শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ইংরেজদের রসবোধ

আতাউর রহমান

ইংরেজদের রসবোধ

পৃথিবীর প্রতিটি জাতিরই কিছু না কিছু স্বকীয় বৈশিষ্ট্য থাকে। তেমনিভাবে ইংরেজদের চরিত্রে আমার দেখামতে আপাতগাম্ভীর্য ও খানিকটা জাত্যাভিমান বিদ্যমান। ইংরেজি ভাষায় জেনফোবিয়া বলে একটা শব্দই আছে, যেটার অর্থ হচ্ছে বিদেশের প্রতি অহেতুক ভয় বা ঘৃণা। অধিকসংখ্যক ইংরেজই মনে করেন যে ওরা পৃথিবীতে পুরোদস্তুর সুসভ্য জাতি এবং পৃথিবীর অন্যান্য জাতি এটা বুঝতে প্রায়শই ভুল করে থাকে। ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে বসবাসরত ফরাসিদের কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল। ওদের চোখে নিকটতম প্রতিবেশী আইরিশরা বোকা ও স্কটিশরা হাড়কৃপন আর ওয়েলসদের মোটেই বিশ্বাস করা যায় না।

আইরিশদের নিয়ে ওরা গল্প বানিয়েছে : ‘প্যাডি ও মারফি দুই বন্ধু বাজার থেকে দুটো ঘোড়া কিনে নিয়ে এসেছে। আমাদের কার ঘোড়া কোনটা চিনব কী করে? প্যাডির এ প্রশ্নের উত্তরে মারফি বলল, একটার লেজ কেটে দেওয়া হোক। কিন্তু ভুলে দুটোরই লেজ কাটা হয়ে গেলে পর মারফি প্যাডিকে বলল, তুমি খয়েরি রঙেরটা নাও, আমি সাদা রঙেরটা নেব।’ অতঃপর স্কচদের কৃপণতার গল্প, ওটাও ইংরেজদের বানানো : ‘ম্যাকডোনাল্ড সাঁতার জানেন না বিধায় পানিতে পড়ে মারা যাচ্ছিলেন; একটি বাচ্চা ছেলে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে বাঁচাল। স্ত্রী ছেলেটিকে একটা পাউন্ড পুরস্কারস্বরূপ দিতে চাইলে তিনি বললেন, সে যখন আমাকে পানি থেকে টেনে তুলে তখন আমি অর্ধমৃত ছিলাম; তাকে ৫০ পেনিই (পাউন্ডের অর্ধেক) দাও।’আমাদের উপমহাদেশের লোকদের প্রতি ওদের মনোভাব মিশ্র আর অন্য ইউরোপিয়ানের প্রতি যে মনোভাব কী তা ব্রেক্সিট-সংক্রান্ত ব্যাপার থেকেই বিলক্ষণ বোঝা যায়। তবে অস্ট্রেলিয়ান, কানাডিয়ান ও আমেরিকানদের প্রতি ওদের একটি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব আছে, যদিও আমেরিকানদের দিকে একটি অভিযোগের অঙ্গুলি হচ্ছে এই যে, আমেরিকানরা ‘কিংস ইংলিশ’-এ ভেজাল মিশ্রিত করে ফেলেছে। এই যেমন- মোটরগাড়ির সামনের গ্লাসকে ইংরেজরা বলে ‘উইন্ড স্ক্রিন’ অথচ আমেরিকানরা ওটাকে বানিয়েছে ‘উইন্ড শিল্ড’ এবং এ নিয়ে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে আমেরিকান যখন বলল, আমরা মোটরগাড়ি আবিষ্কার করেছি ও আমরা বলি উইন্ড শিল্ড তখন ইংরেজনন্দন রেগেমেগে বললেন, সো হোয়াট? আমরা ইংরেজি ভাষাটা আবিষ্কার করেছি, সেটা স্মরণ রেখ। সে যাই হোক। পূর্বাহ্ণে বলা হয়েছে, ইংরেজরা আপাতদৃষ্টিতে গম্ভীর ও খুব ফরমাল। অপরিচিতদের সঙ্গে ওরা সহজে বাক্যালাপ করতে অনিচ্ছুক। অনেক আগে বিলেতে অবস্থানকালে ইংরেজি জোক্বুকে পড়েছিলাম : পরস্পর পরিচয়হীন ইংরেজ, আইরিশ, স্কটিশ ও আমেরিকান- এ চারজন লোক জাহাজডুবি হয়ে একটি দুর্গম অথচ জনবসতিপূর্ণ দ্বীপে আশ্রয় গ্রহণ করেন। দ্বীপের অধিবাসীরা খুব বন্ধুবৎসল হওয়ায় কিছুদিন পর দেখা গেল যে আমেরিকানটি একটি হালকা রেলগাড়ি চালাচ্ছেন, স্কচম্যান একটি দোকান খুলে বসে আছেন এবং আইরিশটি একটি ছোট সেনাদলকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। আর ইংরেজ? তিনি হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন, তাকে ফরমালি কারও সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি বলে। এটারই আধুনিক সংস্করণ বেরিয়েছে ‘রি জাইজেস্ট’ সাময়িকীর একটি সাম্প্র্রতিক সংখ্যায় : ‘ইংলিশ চ্যানেলের ফরাসি প্রান্তস্থিত ক্যালে বন্দরে এক শীতার্ত সকালে অপেক্ষারত একজন ইংরেজ পরপর বন্দরের একজন কর্মচারী ও ম্যানেজারকে ডেকে অদূরে উপবিষ্ট যে ভদ্রলোকটি আগুনের পাশে বসে পাইপ খাচ্ছেন ও পত্রিকা পড়ছেন তাকে ওরা চেনেন কিনা জিজ্ঞাসা করে না-বোধক জবাব পাওয়ায় অবশেষে লোকটির কাছে গিয়ে বিনীতভাবে বলতে লাগলেন, আমরা পরস্পর পরিচিত না হওয়া সত্ত্বেও আমি উপযাচক হয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য প্লিজ আমার অপরাধ নেবেন না। কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম, আপনার কোটের কোনায় আগুন লেগে গেছে।’

তবে এই আপাতগাম্ভীর্য ও ভদ্রতার অন্তরালে ইংরেজদের রসবোধ যে অত্যন্ত প্রখর তা সৈয়দ মুজতবা আলীও তাঁর এক লেখায় ব্যক্ত করে গেছেন। আর ওদের ওই রসবোধের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে নিতান্ত আকস্মিকভাবেই। লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রথম দিন কাজে যোগদান করতে গিয়ে গ্লোস্টাররোড আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন থেকে বেরিয়ে ২৮ কুইন্স গেট খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এক পর্যায়ে নিজেকে আবিষ্কার করলাম প্রিন্সেস গেট লেখা লৌহকপাটের সামনে। এক ইংরেজনন্দনকে কুইন্স গেটটা কোথায় জিজ্ঞাসা করতেই সে প্রথমে বলল সরি, আমি বলতে পারছি না। পরক্ষণেই সে সহাস্যে বলে উঠল, ‘তবে এটা যেহেতু প্রিন্সেস গেট, কুইন্স গেট দূরে হবে না।’ সে যেভাবে কথাটা বলল তাতে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল ইংরেজ কবি শেলির বিখ্যাত কবিতার লাইন, ÔIf winter comes can Spring be far behind  শীতকাল এলে বসন্তকাল কি রহে দূরে?’ পরবর্তীতে একদিন আমি ও আমার পাশের বাসার ইংরেজ বুড়ো একসঙ্গে বাস-স্টপেজে যার যার বাসের অপেক্ষা করছিলাম ও কথাবার্তা বলছিলাম। বাইরে সেদিন বেজায় ঠান্ডা। বুড়ো হঠাৎ বলে উঠলেন, মদ খেলে ঠান্ডা লাগে কম। আমি বললাম, কিন্তু আমার ধর্মে মদ পান করা নিষেধ আছে। বুড়ো তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞাসা করে বসলেন, তবে আপনার ধর্মে একসঙ্গে চার বউ রাখার অনুমোদন আছে, তাই না? প্রত্যুত্তরে আমি ‘হ্যাঁ’ বলে যোগ করতে যাচ্ছিলাম-  অবশ্য কিছু শর্তসাপেক্ষে। কিন্তু এতক্ষণে বুড়োর বাস এসে গিয়েছে। তিনি লাফ দিয়ে বাসে চড়তে চড়তে সহাস্যে বলে উঠলেন, সে ক্ষেত্রে আর আপনার মদপানের প্রয়োজন নেই।

বারান্তরে বার্মিংহাম থেকে ট্রেনযোগে লন্ডন ফিরছিলাম। পাশের সিটে বসা ছিলেন এক ইংরেজ যুবক। পরিচয় হলে পর কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, আমার মতো তিনিও লন্ডনে বসবাস করতেন। এক্ষণে লন্ডন শহরটা বিশালায়তন বিধায় প্রশাসনের ও জনসাধারণের সুবিধার্থে নর্থ লন্ডন, সাউথ লন্ডন, ইস্ট লন্ডন ও ওয়েস্ট লন্ডনে বিভক্ত। আমি তাকে সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন করলাম ‘হুইচ পার্টি?’ অর্থাৎ লন্ডন শহরের কোন্ অংশে তার বসবাস? কিন্তু তিনি ইচ্ছাপূর্বক আমার প্রশ্নকে ভুল বুঝে মৃদু হাস্যে জবাব দিলেন, ‘অল অব্ মি, অবকোর্স- আমার শরীরের পুরোটা, অবশ্যই।’ তার এই সুন্দর রসিকতায় আমি না হেসে পারিনি। আর হ্যাঁ, বিলেতের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়ও আমি রম্যরসের কোনো কমতি লক্ষ্য করিনি। বরং ইংলিশ পত্র-পত্রিকায় ও ইংরেজি সাহিত্যে যত উইট, হিউমার ও ব্যঙ্গাত্মক রচনা আছে, সারা ইউরোপের আর কোনো সাহিত্যে অতটা নেই এবং এ ব্যাপারে দেখেছি সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রয়াত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীরও পর্যবেক্ষণ তাই। সে দেশের প্রতিটি বড় বইয়ের দোকানে (যেমন ফয়েল্স) ও ডিপার্টমেন্টেল স্টোরে (যেমন সেলফ্রিজেস) হিউমার শীর্ষক একটি আলাদা সেকশনই থাকে। আর ব্রিটিশ টেলিভিশনের ‘ক্যারি ওন’, ‘বেনি হিল’, ‘টু রনিস’, ‘ইয়েজ মিনিস্টার’ ইত্যাদি সিরিজ সে সময় যারা দেখেছেন তারা সবাই একবাক্যে আমার সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করবেন যে, ওগুলো ছিল এক কথায় লা-জওয়াব। ব্রিটিশ কমেডিয়ান চার্লি চ্যাপলিন ও ‘মি. বিন’ খ্যাত রোয়ান এটকিনসনের খ্যাতিও তো বিশ্বজোড়া এবং তা কখনো ভোলার নয়। তো বিলেতের টিভিতে পরিবেশিত আমার ব্যক্তিগত পছন্দের একটি হাস্যরসের গল্প এ স্থলে পরিবেশন না করে পারছি না : তিন ইংরেজ যুবককে শহরের মূল রাস্তা দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বেগে গাড়ি চালিয়ে যেতে দেখে পুলিশ পাকড়াও করলে পর ওরা পরামর্শপূর্বক মিথ্যা নাম বলতে মনস্থ করল। পাশেই ছিল বিখ্যাত মার্কস অ্যান্ড স্পেনসারের দোকান। অতএব, প্রথম দুজন পর্যায়ক্রমে তাদের নাম বলল মার্কস ও স্পেনসার। তৃতীয়জনকে পুলিশ নাম জিজ্ঞাসা করতেই সে তাকিয়ে দেখে পরবর্তী দোকানটি ক্যানটাকি ফ্রাইড চিকেন শীর্ষক ফাস্টফুডের। তাই সে বলে উঠল ‘মাই নেইম ইজ ক্যানটাকি ফ্রাইড চিকেন  (My name is kentucty Fried chichan - আমার নাম হচ্ছে ক্যানটাকি ফ্রাইড চিকেন)।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, ও দেশে বাচ্চাদের স্কুলে ছেলেমেয়েদের জোক্স আত্মস্থ করতে ও বলতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। আমার ছেলে একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরে এসে আমাকে বলল, আব্বু, আমি টেলিফোনে ৯৯৯ ডায়াল করলে কী ঘটবে? আমি জবাব দিলাম, একজন পুলিশ আসবে। আবার সে প্রশ্ন করল, আর যদি ৬৬৬ ডায়াল করি? আমি জোকটি জেনেও না জানার ভান করলাম। তখন সে উৎফুল্লিত হয়ে বলে উঠল, ‘এ পুলিশম্যান উইল কাম, বাট উইথ হিজ লেগ আপ অ্যান্ড হেডডাউন- একজন পুলিশ আসবে ঠিকই, তবে তার পা ওপরের দিকে ও মাথা নিচের দিকে দিয়ে।’ বলা বাহুল্য, ইংরেজি ৯ সংখ্যাকে উল্টোলে ৬ সংখ্যা ও ৬ সংখ্যাকে উল্টালে ৯ সংখ্যার মতো দেখায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিলেতের পুলিশের সততা ও পেশাগত দক্ষতা প্রশ্নাতীত। সে দেশের পুলিশের ‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড’ নামে অভিহিত অপরাধ-তদন্ত সংস্থা যেখানে ব্যর্থ, সেখানে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে ওটা একটা বস্তাবন্দী কেইস। তা গল্প শুনেছি : একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে বিলেতের এক পুলিশ কর্মকর্তা গর্ব করে বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে আমরা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জানতে পারি অপরাধী কে বা কারা।’ এটা শুনে আমাদের দেশের পুলিশ প্রতিনিধি নাকি বললেন, ‘অনুরূপ ক্ষেত্রে আমরা ৪৮ ঘণ্টা আগেই জানতে পারি অপরাধী কে বা কারা।’ গল্পটি শুনে আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারিনি। আর গল্প গল্পই, এ নিয়ে কারও মন খারাপ করার কোনো কারণ নেই।

 তাই তো অতীতে ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’-এর কোনো এক সংখ্যায় পড়েছিলাম : স্বর্গ হচ্ছে সেই জায়গা, যেখানে ইংরেজরা পুলিশের আর ফরাসি, জার্মান, সুইস ও ইতালিয়ানরা যথাক্রমে পাচক, প্রকৌশলী, সংগঠক ও প্রেমিকের দায়িত্বে নিয়োজিত।

লেখক : রম্য সাহিত্যিক, ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর