শুক্রবার, ৯ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

মুসলিম বিশ্বের উদ্দেশে দেওয়া হোক আরাফা দিবসের ভাষণ

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

মুসলিম বিশ্বের উদ্দেশে দেওয়া হোক আরাফা দিবসের ভাষণ

গভীর সংকট পার করছে মুসলিম বিশ্ব। পৃথিবীর কোনো ভূখন্ডেই স্বস্তিতে নেই, শান্তিতে নেই মুসলমান। যারা মুসলমানদের নিয়ে ভাবে, ইসলামের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য যারা ব্যাকুল হয়ে চেষ্টা করছে, তারাও সফল হচ্ছে না। অনেকে হয়তো এর কারণ হিসেবে ইসলামবিরোধীদের সক্রিয় ও কৌশলী কার্যপ্রণালির কথা বলবেন। খালি চোখে তাই মনে হয়। ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করতে, মুসলমানদের শেষ করতে ইসলামবিরোধী শক্তি সত্যিই আজ বদ্ধপরিকর। কোনোভাবেই ইসলাম ও মুসলমানদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেওয়া যাবে না- এ ব্যাপারে ওদের কোনো দ্বিমত নেই। আর এ কাজে তারা যে পুরোপুরি সফল, তা অস্বীকার করলে সত্য অস্বীকার করা হবে।

তবে কোরআন বলছে, ওরা ঐক্যবদ্ধ কিংবা কৌশলের কারণে সফল হয়নি, সফল হয়েছে মুসলমানদের অনৈক্যের জন্য। সূরা বাকারাহ, আলে ইমরানসহ শেষের আরও কয়েকটি সূরায় আল্লাহতায়ালা বার বার মুসলমানদের সতর্ক করে বলেছেন, ‘যখনই তোমরা ঐক্য হারিয়ে ফেলবে, বিভিন্ন দল-উপদল, মাজহাব-ফেরকায় বিভক্ত হয়ে পড়বে, তখনই তোমাদের পতন নিশ্চিত মনে রেখ।’ হায়! মুসলমানদের মাঝে আজ ঐক্য নেই। ফলে কোথাও কোথাও তারা সাময়িক সফল হলেও সে সফলতা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারছে না। বহু রক্তের বিনিময়ে যে ইসলামী ইমারত গড়ে ওঠে, অনৈক্যের কারণে বাতিলের এক ফুঁয়েই তা মিইয়ে যায় চোখের পলকেরও আগে।

মুসলিম বিশ্বের আধুনিক নেতা মাহাথির মোহাম্মদ মনে করেন, অনৈক্যের এ সমস্যার সুন্দর সমাধান হতে পারত প্রতি বছর অনুষ্ঠিত মুসলিম ভ্রাতৃত্বের মিলনমেলা হজের মাধ্যমে। হজ তো শুধু কিছু অনুষ্ঠানসর্বস্ব কাজের নাম নয়। হজ হলো, এক মুমিন আরেক মুমিনের ভাই- কোরআনের এ কথার বাস্তব প্রশিক্ষণ। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যত মুসলমান আছে সবাই আপন ভাইয়ের মতো। হজের ময়দানে আসা প্রত্যেক হাজী এক হয়ে এ সিদ্ধান্ত নেবে, বিশ্বের কোথাও একজন মুসলমানের অধিকারও যদি ক্ষুণœ হয়, পুরো বিশ্বের মুসলমান একযোগে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-অবরোধে শরিক হবে। বিশ্বজুড়ে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে, যেন জুলুমবাজ রাষ্ট্র বা সংগঠন জুলুমের হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। বড় আফসোস করে মাহাথির মোহাম্মদ বলেন, হায়! আজ বিভিন্ন ভূখন্ডে মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে, মানবেতর জীবনযাপন করছে কিন্তু অন্যান্য মুসলমান জাতি দিব্বি হেসে-খেলে বেড়াচ্ছে। এসব মুসলমানদের দেখলে ভুলেও মনে হবে না তারই ভাই চরম কষ্টের জীবন কাটচ্ছে। এটা কেন হচ্ছে? কারণ, হজ মুসলমানদের মনে ভ্রাতৃত্বের অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে পারছে না।

বিশ্বভ্রাতৃত্ব গড়তে ব্যর্থ হওয়ার কারণ হলো, হজের ভাষণে মুসলিম ভ্রাতৃত্বের কথা থাকে না বললেই চলে। শুধু তাই নয়, আগামী এক বছরে মুসলিম বিশ্বের টার্গেট কী হবে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য কী কী কর্মসূচি নেওয়া যেতে পারে, ধনী রাষ্ট্রগুলো কীভাবে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোকে টেনে তুলবে, নির্যাতিত ভূখন্ডের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত হবে- এমন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর একটিও হজের ভাষণে উচ্চারিত হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের একজন প্রফেসর হাসতে হাসতে একবার আমাকে বলেছিলেন, মুসলমানরা যদি হজের ময়দান থেকে বিশ্বনেতৃত্বের টার্গেট নিতে পারত, তবে এত বিশালসংখ্যক হাজীর শপথ অনুষ্ঠান দেখেই তো বিশ্বের মোড়লরা কেঁপে উঠত। তার পরই একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন ওই অধ্যাপক। তিনি বলেন, হজের ভাষণে এখনো আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। প্রথমত, সৌদি সরকারের শিখিয়ে দেওয়া ভাষণটিই তোতা পাখির মতো আওড়ানো হয় আরাফায়। তাও শুধু আরবি ভাষাতেই...। এতে আরববিশ্ব থেকে আসা হাজী ছাড়া আর কেউই হজের ভাষণে কী বলা হলো তার ছিটেফোঁটাও বুঝতে পারে না। অথচ অনুবাদ প্রযুক্তি ব্যবহার করে খুব সহজেই প্রধান প্রধান ভাষায় হজের ভাষণের অনুবাদ তৎনগদ হাজীদের কানে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব আধুনিক সময়ে।

আমরা আশা করি, এবারের হজের ভাষণ মুসলিম উম্মাহর জন্য নতুন সূর্য ওঠাবে। যে সূর্য হবে ইসলামের সূর্য। সত্য ও ন্যায়ের সূর্য। যার আলোয় পৃথিবীর সব আঁধার ঘুচে যাবে। হে আল্লাহ! হজ কর্তৃপক্ষ যেন বিশ্ব মুসলিমের ব্যথা বুঝতে পারে, তাদের হƒদয়ে আপনি সে দরদ ঢেলে দিন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাস্সিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। চেয়ারম্যান : বাংলাদেশ মুফাস্সির সোসাইটি।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর