মঙ্গলবার, ৩১ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

মহাদানবের বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম

হারুন হাবীব

মহাদানবের বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম

বিশ শতকে পৃথিবী দুটি মহাসমর দেখেছে, ধ্বংস, মৃত্যু ও ভয় দেখেছে অগণিত, কিন্তু একুশ শতকে করোনা মহাসমরের তান্ডব ছাড়িয়ে গেছে সবকিছু। কোনো একক জনপদ, একক রাষ্ট্র বা মহাদেশ নয়, মহাদানবের রণাঙ্গন আজ বহুজাতিক, বহুরাষ্ট্রীক। এর থাবা ব্রহ্মান্ডের প্রতিটি মহাদেশে; এর বিধ্বংসী আগ্রাসনে বিপন্ন লাখো মানুষ- সে মানুষ সাদা, ধূসর, কালো, বাদামি; ছোট-বড়, ধনী-গরিব; সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব বিশ্বাসের, সব আকৃতির। প্লেগ মহামারী কোটি মানুষের জীবন নিয়েছে এককালে; কলেরা, গুটিবসন্ত ছিনিয়ে নিয়েছে লাখো প্রাণ। এসেছে প্রাণঘাতী ভাইরাস সার্স, যা হাজারো মানুষের জীবন বিপন্ন করেছে। কিন্তু আগেকার আক্রমণগুলো সীমিত ছিল নির্দিষ্ট সীমান্তে। কিন্তু এই মহাদানবের থাবা অসীমান্তিক, যা গোটা মানবজাতির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ! এ যেন এক সর্বগ্রাসী মহাসমর, নজিরবিহীন। মানুষের অবিমৃশ্যকারিতায় মানুষ মানুষকে হতাহত করে গেছে যুগের পর যুগ; এক মানুষ আরেক মানুষকে আঘাত করেছে, এক মানুষ আরেক মানুষকে পরাস্ত করতে ঘটিয়েছে এন্তার ছোট-বড় দুর্যোগ। বিবেকী মানুষ সেই বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে, বেশির ভাগই সেই কণ্ঠস্বর বিফলে গেছে। কিন্তু চলতি এই যুদ্ধ সবকিছু ছাপিয়ে দিয়েছে, ভয় ও আতঙ্ক মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে নিজেদের ঘরবাড়ির কুঠুরিতে ঢুকিয়েছে। গোটা বিশ্ব যেন আজ একটি পরিবার, একটি ‘কোয়ারেন্টাইন’, পালাবার পথ নেই, যা এক ভয়ঙ্কর পরাজয় মানুষের! প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ আল্লাহতালার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, আত্মসমর্পণ করবে নাকি সর্বাত্মক প্রতিরোধযুদ্ধে নামবে? না, মানুষ আজও আত্মসমর্পণ করেনি, সে হন্তারক শত্রুকে পরাজিত করার, যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার চেষ্টা করে চলেছে।

মানবজাতির বিরুদ্ধে একুশ শতকের যুদ্ধটি শুরু হয় উহানে, বিশ্বের তাক লাগানো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দেশ চীনের মাটিতে; দাবি করা হয়েছে, মাস দু-একের প্রাণান্ত লড়াইয়ে জয়ী হয়েছে দেশটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও প্রশংসা করেছে চীনের সফল লড়াইকে। কিন্তু সে দাবি সবাই সমানভাবে গ্রহণ করেনি। এরই মধ্যে নতুন আক্রান্তের খবর মিলেছে, বলা হচ্ছে, ওগুলো দেশের নয়, বাইরে থেকে আসা। হতেই পারে।

ওখানেই শেষ নয়। বিশ্ব গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, চীন কয়েক সপ্তাহ ধরে গোপন রেখেছিল খবরটিকে। ফলে দ্রুত ছড়িয়েছে নভেল করোনার বীজ, এশিয়া থেকে ইউরোপ, সেখান থেকে আমেরিকা, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে। এরই মধ্যে আক্রান্ত ১৭০টির বেশি দেশ। এরই মধ্যে মৃত ৩৫ হাজার মানুষ। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বেড়ে চলেছে মৃতের সংখ্যা, আক্রান্তের সংখ্যা। ফলে তালা ঝুলেছে সব দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে; এরই মধ্যে বন্ধ হয়েছে মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও প্যাগোডা; অবরুদ্ধ হয়েছে বিশ্বের সব বড়-ছোট শহর, দোকানপাট, যানবাহন। বন্ধ হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনোদন কেন্দ্র; জলযানগুলো নোঙর ফেলেছে, বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরগুলো অকার্যকর হয়েছে, মানুষ গেছে নিরাপদের নির্বাসনে, কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ অনিচ্ছায়। এমন সর্বগ্রাসী ভয় বিশ্ব আগে কখনো দেখেনি।

বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে নভেল করোনার মহাসমর; কেন-কীভাবে এর আবির্ভাব, কেন-কীভাবে এর বিস্তৃতি? প্রশ্নগুলো চলবে বহুকাল ধরে। হয়তো উত্তর মিলবে হয়তো মিলবে না। প্রশ্ন উঠেছে, যে মারণাস্ত্র আজ মানবসভ্যতাকে নজিরবিহীন পর্যুদস্ত করে চলেছে, তার সূত্রপাত ঘটিয়েছে কে এবং কেন? এটি কি উহানের বাজারের ক্রয়-বিক্রয় হওয়া বাদুড় বা প্যাঙ্গোলিন নামের ক্ষুদ্র প্রজাতির অসুস্থ প্রাণীর শরীর থেকে ছড়িয়েছে, (যা কিনা চীনের মানুষ উপাদেয় খাবার হিসেবে খেয়ে থাকে) নাকি শত্রুপক্ষকে আঘাত করতে জীবাণুটি কোনো না কোনো পক্ষের পরিকল্পিত কোনো ‘রাসায়নিক যুদ্ধ’? উহানের বাজারে এসব প্রাণীর কেনাবেচা হয় হামেশা, প্রশ্ন হচ্ছে, আগে যা ঘটেনি আজ তা ঘটে কীভাবে? একি প্রকৃতির প্রতিশোধ, ভারসাম্যহীনতার প্রতিক্রিয়া, নাকি অন্য কিছু?

বহু দেশের বেশকিছু মহল থেকে এরই মধ্যে চীনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উত্থান ঠেকাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ‘জীবাণু অস্ত্র’ ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছে। আছে ‘ষড়যন্ত্র থিওরি’ আরও। বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিকভাবে পরাস্ত করার চিন্তা বাদ দিয়ে কিংবা বিশ্বকে আরও বেশি নির্ভরশীল করতে, আরও বেশি বাণিজ্য করতে চীন নিজেই ছড়িয়েছে ভাইরাসটি, যা ইতালি-স্পেন, ইরানের পর যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সকে আঘাত করেছে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে ব্যাপক ও বিস্তৃত আঘাত হেনেছে আমেরিকা বা যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে। প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, চীনের মাটিতে রোগটি দেখা দিলেও কেন তা দেশটির কোনো বড় শহর, ব্যবসাকে আঘাত করেনি? বরং, কেবল মাস্ক, ভাইরাস কিট, পারসোনাল ইকুইপমেন্টই নয়, একই সঙ্গে চীন রপ্তানি করতে শুরু করেছে ভেনটিলেটরও। বলা হচ্ছে, অবিশ্বাস্য দ্রুততায় চীন আজ তার রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। না, ইত্যাকার প্রশ্ন বা অভিযোগের কোনোটাই শতভাগ নিশ্চিত হতে পারেনি কেউ। সত্য যা-ই থাকুক, মানুষ এই বিপন্নদশা থেকে মুক্তি চায়। যেভাবে জাপানের নাগাসাকি ও হিরোশিমার মানুষ একদিন মুক্তি চেয়েছিল আমেরিকার পারমাণবিক বোমা থেকে বাঁচতে, যেভাবে ভিয়েতনামের মানুষ মুক্তি চেয়েছিল নাপাম থেকে বাঁচতে, যেভাবে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তি চেয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বর মারণাস্ত্র থেকে বাঁচতে। সবাই জানেন, আগেকার যুদ্ধ বা মহাযুদ্ধগুলো পাল্টে দিয়েছে বিশ্বকে, সে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে এক ভূখন্ড থেকে আরেক ভূখন্ডে, দেশ, অঞ্চল ও ভূ-রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজ কাঠামোয়। দ্বিতীয় মহাসমরের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন পৃথিবীর প্রায় সব জনপদে মানুষের বোধবিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটেছে, তেমনি ব্যাপক ও বিস্তৃত পরিবর্তন ঘটেছে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে। আমার বিশ্বাস, করোনার যুদ্ধ যেহেতু কার্যকরভাবেই একটি তৃতীয় মহাসমর, অতএব এর প্রভাব হবে আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত। এ যুদ্ধ বিশ্বকে আগের মতো উন্মুক্ত রাখবে বলে মনে হয় না আমার। ব্যাপক এক অর্থনৈতিক মন্দা, নিরাপত্তার সংকট গ্রাস করবে সব অঞ্চলকে। ফলে জেগে উঠবে জাতীয়তাবাদ, ঘটবে মন ও রাষ্ট্র- সীমান্তের অনাকাক্সিক্ষত সংকোচন, যা অধুনা বিশ্বায়নের যুগকে, যার বহিরাঙ্গে যদিও স্বাধীনতা ও উন্মুক্ততা, অন্তরঙ্গে প্রভাবশালীদের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ, তাকেও ফেলবে চ্যালেঞ্জের মুখে। এ যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় প্রায় সব দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্প্রসারিত হবে, নিয়ন্ত্রিত হবে বর্ডার, জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেওয়ার উপসর্গ উগ্র আকার ধারণ করবে, বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ সংকুচিত হবে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ছোট অর্থনীতি, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী, বিপন্ন হবে মানবসভ্যতা।

কী দেখা গেছে এযাবৎ? ছোট অর্থনীতি বা গরিব দেশগুলোর কথা বাদ দিই, লক্ষ্য করা গেছে, বড় অর্থনীতি বা শক্তিশালী দেশগুলোর জনজীবনকেও এ যুদ্ধ কতই না উলঙ্গভাবে প্রকাশ করেছে! পশ্চিমের শহরগুলোর সুবিশাল শপিং মল, চেইন শপগুলো রাতারাতি খালি হয়ে গেছে! মানুষ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়েছে; এ অসহায়ত্ব কেবল দ্রব্যপ্রাপ্তির বিষয় নয়, এ অসহায়ত্ব ভোগবাদী বিশ্বের মনোজাগতিক দীনতা। একটি আঘাত ধস নামিয়েছে সবকিছুর। শুধু তাই নয়, ধর্মাচার বা ধর্মকেন্দ্রিক সংস্কৃতির পুরোধাদেরও বাধ্য করেছে করোনার দানব তাদের দীর্ঘলালিত বিশ্বাস বা রাষ্ট্রশাসন কৌশলের পরিবর্তন ঘটাতে! অতএব এ মহাসমর গতানুগতিক বিশ্বকে, প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করাবে- সন্দেহ নেই। কিন্তু করোনার এ মহাসমর, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরও, বিশেষ বিশেষ অঞ্চলকে হয়তো এক হয়ে দাঁড়াবার সুযোগ দান করবে, যা আগে দেখা যায়নি কার্যকরভাবে। কারণ আক্রান্ত বিশ্ব আজ একটি পরিবারে পরিণত। এ যুদ্ধ যেহেতু সর্বত্রগামী, এর প্রতিরোধও হতে হবে তাই সর্বত্র। শত্রু যখন ঘরে ও বাইরে এবং এখনো অচিহ্নিত, সেহেতু একক দেশ বা রাষ্ট্রের উদ্যোগের সঙ্গে নিতে হবে সমন্বি^ত কর্মপন্থা। ধনী দেশগুলোর কাছে সে কারণেই প্রত্যাশা যে, তারা কেবল নিজেরা বাঁচবেন, এমন ধারণা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসুন, গরিব বা সক্ষমতাহীন রাষ্ট্রগুলোর দিকে সহযোগিতার হাত বাড়ান। কারণ এ আগুন বিশ্বকে পুড়ছে, শুধু অন্যকে নয়, নিজেকেও।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ধসে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র আজ একক পরাশক্তি। কিন্তু ভাগ বসাতে সব শক্তি ও কৌশল নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে চীন, যার অর্থনীতি ও সমরশয্যা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। দেশ দুটির প্রতিযোগিতা তাই বাণিজ্য বা অর্থনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়, পরিষ্কারভাবে ভূ-রাজনীতিতেও। চলমান এ প্রতিযোগিতা, বলা বাহুল্য, নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে গোটা বিশ্বে। যত দ্রুত এ প্রতিযোগিতার অবসান হয় ততই মঙ্গল, ততই স্বস্তিদায়ক। বর্তমান সময়টি, সে কারণেই বোধ জাগাবার সময়, মানুষ হওয়ার সময়। একবার কি ভেবে দেখব- কী অসহায় হয়ে পড়েছে মানুষ, শক্তিধর কিংবা দুর্বল, সকল প্রান্তের সব মানুষ, যে মানুষ বিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান, সবচেয়ে বিচক্ষণ প্রজাতি! বন্ধ হয়েছে মক্কা, মদিনা, ভ্যাটিকানের দলবদ্ধ আরাধনা; বন্ধ হয়েছে গির্জার প্রার্থনা, মসজিদের নামাজ, মন্দির ও প্যাগোডার প্রার্থনা। বন্ধ দোকানপাট, রেল-স্টিমারঘাট; কারফিউ চলছে প্রায় সব জনপদে, ঘোষিত হয়েছে সাধারণ ছুটি, সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে বহু অংশে; তবু যেন শেষ নেই করোনা দানবের! অতএব এ দানবকে পরাস্ত করার, এ যুদ্ধে জেতার বিকল্প কোথায়? আমাদের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চল বিশ্বের সবচাইতে ঘনবসতিপূর্ণ, যেখানে পৃথিবীর এক-পঞ্চমাংশ মানুষের বসবাস। অতএব দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগের পাশাপাশি প্রয়োজন সমন্বিত আঞ্চলিক উদ্যোগ। সে কারণে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের ভিডিও সম্মেলনকে স্বাগত জানাতে হবে। এ সম্মেলনে যদিও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী যোগ দেননি, দিয়েছেন তার স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা, তথাপি ১৫ মার্চের আলোচনাটি নিঃসন্দেহে সময়োচিত পদক্ষেপ। মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা প্রায় মৃত হয়ে পড়েছিল, সেই সংস্থার কিছুটা হলেও পুনর্জীবিত হয়েছে চলমান করোনাযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। মোট কথা, শত বিপন্নতার পরও, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, আদর্শ বা বর্ণগত বিভাজনের পরও, এ দানবকে পরাস্ত করতে হবে মানুষকেই এবং সম্মিলিতভাবে, এ বিজয়ের কোনো বিকল্প নেই।

লেখক, গবেষক ও সংবাদকর্মী।

email : [email protected]

সর্বশেষ খবর