রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

এহরামের শুভ্রতা ধরে রাখতে হবে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

এহরামের শুভ্রতা ধরে রাখতে হবে

দীর্ঘ এক মাসের সফর শেষে হাজীরা দেশে ফিরছেন। হজ শেষে কাবার মেহমানরা বাড়ি আসছেন। কাবার মেহমানের মর্যাদা সম্পর্কে রসুল (সা.) বলেছেন, হাজী যখন হজ শেষ করে, তখন সে পুরোপুরি নিষ্পাপ শিশুর মতো হয়ে যায়। শিশুর যেমন গুনাহ নেই। একজন হাজীরও কোনো গুনাহ থাকে না। আরেক হাদিসে হুজুর পুরনূর (সা.) বলেছেন, কবুল হজের বিনিময় জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়। এই জান্নাতি মানুষগুলোকে যখন তোমরা দেখবে, তাদের সঙ্গে মুসাফা করবে। তাদের বলবে তোমাদের জন্য দোয়া করতে। কারণ, হাজীদের হাতে কাবার স্পর্শ মুখে কবুলিয়াতের ছোঁয়া লেগে থাকে। তারা যা স্পর্শ করবে, যে দোয়া করবে তাই কবুল হয়ে যাবে। (মিশকাতুল মাসাবিহ।)

হাজী মানেই অনন্য মানুষ। অন্যভাবে বলা যায়, দুনিয়ার বুকে ভাসমান জান্নাতি মানুষ। কারণ, হাজীই একমাত্র মানুষ, যিনি ইহরামের কাপড় গায়ে জড়িয়ে প্রভুকে বলে এসেছেন, লাব্বাইক। লাব্বাইক মানে হাজির। জীবনের সবক্ষেত্রে প্রভুকে হাজির জানার, হাজির মানার এক আশ্চর্য মন্ত্র লাব্বাইক। যিনি প্রভুকে হাজির জানতে পারেন, মানতে পারেন তার পক্ষে কখনোই গুনাহে জড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এই গুনাহহীন জীবনের পথ চলা শুরু হয় হজের মাধ্যমে। আর তাই হজের পুরস্কার জান্নাত ঘোষণা করেছেন নবীজি (সা.)। হজ মানে গুনাহহীন জীবনযাপন করা। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে কারা যেন উল্টো কথা রটিয়ে দিয়েছে, যত খুশি গুনাহ কর, হজে গিয়ে মাপ নাও। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মানুষ গুনাহ করে হজে যায়, হজ থেকে এসে আবারও বড় বড় গুনাহ করে। একজন পীরসাহেব তার বাইতুল্লাহ মুসাফির মুরিদদের উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেন, দেখো! তোমাদের দেশে মানুষ হজের উল্টো অর্থ করে নিয়েছে। ফলে কেউ যদি হজের আগে চোর থাকে, হজ করে এসে ডাকাত হয়। আবার হজে গিয়ে সব গুনাহ মাফ করিয়ে নেয়।

ওই পীর হুজুর বলেন, হে বাইতুল্লাহর মুসাফিররা! মনে রেখ, কাবার অলি-গলি ঘুরলেই হজ হয় না। হজ হলো ‘আর গুনাহ করব না’ এ শপথ করা। হজ শব্দের মানেই হচ্ছে, শপথ করা, পণ করা, ইচ্ছে করা। তোমরা হজে যাচ্ছ, শপথ করবে- হে আল্লাহ! এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের মায়া ভুলে আমরা এহরামের কাপড় গায়ে জড়িয়ে নিয়েছি। আমরা এখন আর এ দুনিয়ার মানুষ নই। আমরা জীবন্ত মুর্দা বা লাশ হয়ে গেছি। মৃত্যু পর্যন্ত যেন জীবন্ত মুর্দা হয়ে থাকতে পারি, সে তৌফিক তুমি আমাদের দাও। হজ শেষে যখন মুরিদরা ফিরে আসল, তখন আবার পীর সাহেব বললেন, বাবারা! দীর্ঘ সফর শেষে তোমরা দেশে ফিরেছ। তোমাদের শরীরে এখনো কাবার গন্ধ লেগে আছে। চোখে মুখে এহরামের শুভ্রতা চিক চিক করছে। এতদিন তোমরা প্রতীকী হজ করে এসেছ। এখন শুরু হলো আসল হজ। বাকি জীবনও যদি, শরীরে কাবার গন্ধ আর চোখে মুখে এহরামের শুভ্রতা ধরে রাখত পার, জীবনের সব ক্ষেত্রে এহরামের মতো সাদা-নির্ভেজাল-দুর্নীতিমুক্ত থাকতে পার, তাহলে মৃত্যুর সময় আল্লাহপাক তোমাকে ডেকে বলবেন- লাব্বাইক। বান্দারে তোর মাওলা হাজির। সারাটি জীবন তুই আমাকে লাব্বাইক বলেছিস। এখন থেকে অনন্ত সফরে আমি মাওলা তোকে লাব্বাইক বলব। লা খাওফুন আলাইহিম ওয়ালাহুম ইয়াহজানুন! তোর কোনো ভয় নেই, কোনো চিন্তাও নেই। আফসোস! এখনকার হাজীদের মধ্যে এহরামের শুভ্রতা ধরে রাখার কোনো সাধনা লক্ষ্য করা যায় না। হজ যে করে আর যে হজ করেনি, এ দুজনের জীবনযাপনে কোনো পার্থক্য থাকে না। বরং দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য, যে হজ করেনি তার হৃদয়ে যতটুকু আল্লাহর ভয় থাকে, কাবা ঘুরে আসা মানুষের মনে এরচেয়েও অনেক অনেক কম আল্লাহর ভয় কাজ করে। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কী হতে পারে। তা ছাড়া হজ কী, কীভাবে জীবনজুড়ে এহরামের শুভ্রতা ধরে রাখা যায়- এসব বলার মতো মুর্শিদ এখন আর কজন আছেন? তাই তো জাতির সামনে গভীর অন্ধকার নেমে এসেছে। হে আল্লাহ! এ বছর যতজন হজ করেছেন, সবাইকে আপনি হাজীর মতো জীবনযাপনের তৌফিক দিন। গোনাহ থেকে দূরে রাখুন। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে যেন এহরামের শুভ্রতা ধরে রাখতে পারে, সে তৌফিক দান করুন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর