।’

এই যে আমরা সমপেশার মানুষকে বাঁচাতে প্রয়োজনে আইন হাতে তুলে নিই, এটা কি পেশাদারিত্বের মধ্যে পড়ে? অথচ হওয়ার কথা উল্টো। মানুষ ফেরেশতা নয়, সব মানুষই ভুল করতে পারে, অপরাধ করতে পারে। পেশাজীবীরাও মানুষ। তারাও ভুল করতে পারেন, ভুল করেন। ব্যক্তি মানুষের তো বটেই, সব পেশার মানুষদেরই কিছু নীতি-নৈতিকতা, এথিক্স মেনে চলতে হয়। কেউ যদি ভুল কিছু করে, অপরাধ করে, এথিক্সের বাইরে কিছু করে; সবার আগে সেই পেশার মানুষদের তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া উচিত। নিজেদের পেশার ডিগনিটি বজায় রাখার স্বার্থেই সেই পেশার খারাপ মানুষটির শাস্তি চাওয়া উচিত, আইনে সোপর্দ করা উচিত। কেউ যদি ভুল করে, অন্যায় করে; সংগঠিত পেশাজীবীদের কারণে পার পেয়ে যায়, ভবিষ্যতে সে আবার একই ধরনের অপরাধ করবে, পেশার নাম ডোবাবে। তাই সাংবাদিকদের উচিত খারাপ সাংবাদিকদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া, ডাক্তারদের উচিত অদক্ষ ডাক্তারদের খুঁজে বের করে দূর করা, পুলিশের উচিত অসৎ পুলিশ নিবৃত করা, আইনজীবীদের উচিত অপরাধী আইনজীবীকে আইনের হাতে তুলে দেওয়া। কিন্তু আমরা সব সময় উল্টোটা করি। ভালো হোক, মন্দ হোক; নিজের পেশার মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে যাই। যেন সাংবাদিক, ডাক্তার, আইনজীবী তথা পেশাজীবীরা সব আইনের ঊর্ধ্বে।

সম্প্রতি মধ্যরাতে রাজধানীর বসুন্ধরা সিটির সামনে বেপরোয়া গতির প্রাইভেট কারের ধাক্কায় গুরুতর আহত হন মোটরসাইকেলে থাকা প্রথম আলোর প্রধান আলোকচিত্রী জিয়া ইসলাম। তাত্ক্ষণিকভাবে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে আইসিইউতে যমে-মানুষের টানাটানির পর তাকে নেওয়া হয় এ্যাপোলো হাসপাতালে। সেখানে অপারেশনের পর এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তাকে নেওয়া হয় সিঙ্গাপুরে। আপাতত তার প্রাণ সংশয় না থাকলেও তাকে সেরে উঠতে লম্বা ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তারপরও আগের সেই প্রাণচঞ্চল, সদা হাস্যোজ্জ্বল জিয়াকে ফিরে পাব কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে। তার আরও অনেক বন্ধু-স্বজনের মতো আমিও রাতভর দাঁড়িয়ে ছিলাম ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউর সামনে। যারা গিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই সাংবাদিক। শুরুতেই যেটা বলছিলাম, পেশাজীবীরা একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়ান। আমরাও সবাই জিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছি। এটা অন্যায় নয়। সবাই পাশে দাঁড়িয়েছে বলেই জিয়া বেঁচে থাকার সংগ্রাম করতে পারছে। কিন্তু আমরা যখন ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা ছাড়াই সম পেশার মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে যাই, তখন বিচ্যুতিটা ঘটে। এ ঘটনায়ও তা ঘটেছে।

মধ্যরাতে কোনো গাড়ি ধাক্কা দিয়েছে, তা বোঝার উপায় ছিল না। চালক সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির হেডলাইট নিভিয়ে দিয়েছিল বলে গাড়ির নম্বর প্লেটও দেখা যায়নি। কিন্তু বাসায় ফিরেই বোধহয় গাড়ির চালকের বিবেক জাগ্রত হয়। পত্রিকা-টেলিভিশন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে খবর পেয়ে তিনি ছুটে যান ঢাকা মেডিকেলে। আইসিইউতে গিয়ে তিনি জিয়াকে দেখে এসে নাকি বলেছেন, কিছু হবে না। সেখানে তিনি স্বীকার করেছেন, দুর্ঘটনাটি তিনিই ঘটিয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সেই ভদ্রলোক তখন মাতাল ছিলেন। মাতালদের বিবেক একটু বেশিই টনটনে থাকে। তাই হয়তো তিনি বোকার মতো হাসপাতালে গিয়ে স্বীকারোক্তি দিয়ে এসেছেন। আমরা জানতে পারি সেই চালকের নাম কল্যাণ কোড়াইয়া। তিনি একজন মডেল ও অভিনেতা। কিন্তু সকালেই মরে যায় তার রাতের বিবেক। সকালেই তিনি তার অপরাধ অস্বীকার করেন। সকালে তার দাবি, তিনি সে রাতে দুর্ঘটনা একটি ঘটিয়েছিলেন বটে, তবে সেটা বসুন্ধরা সিটির সামনে নয়, তেজগাঁও থানার সামনে। তার গাড়ির সঙ্গে মোটরসাইকেলের নয়, ট্রাকের ধাক্কা লেগেছিল। আর সেদিন রাতে তিনি জিয়াকে দেখতে নয়, তার অন্য দুর্ঘটনার রোগী নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। কল্যাণ কোড়াইয়া রাতে সত্য বলেছেন না সকালে বলেছেন, আমি জানি না। তিনি আদৌ দুর্ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন কিনা, তাও জানি না। তিনি গাড়ি চালানোর সময় মাতাল ছিলেন কিনা, আমি জানি না। প্রথম আলো মামলা করেছে। পুলিশ কল্যাণ কোড়াইয়াকে গ্রেফতার করেছে। আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কল্যাণ কোড়াইয়া জামিনও পেয়েছেন। আমার কোনো আপত্তি নেই। আর এটি একটি খুব সহজ মামলা। কল্যাণ কোড়াইয়া গাড়িটিও আছে, জিয়ার মোটরসাইকেলটিও আছে। একটা ছোট্ট পরীক্ষায়ই এটা প্রমাণ করা সম্ভব, যে সে রাতে এ দুটি গাড়ির মধ্যেই ধাক্কা লেগেছিল কিনা। আইন চলুক স্বাভাবিক গতিতে, তদন্তে প্রমাণিত হোক সত্য-মিথ্যা।

কিন্তু আমি অবাক হয়েছি, শিল্পী সমাজের ভূমিকায়। আমরা যেমন জিয়ার দুর্ঘটনার খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে গেছি, কল্যাণ কোড়াইয়াকে গ্রেফতারের খবর পেয়ে তার বন্ধু শিল্পীরা থানায় ছুটে গেছেন। খুব ভালো কথা। সম পেশার মানুষের প্রতি এই টান আমার দারুণ লাগে। বিপদে তো বন্ধুর পাশে দাঁড়াতেই হবে। কিন্তু বন্ধুর পাশে দাঁড়ানো আর অন্যায়ের পক্ষে সাফাই গাওয়া এক কথা নয়। বন্ধু বা স্বজনের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে আমরা ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, ভুল আর অপরাধের পার্থক্য ভুলে যাই। কল্যাণের বন্ধুদের থানায় যাওয়া পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু তার মুক্তির জন্য তদ্বির, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে যাওয়া আসলে আইনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা। আপনারা কল্যাণের জন্য সবচেয়ে ভালো আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেন। কিন্তু আইনকে তো উল্টো পথে চালানোর চেষ্টা করতে পারেন না। দুর্ঘটনার গল্প বানাতে পারেন না। থানা বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে গিয়েই ক্ষান্ত হননি কল্যাণের বন্ধুরা, তারা সামাজিক মাধ্যমে কল্যাণকে নির্দোষ দাবি করে, তার পক্ষে ব্যাপক ক্যাম্পেইন শুরু করেন। ক্যাম্পেইনের প্রথম দাবি ছিল, কল্যাণ নির্দোষ। তিনি সেদিন দুর্ঘটনা ঘটিয়েছেন বটে, তবে জিয়াকে নয়। তারপর তারা বলার চেষ্টা করলেন, কল্যাণ মাতাল ছিলেন না। তারপর তারা বলার চেষ্টা করলেন, সবাই মদ খেয়ে গাড়ি চালান। মদ খেয়ে গাড়ি না চালালে নাকি রাতে ১০ ভাগের বেশি গাড়ি চলবে না। কল্যাণকে বাঁচাতে গিয়ে তার বন্ধু শিল্পীদের এই হাস্যকর চেষ্টা দেখে আমি চমকে যাই। শিল্পীরা দেশের সবচেয়ে সচেতন ও সম্মানিত পেশাজীবী। দেশের কোটি কোটি মানুষ তাদের অনুসরণ করে, ভালোবাসে। কিন্তু এই ভালোবাসা তো তাদের যা খুশি তাই করার লাইসেন্স দেয় না। শিল্পীদের এমন আচরণ করতে হবে, যা দেখে সাধারণ মানুষ শিখবে। মানুষ শুধু শিল্পীদের নয়, তাদের আচরণও অনুসরণ করবে। কিন্তু কল্যাণের ঘটনা থেকে মানুষ কী শিখবে? কল্যাণের বন্ধু শিল্পীদের কাছ থেকে কী শিখবে? তাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে মদ খেয়ে গাড়ি চালানো এবং অ্যাক্সিডেন্ট করা কোনো ব্যাপারই নয়। কিন্তু আমরা সবাই ভারতের সঞ্জয় দত্ত ও সালমান খানের কথা জানি। বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও অন্যায় করে তারা পার পাননি।

শিল্পীদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি, বাংলাদেশে লাইসেন্স ছাড়া মদ খাওয়া ও গাড়ি চালানো, দুটিই বেআইনি। তবে ড্রাইভিং লাইসেন্স মানেই কিন্তু বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে কাউকে আঘাত করার লাইসেন্স নয়, তেমনি মদ খাওয়ার লাইসেন্স থাকা মানেই মাতলামি করা বা মাতাল হয়ে গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটানোর অধিকার নয়। প্রতিদিন বাংলাদেশে দুর্ঘটনা হয়, মানুষ মারা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারার সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছর। এটা নিয়ে আমরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছি। কিন্তু সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীরাই ঘাতক ড্রাইভারদের পক্ষে দাঁড়িয়ে যান। বিষয়টা এতই হাস্যকর। আপনি যদি কাউকে গুলি করে মারেন, আপনার ফাঁসি হবে। আর সেই লোককেই যদি আপনি গাড়ি চাপা দিয়ে মারেন, আপনার সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড হবে। তাও যদি ধরা পড়েন। কল্যাণকে ধন্যবাদ। তিনি বিবেকের তাড়নায় স্বেচ্ছায় হাসপাতালে গিয়ে দায় স্বীকার করেছেন বলেই তাকে ধরা গেছে। হুট করে, অবহেলায়, খামখেয়ালিপনায় দুর্ঘটনা বা অপরাধ ঘটে যেতে পারে। মহত্ত্ব হলো অনুশোচনা করে সেই অপরাধের দায় কাঁধে তুলে নেওয়ায়। কাউকে গাড়ি চাপায় হত্যা করলে তিন বছর কারাদণ্ড হতে পারে। আমাদের সবার ভালোবাসায় জিয়া বেঁচে আছে। তাই ন্যায়বিচার হলেও কল্যাণের খুব বড় কোনো সাজা হবে না। জিয়া গুরুতর আহত হওয়ায় আমাদের খুব খারাপ লেগেছে, কিন্তু আইনের স্বাভাবিক ধারায় কল্যাণ জামিন পেয়েছেন। আমার আপত্তি নেই। জিয়ার জন্য আমার অনেক খারাপ লাগছে। কিন্তু আমিও কল্যাণের ন্যায়বিচার চাই।

কল্যাণের বন্ধুরা যেভাবে তার পাশে দাঁড়ানোর নামে আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানোর চেষ্টা করছিলেন, যেভাবে ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য ঘুচিয়ে দিতে চেয়েছিলেন; তা খুবই দৃষ্টিকটু, অশোভন। আমি কথা দিচ্ছি, এ ঘটনায় যদি জিয়া অপরাধী হতেন, আর কল্যাণ ভিকটিম হতেন; আমি কিন্তু জিয়াকে অন্যায়ভাবে বাঁচানোর চেষ্টা করতাম না। হয়তো থানায় গিয়ে বসে থাকতাম। তার জন্য আইনজীবী নিয়োগের চেষ্টা করতাম। কিন্তু আদালতের বাইরে তাকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করতাম না। শাহবাগে দুই সাংবাদিককে পুলিশ পিটিয়েছে। যদি সেই দুই সাংবাদিক অন্যায় বা বেআইনি কিছু করতেন, আমি অবশ্যই তাদের সে অন্যায় ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করতাম না।

পেশার সহকর্মী, দলের সহকর্মী, সমধর্ম বা সমগোত্র— এভাবে বিবেচনা না করে মানুষকে বিবেচনা করতে হবে মানুষ হিসেবে। তার ন্যায়-অন্যায়, ভুল-অপরাধের দায় তার একার। একজন ব্যক্তির অপরাধের দায় আড়াল করার চেষ্টা করা মানে আপনার পেশাকে, আপনার ধর্মকে, আপনার গোত্রকে হেয় করা। বরং আপনারই উচিত খুঁজে খুঁজে আপনার পাশের অপরাধীকে সংশোধন করা বা আইনের কাছে পাঠানো। নইলে এই অপরাধী বারবার আপনার পেশাকে কলঙ্কিত করবে। এই যে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার বিভিন্ন বাহিনীর ২৫ জন দণ্ড পেল, তাতে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। সবাই দেখেছে বাহিনীগুলো তাদের সহকর্মীর অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়নি, তারা অন্যায়ের পাশে দাঁড়ায়নি। অন্যায় ধামাচাপা দিলে বাহিনী বা পেশা কারও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় না।

ধর্মস্বার্থ, পেশাস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ দেখতে দেখতে আমরা মানুষ হিসেবে বারবার ছোট হয়ে যাই। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হলে যখন শুধু হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ প্রতিবাদ করে, মানববন্ধন করে; আমি মানুষ হিসেবে খাটো হয়ে যাই। সাংবাদিকদের ওপর অন্যায় হলে যখন খালি সাংবাদিকরা প্রতিবাদ করেন, আমি লজ্জা পাই। আমি যেমন শাহবাগে সাংবাদিকদের ওপর হামলার নিন্দা করেছি, তেমনি প্রতিবাদকারী মানুষের ওপর পুলিশি নির্যাতনেরও প্রতিবাদ জানিয়েছি। আমাদের সবারই উচিত ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে ন্যায়ের পাশে দাঁড়ানো। আমাদের দাঁড়াতে হবে আইনের পাশে, কোনো ব্যক্তি অপরাধীর পাশে নয়; তিনি যেই হোন। সব কিছুর ঊর্ধ্বে মানবতা।

লেখক : সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর