তদন্তাধীন মামলার বিচার প্রক্রিয়া পুরোপুরি পুলিশি বিষয় নয় যে, পুলিশকে সংবাদ সম্মেলন ডেকে মামলা বিশেষের গুণাগুণ তুলে ধরতে হবে। অভিযুক্তদের কাকে কাকে গ্রেফতার করা হলো ফৌজদারি মামলায় সেটা জানার আগ্রহ থাকতে পারে সাধারণ মানুষের। কিন্তু সুবিচারের স্বার্থে অপরাধ সম্পর্কে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সংবাদ সম্মেলন ডেকে ফাঁস করে উৎসাহ দেওয়াটা মোটেই সমীচীন হতে পারে না। পুলিশের হেফাজতে আটক থাকা অবস্থায় আসামির আইনজীবীর অনুপস্থিতিতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করাটা কেবল বিপজ্জনকই নয় শাসনতন্ত্রেরও লঙ্ঘন। দেখা যাচ্ছে, আমাদের আদালতসমূহ বিচার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে যতটা উদার অভিযুক্তের স্বাধীনতা ও সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় ততটাই সংকীর্ণ।
আমাদের পুলিশের কাছ থেকে এখনো আমরা প্রত্যাশা করি যে তারা আইন ও সুবিচারের দাবিকে বিবেচনায় রেখে দায়িত্ব পালন করবেন, কারণ এখনো তারা একটা গণতান্ত্রিক সংবিধানের অধীনে থেকে কাজ করছেন। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির সত্যতা বিচারিক আদালতের মাধ্যমেই কেবল প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় আদায়কৃত স্বীকারোক্তি, যদিও একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লেখা হয়, বিষয়টি এদেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বিবেচ্য বিষয় হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় তারা নীরবতা অবলম্বন করে চলেছেন। একজন নারীকে অসহায়ভাবে পুলিশের হেফাজতে পাঠানো এবং পুরুষ পুলিশ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদ করানোর বিষয়টি নারী অধিকার নিয়ে বড় বড় কথা বলতে অভ্যস্ত সংস্থাসমূহের কাছে ঘোরতর আপত্তির বিষয় হওয়ার দাবি রাখে।এ ব্যাপারেও সত্য হচ্ছে, আমাদের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বেশিরভাগের কার্যক্রম পরিচালিত হয় বিদেশি অর্থে ও উৎসাহে। মনে হচ্ছে তারা আগে দেখে তাদের নিজেদের নিরাপত্তা। সরকারের মতিগতি বুঝে তারা মানবাধিকার কিংবা নারী অধিকার নিয়ে লম্বা লম্বা কথা বলে থাকেন। এরকম অনেক মানবাধিকার সংস্থা কার্যত মানবাধিকার লঙ্ঘনের পথকে সহজ করে দিয়েছে। ভোটাধিকার নিয়ে এসব সংস্থার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। অথচ ভোটাধিকার না থাকলে মানবাধিকারও নিরাপদ থাকে না। আমাদের এমন এক সংকটজনক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে যেখানে রাজনীতিই কেবল ভালো ব্যবসা নয়, মানবাধিকার সংগঠনগুলোও চমৎকার ব্যবসা করে যাচ্ছে।
আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় বরগুনার একটি আদালত তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে পাঁচ দিনের পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। মিন্নি বরগুনা সরকারি ডিগ্রি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সিরাজুল ইসলাম গাজীর আদালতে এই রিমান্ড প্রার্থনা করেন।
গত ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে সংঘটিত রিফাত হত্যা মামলার প্রধান প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হচ্ছে মিন্নি। রিফাত শরীফ ২৫ বছর বয়সী একজন ইন্টারনেট প্রোভাইডার, যাকে একদল যুবক সংঘবদ্ধভাবে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে। ঘটনার একটা ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, যাতে দেখা যায় মিন্নি তার স্বামীকে আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু তার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। অন্যরা ভয়ে মেয়েটিকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। তারা যে অসহায় দর্শকের ভূমিকায় ছিল তাও টেলিভিশনের পর্দায় পরিস্ফুট হয়েছে। দুর্বৃত্তদের কর্মকান্ড সমাজকে কত অসহায় করেছে ভাবতেও কষ্ট হয়।
মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর বলেন, তার মেয়ে পুলিশের একটানা ১১ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তিনি আদালতে তার মেয়ের জামিন প্রার্থনা করে বৃহস্পতিবার আবেদন করেন। কিন্তু তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা হুমায়ুন তার দাবি নাকচ করে দিয়ে বলেন, মিন্নিকে গ্রেফতার করা হয়েছে কারণ, এ হত্যা মামলায় পুলিশ তার সম্পৃক্ততা পেয়েছে। এত সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকতে পুলিশ তত্ত্বাবধানে নিয়ে মিন্নির কাছ থেকে একাকী অবিশ্বাস্য ও বিতর্কিত স্বীকারোক্তি আদায়ের প্রয়োজন ছিল না। এখনো আমাদের পাবলিক সার্ভেন্টসরা মনে করেন তারা সরকারের অনুগত চাকর। নিজেদের ব্যক্তিত্বহীন, অস্তিত্বহীন করতে অসুবিধা হয় না। ওপর থেকে যা বলা হবে তাই করতে হবে। আইন প্রয়োগকারীদের এ ধরনের ভাবমূর্তি সুবিচারের জন্য মোটেও কাম্য নয়।
প্রকৃত ঘটনা যা-ই হোক না কেন, এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে মিন্নির সম্পৃক্ততা আছে কী নেই, সে দোষী না নির্দোষ সেই বিতর্ক বিচারের জন্য তোলা থাক। কোর্ট তো তাকে জামিনে মুক্তি দিয়ে কিছুটা সমবেদনা দেখাতে পারত। জামিনের ব্যাপারে মেয়েদের প্রতি সদয় হওয়া আইনেরও বাধ্যবাধকতা আছে। সবাই মিলে নিষ্ঠুরতাকে প্রশ্রয় দেব- তা সভ্য লোকদের আচরণ হতে পারে না। আমার বক্তব্য হচ্ছে পুলিশের রিমান্ড সংস্কৃতি বন্ধ হতে হবে। আইনজীবীদের এড়িয়ে নাগরিকদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করার এ অমানবিক পদ্ধতির অবশ্যই অবসান হওয়া দরকার।
মামলার বাদী এবং নিহত রিফাতের পিতা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ অবিলম্বে মিন্নিকে গ্রেফতারের দাবি জানান। তিনি অভিযোগ করেন যে, এ হত্যাকান্ডে মিন্নির হাত আছে। তিনি আরও দাবি করেন, মিন্নি তার ছেলেকে বিয়ে করার আগে আমার ছেলের অন্যতম হত্যাকারী সাব্বির হোসেন নয়ন ওরফে নয়ন বন্ডের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু তার পরিবার এ বিষয়টি গোপন রাখে। জনাব হালিম এসব কথা সংবাদ সম্মেলন ডেকে বলেন।
বিয়ের ইতি টানার জন্য স্থানীয় খুনিচক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মিন্নি খুন খারাবির মতো ভয়ঙ্কর খেলায় অংশ নিয়েছিল এমন কথা বলার মধ্যে কোনো বিচার-বিবেচনার গন্ধ মেলে না। শান্তিপূর্ণভাবেই সে তার স্বামীকে দিয়েই বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য চাপ দিতে পারত। তাই অনুগ্রহ করে গোটা সমাজকে বোকা বানাবেন না, এভাবে সভ্য সমাজের বিনাশ ঘটাবেন না। আমাদের নিবেদন থাকবে, রাজনীতির কারণে বিচার ব্যবস্থাকে ক্ষমতাসীনদের কুক্ষিগত কোনো প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবেন না। বিচার ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা সর্বতোভাবে ধ্বংস করবেন না।
রিফাত শরীফের হত্যাকান্ডের সঙ্গে শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তির সম্পৃক্ততা রয়েছে, এ কথা অনস্বীকার্য। আমরা এটাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে আজ যারা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তাদেরও আইনের আশ্রয় প্রয়োজন হবে, কিন্তু তখন পরিচ্ছন্ন বিচার ব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকবে না। ক্ষমতার অন্ধত্ব অনেককেই বুঝতে দিচ্ছে না যে, আইনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টির ভয়াবহ পরিণাম তাদেরও মোকাবিলা করতে হবে। অশুভ শক্তির প্রশ্রয় সবার জন্যই বিপজ্জনক।
সরকারদলীয় বাহিনীর লোকেরা এমন সন্ত্রাসী অবস্থার সৃষ্টি করছে যে স্বামীহারা মিন্নির পক্ষে স্থানীয় আইনজীবীরা দাঁড়াতে সাহস পাচ্ছেন না। শেষ পর্যন্ত ঢাকা থেকে আইনজীবীরা মিন্নির পক্ষে তাকে আইনি সহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছেন। আমি তাদের মোবারকবাদ জানাই।
আইনি সাহায্য পাওয়া যে কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তির শাসনতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার। স্বাধীন দেশের সরকার হয়েও এ বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। মানুষের জীবনের মূল্য বেশি না দুর্বৃত্তদের রক্ষা করা বেশি জরুরি, সরকারকে এটাও ভাবতে হবে।
বহুদিন ধরেই আমরা সতর্কবাণী উচ্চারণ করে আসছি যে, হত্যা, খুন ও গুমের রাজনীতি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নেতৃত্বের দূরদর্শিতা থাকলে জনগণকে অসহায় রাখার কথা ভাবা যেত না। স্থানীয় ক্ষমতাসীন নেতারা ও পুলিশ মিলে একে অপরের যোগসাজশে নিজেদের এলাকায় তান্টব চালিয়ে যাচ্ছে। এরকম অবস্থায় অসহায় নারী ও শিশুরা পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না। শিশুদের গলাকাটা লাশ পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশও সত্য-মিথ্যা মামলা দিয়ে যাচ্ছে। আইন ও বিচার ব্যবস্থায় নিরপেক্ষতা অক্ষুণ্ন না থাকায় পুলিশও জনগণ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। জনগণ আইন হাতে নিয়ে গণপিটুনির বিচার করতে নেমে গেছে।
কোনো কোনো পন্ডিত ব্যক্তি গা বাঁচিয়ে সরকারের ভ্রান্ত রাজনীতিকে দোষারোপ না করে সমাজকেই দোষ দিচ্ছে। সমাজে মূল্যবোধের অভাব, মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি ঘটেছে বলছে। আসলে নীতি-মূল্যবোধের রাজনীতি না থাকায় রাজনীতির কারণেই সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে।
মানুষের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে হলে নীতি-আদর্শহীন বা মূল্যবোধের অবক্ষয়ের রাজনীতির অবসান ঘটাতে হবে।
সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাওয়া জনবিচ্ছিন্ন সরকারের পক্ষে বিপন্ন জাতিকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। সে পথ তাদের জানাও নেই। দেশকে রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্য করা হয়েছে। আমাদের শিক্ষিত শ্রেণির সুবিধাবাদী বিশ্বাসঘাতক চরিত্রের কথা ঐতিহাসিকভাবেই স্বীকৃত।
তবুও দেশকে বিপদমুক্ত করতে এগিয়ে আসতে হবে দেশপ্রেমিক শিক্ষিত সমাজকেই।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।