বৃহস্পতিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

৩২ নম্বর কিংবা টুঙ্গিপাড়ায় কবিতাংশের পাঠ একই হওয়া দরকার

ড. শেখ আবদুস সালাম

৩২ নম্বর কিংবা টুঙ্গিপাড়ায় কবিতাংশের পাঠ একই হওয়া দরকার

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিষ্ঠুর ও আকস্মিক প্রয়াণে একদিকে কিছু মানুষের উল্লাস-উচ্ছ্বাস, অন্যদিকে সিংহভাগ সাধারণ মানুষের ঘটনার আকস্মিকতায় থমকে গিয়ে অনেকটা যেন দিশাহারা হয়ে প্রায় বাকহীন হয়ে পড়ার দৃশ্য এখনো আমাদের অনেকের স্মৃতিতে পরিষ্কারভাবে ভেসে বেড়ায়। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর সেদিন আমি প্রথম শুনতে পাই খুলনার ফুলবাড়ী গেট এলাকায় সকাল ৭টা-৮টার দিকে। ফুলবাড়ী গেট এলাকার নিস্তব্ধতাই সেদিন জানান দিচ্ছিল যে, দেশে অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটে গেছে। আমি তখন খুলনার দৌলতপুর সরকারি বি এল কলেজে অর্থনীতি বিষয়ে অনার্সের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আমি যথারীতি সেদিন কলেজ ক্যাম্পাসে যাই। সেখানের দৃশ্যপটও ছিল ভিন্ন। সর্বত্র যেন এক অস্থির স্তব্ধতা নেমে এসেছিল। জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু এসব অভিধা দূরে থাক; দিন দিন সে সময় শেখ মুজিব নামের উচ্চারণও যেন এক নিষিদ্ধ বিষয়ে পরিণত হতে বসেছিল। একটি দেশের যিনি স্রষ্টা তাঁর মৃত্যুর পরপর তৎকালীন ক্ষমতা দখলকারীদের প্রথম কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে চিরতরে মুছে ফেলা।

আমরা তখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া তরুণ। ব্যক্তিগতভাবে ছাত্রজীবনে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ এবং যৎসামান্য সংশ্লি­ষ্টতা থাকলেও সেভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো পদ-পদবি আমার ছিল না। তখন বি এল কলেজে বিপ্ল­বী ছাত্র ইউনিয়ন ও জাসদ ছাত্রলীগের দাপট ছিল খুব; কিন্তু আমার সখ্য ছিল ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে। বিশেষ করে সে সময়ের খুলনার ছাত্রনেতা ফিরোজ আহমেদ, মানিক সাহা, বয়রার শেখ আবু জাফর, দৌলতপুরের শেখ মনিরুজ্জামান (আজ তারা সবাই প্রয়াত), রায় রমেশ, মজিবুর রহমান তাদের নিষ্ঠা, শ্রম এবং কমিটমেন্ট আমাকে তাদের কাছাকাছি যেতে এবং তাদের সঙ্গে এক ধরনের ব্যক্তি সম্পর্ক তৈরি করতে উৎসাহ জুগিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আগস্ট, সেপ্টেম্বর মাসও প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোথাও সেদিন শেখ মুজিব নামের উচ্চারণ শুনতে পাচ্ছিলাম না। দিন দিন মনের ভিতর এক অদ্ভুত অস্থিরতা তৈরি হচ্ছিল। শেখ মুজিব এমনকি মোটা দাগে দেশের রাজনীতি-সমাজনীতি নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ একেবারেই কমে আসছিল।

সে সময় ফুলবাড়ী গেট যশোর রোডের ওপর একটি ছোট প্রিন্টিং প্রেস ছিল, নাম বনলতা প্রিন্টিং প্রেস। প্রেসটির মালিক ছিলেন ফরিদপুরের বোয়ালমারীর এক সজ্জন ব্যক্তি সিরাজুল ইসলাম। ভদ্রলোক ছিলেন মনেপ্রাণে বঙ্গবন্ধুর এক অন্ধভক্ত (অথচ রাজনীতিতে অংশগ্রহণহীন)। এই প্রেসের ম্যানেজার মো. হানিফ, কারিগর মো. সেকেল সবাই ছিলেন গোপালগঞ্জ এলাকার মানুষ- আওয়ামী লীগের রাজনীতি এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুগত ও শ্রদ্ধাশীল। একপর্যায়ে এদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে সখ্য তৈরি হয়। চা-শিঙ্গাড়া খাওয়া আর পত্রিকা পড়ার সুযোগ নিয়ে আমরা সকাল-বিকালে এই প্রেসে বসে একটু মন খুলে কথা বলার সুযোগ পেতাম কিন্তু সেখানে বিপদও ছিল। প্রেসটির পাশে ছিল একটি মাদ্রাসা এবং সে সময় প্রায়ই সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন প্রেসটিতে যাতায়াত করত। আমরা প্রেসে বসে নির্ভয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটু কথা বলে হালকা হব এমন অবাধ পরিস্থিতি তখন ছিল না। কারণ তখন সময়টা ছিল এমন যে খুনি সরকারের সমর্থক, পুলিশ, এমনকি আওয়ামী-বাকশালবিরোধী যে কোনো রাজনৈতিক শক্তির যে কেউ এমনকি জাসদ, ভাসানী ন্যাপের সমর্থক লোকজন এবং ওই ঘরানার ছাত্ররাও বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করার অপরাধে (!) যে কোনো লোককে হেনস্তা করতে পারত এবং তখন তারা তা করতও। এ বিষয়গুলো নিয়ে আমি আমার ‘বঙ্গবন্ধু ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ গ্রন্থে ‘১৫ আগস্টের পর খুলনায় যেভাবে বঙ্গবন্ধু পুনরাবির্ভূত হলেন’ এ শিরোনামে একটি প্রবন্ধে খানিকটা বিস্তারিত লিখেছি। আজ সেখান থেকেই কিছু ঘটনার উল্লেখ করে আমি আমার লেখার মূল শিরোনামে ফিরে যাব।

আজকের লেখার উদ্দেশ্য পাঠককে কেবল ওই সময়ের ঘটনা জানানো নয়, তখনকার পরিবেশ-পরিস্থিতির একটি ঝাপটা তাদের কাছে তুলে ধরাও। সে সময় সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্মম ওই হত্যার নিন্দা জানিয়ে একটি  লিফলেট তৈরি করেছিলাম। তা ছিল নিউজ প্রিন্টে এ-ফোর সাইজ কাগজে ছাপা। একদিন বিকালে দৌলতপুরে এসে আমার বন্ধু খুলনার তৎকালীন ছাত্রনেতা ফিরোজ আহমেদ ও শেখ আবু জাফর আমার সঙ্গে দেখা করে জানাল যে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করে কোথাও থেকে পোস্টার বা লিফলেট আকারে কিছু একটা ছাপানো যায় কিনা। আমি ফিরোজ আহমেদ ও শেখ আবু জাফরকে নিয়ে ওই সময় সিরাজ ভাইয়ের বনলতা প্রিন্টিং প্রেসে চলে গেলাম। সিরাজ ভাই যথারীতি চা-বিস্কুট আনিয়ে আপ্যায়ন করলেন। একপর্যায়ে রাজনীতির আলাপ থেকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের প্রতিবাদের বিষয়টি সামনে চলে এলো। আমরা আমাদের আসার উদ্দেশ্য তাকে খুলে বললাম। সিরাজ ভাই এক বাদামওয়ালার কাছ থেকে বাদাম কিনে আমাদের নিয়ে তার প্রেসের অদূরেই একটি সিনেমা হল ছিল সেই হলের সামনে দিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় আমাদের নিয়ে গেলেন। কারণ তিনি প্রেসে বসে এসব কথা বলতে সাহস পাচ্ছিলেন না। আমরা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলোচনা করলাম কীভাবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের একটা প্রতিবাদ করা যায় এবং এ ব্যাপারে সিরাজ ভাই কীভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারেন। একপর্যায়ে আলোচনা হলো কিছু পোস্টার প্রয়োজনে হাতে লিখে তা বি এল কলেজের দেয়ালে সেঁটে দেওয়া যায় কিনা? কিন্তু তাতে ভয় আছে, কারণ বিপ্ল­বী ছাত্র ইউনিয়ন ও জাসদ ছাত্রলীগের ছেলেরা সেখানে খুবই সক্রিয়। আর দিনে-রাতে কলেজ চত্বরে পুলিশ নিয়মিত টহল দেয়। এটা করতে গেলে ধরা পড়ে যেতে হবে। ওইদিনের মতো আলাপ শেষ। আমরা যে যার মতো চলে গেলাম।

এ ঘটনার দু-তিন দিন পর আবু জাফর আমাকে বলল বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে কিছু লিফলেট ছেপে একটু গেরিলা কায়দায় তা বিলি করলে কেমন হয়? তবে লিফলেটটি ছাপার দায়িত্ব নিতে হবে আমাকে। কারণ সিরাজ ভাইয়ের প্রেস আছে এবং তার সঙ্গে আমার খাতির বেশি। আমি এসে ওইদিন সিরাজ ভাইকে আমাদের ভাবনার কথাটি জানিয়ে তাকে একটি লিফলেট ছেপে দেওয়ার প্রস্তাব দিলাম। বললাম আপনার দায়িত্ব শুধু নিউজপ্রিন্ট কাগজে এক/দুই হাজার লিফলেট ছেপে দেওয়া। সিরাজ ভাই রাজি হলেন। বললেন ম্যাটার দিয়ে যান, গোপনে গোপনে সুবিধামতো সময়ে ছেপে দেব। কবে ছাপবেন তাও জানি না। তবে যেদিন এবং যখনই ছাপা শেষ হবে ঠিক তখনই এগুলো প্রেস থেকে নিয়ে যেতে হবে; প্রেসে ছাপা লিফলেট এক ঘণ্টাও রাখা যাবে না। কারণ গোয়েন্দারা সব সময় ওয়াচ রাখে। আমি পরদিন কলেজে গিয়ে ফিরোজ ও জাফরকে বিষয়টি বললাম। ফিরোজ লিফলেটটির ড্রাফট করার দায়িত্ব নিল। দুই দিন পর ড্রাফটটি আমাকে আর জাফরকে বুঝিয়ে দিল। আর বলল সম্ভব হলে লিফলেটের ওপরের এক কোনায় বঙ্গবন্ধুর একটি ছবি দেওয়া যায় কিনা। কৌশলগত কারণে লিফলেটটি ছাপানোর সময় কিংবা লিফলেট বহনকালে বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখেই যাতে তা কেউ তৎক্ষণাৎ শনাক্ত করতে না পারে সে কারণে প্রেস মালিক লিফলেটে বঙ্গবন্ধুর কোনো ছবি ছাপতে রাজি হলেন না। আমরাও তার সঙ্গে তখন সহমত পোষণ করি। যতদূর মনে পড়ে ওই লিফলেটে আমরা সম্ভবত আলাদা কোনো হেডলাইন করিনি। তবে লিফলেটটা শুরু করেছিলাম অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘যতকাল রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরী, যমুনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’ এই পঙ্ক্তিমালা দিয়ে। লিফলেটটির বিষয়বস্তু ছিল নৃশংসভাবে বঙ্গবন্ধুর শহীদ হওয়ার ঘটনাা নিন্দা করা, খুনিদের প্রতিরোধ করা, বিচার করা ইত্যাদি। এসব ছিল লিফলেটের আধেয়। লিফলেটটি ছাপা হয়ে যাওয়ার পর এটি আমরা ঝুঁকি নিয়ে এক বিশেষ কৌশলে বিতরণ করেছিলাম। মানিক সাহা তখন খুলনা শহরের এক জনপ্রিয় ছাত্রনেতা। মানিক ও ফিরোজ বলল, লিফলেট কলেজে কলেজে গিয়ে হাতে হাতে বিতরণ করা যাবে না। এটি করতে হবে খুলনার একটা গ্রুপ দৌলতপুর-খালিশপুর এসে এবং দৌলতপুরের একটা গ্রুপ খুলনায় গিয়ে সিনেমা হলগুলোয় যখন ম্যাটিনি বা সন্ধ্যা শোর বিরতি হবে ঠিক তখন একই দিনে একই সময়ে সম্ভাব্য সব সিনেমা হলের ওপরের (দোতলা বা তিন তলা) কোনো একটি জায়গা থেকে লিফলেটগুলো নিচে ছুড়ে ফেলতে হবে এবং যারা (গ্রুপে দুজন করে) কাজটি করবে তারা সঙ্গে সঙ্গে অন্য দর্শক কিংবা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যাবে। এজন্য যারা লিফলেট থ্রো করবে তারাও নির্দিষ্ট শোটির জন্য টিকিট কেটে কাছে রাখবে যাতে কোনোভাবে ধরা পড়লে বলা যাবে যে, আমরাও সিনেমা দেখতে এসেছিলাম।

ব্যস, এভাবেই সিদ্ধান্ত হলো যে, নির্দিষ্ট তারিখে এক সন্ধ্যাতেই সান্ধ্যকালীন শোর বিরতির সময় দৌলতপুর মীনাক্ষি হল, খালিশপুরের চিত্রালী হল, বয়রায় বৈকালী হল ও খুলনায় পিকচার প্যালেসে কাজটি করতে হবে। ফিরোজ আহমেদ তখন দৌলতপুরের শেখ মনিরুজ্জামান (একসময় খুলনা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ও পরে শ্রমিক নেতা) ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে বৈকালী ও চিত্রালী হলের দায়িত্ব তাকে দিয়ে এলো। মনির ভাই দায়িত্ব নিলেন যে, আনসার ফ্লাওয়ার মিল বা অন্য কোনো জায়গা থেকে লোক দিয়ে ওই দুটি হলে লিফলেট থ্রোর কাজটি তিনি করাবেন। ফিরোজ আহমেদ নিজে এক প্যাকেট লিফলেট নিয়ে খুলনায় চলে গেল খুলনা শহরে অবস্থিত পিকচার প্যালেসে থ্রো করার জন্য। দৌলতপুর মীনাক্ষি হলের দায়িত্ব পড়ল জাফর ও আমার ওপর। সেনহাটির বাবলু, দিদার, শ্যামলসহ আরও দু-তিন জন আমাদের সঙ্গে ছিল। যথারীতি নির্দিষ্ট সন্ধ্যায় খুলনা, বয়রা, দৌলতপুর ও খালিশপুরে নির্দিষ্ট চারটি সিনেমা হলে লিফলেটগুলো থ্রো করা হলো এবং তা নির্বিঘেœই ঘটল। পরদিন বি এল কলেজসহ খুলনা, খালিশপুর সর্বত্র লিফলেট থ্রোর এ ঘটনা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। আমরা ব্যাপারটি নিয়ে খুবই পুলকিত হলাম। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা আর সহানুভূতিশীল বহু মানুষের মধ্যে এ ঘটনাটি বেশ নাড়া দিয়েছিল। লিফলেটটির শুরুতে অন্নদাশঙ্কর রায়ের পঙ্ক্তিমালা সবাইকে যেন উদ্দীপ্ত করেছিল।

আমি এবং আমার পরিবার কয়েক বছর আগে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজারে গিয়েছিলাম। হঠাৎ করে আমার ছোট মেয়ে বঙ্গবন্ধুর মাজারের ঝরনার কাছে থাকা স্মৃতিফলকের একটি লেখার প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে জিজ্ঞাসা করে, আব্বু, বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ির স্মৃতিফলকে লেখা ‘যতকাল রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরী, যমুনা বহমান...’ কিন্তু এখানে (টুঙ্গিপাড়ায়) লেখা ‘যতকাল রবে পদ্মা, যমুনা, গৌরী, মেঘনা বহমান’ দুই জায়গায় দুই রকম লেখা কেন? পরে ঢাকায় ফিরে অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতা থেকে নিশ্চিত হয়ে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের দু-চার জনের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করেছিলাম। কিন্তু ফল তথৈবচ। এ বছর বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ১৫ আগস্টের অনুষ্ঠানমালার সম্প্রচার দেখছিলাম। যতদূর মনে পড়ে সময় টিভিতে টুঙ্গিপাড়ার ওই লেখাটি আবার চোখে পড়ল। সেখানে যতকাল রবে পদ্মা, যমুনা... লেখাটি প্রত্যক্ষ করলাম। আমি পরদিন বিষয়টি নিয়ে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য আমার ছাত্র নকিবের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। নকিব নিশ্চিতভাবে বলতে পারল না যে, টুঙ্গিপাড়ার স্মৃতিফলকে নির্দিষ্টভাবে কী শব্দমালায় লেখা আছে। অতঃপর ২৫ আগস্ট আমি টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজারে স্থাপিত লাইব্রেরিয়ান যোগেন্দ্রনাথ বাড়ৈর সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করলাম। তিনি আমাকে নিশ্চিত করলেন যে, বঙ্গবন্ধুর মাজারের ফলক স্তম্ভটিতে এখনো ‘যতকাল রবে পদ্মা, যমুনা, গৌরী, মেঘনা বহমান...’ লেখা রয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বরের কিছুদিন আগে কি পরে বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন। কবিতার চরণ ছিল চারটি- ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা/গৌরী মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার/শেখ মুজিবুর রহমান’ (অন্নদাশঙ্কর রায় স্মৃতিচারণা করেছেন ‘তারিখটা ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর)। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর কবিতাটি অসাধারণ হয়ে ওঠে এবং এর তাৎপর্য বিশেষ করে, ‘ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’ চরণটি অধিকতর বাঙময় হয়ে ওঠে। ’৭৬ সালের একুশে সামনে রেখে প্রতিবাদী গল্প-কবিতা প্রকাশ হতে শুরু করে। ’৭৮ সালের একুশের সংকলন ‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়’ সব মহলেই আলোড়ন সৃষ্টি করে। এতেই প্রথম প্রকাশিত হয় অন্নদাশঙ্কর রায়ের সেই চার লাইনের কবিতা আট লাইন হয়ে। ’৭৮ সালের এ সংকলনে প্রকাশিত কবিতার প্রথম চার লাইন হচ্ছে- ‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা/গৌরী যমুনা বহমান/ততদিন রবে কীর্তি তোমার/শেখ মুজিবুর রহমান’।

দেশের দেয়ালে দেয়ালে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়ে যে প্রচুর দেয়াললিখন চলতে থাকে তাতে কবিতাটির এই ভিন্ন ভিন্ন পাঠ চোখে পড়ে। ২০১০ সালে অন্নদাশঙ্কর রায়ের গ্রন্থ ‘কাঁদো প্রিয় দেশ’ অন্বেষা প্রকাশনী নামের একটি প্রকাশনা সংস্থা থেকে বাংলাদেশ সংস্করণ হিসেবে প্রকাশিত হয়। তাতে ‘প্রসঙ্গ কথা’ শিরোনামে একটি ভূমিকা রয়েছে। এতে লেখা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল ঘাতকের হাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নিহত হওয়ার খবরে অন্নদাশঙ্কর রায় ভীষণভাবে মর্মাহত হন, নিন্দাও জানান। তার পরই তিনি সেই বিখ্যাত কবিতাটি রচনা করেন যার প্রথম চার লাইন হচ্ছে- ‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা/গৌরী যমুনা বহমান/ততদিন রবে কীর্তি তোমার/শেখ মুজিবুর রহমান’। বঙ্গবন্ধুর বহু স্মৃতিবিজড়িত ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটি এখন জাদুঘর। এই জাদুঘরের দেয়ালঘেঁষে রাস্তার উল্টো দিকে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর একটি সুদৃশ্য ম্যুরাল। এই বিখ্যাত কবিতাটি এখানেও খোদিত হয়ে রয়েছে। কিন্তু সেখানে লেখা রয়েছে- ‘যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা/গৌরী যমুনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার/শেখ মুজিবুর রহমান’।

লেখক ও গবেষক মোহাম্মদ হাননান এ বিষয়টি নিয়ে ‘একটি কবিতার শুদ্ধ পাঠ’ শিরোনামে ৩১ আগস্ট, ২০১৩ সালে দৈনিক প্রথম আলোয় একটি চমৎকার লেখা লিখেছিলেন। আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুর মাজারের স্মৃতিফলক কিংবা ঢাকার ৩২ নম্বরের স্মৃতিফলক অথবা অন্য যে কোনো জায়গায় স্থাপিত ফলক যেখানে অন্নদাশঙ্কর রায়ের এ কবিতাংশ লেখা রয়েছে সেসব জায়গায় অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতার একটি পাঠ গ্রহণ করে সর্বত্র সেটাই বিধৃত থাকা উচিত এবং তার শব্দমালাও এক হওয়া উচিত। আশা করি সংশ্লিষ্টজনেরা বিষয়টির প্রতি নজর দেবেন।

লেখক : অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর