করোনাকালেও রাজনীতি হচ্ছে। তবে বিবর্ণ, অন্তঃসারশূন্য। সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অভিযোগ পাল্টা জবাব চলছে। থেমে নেই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের অভিযোগ আর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের স্বভাবসুলভ জোছনাভেজা কাব্যিক জবাব। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ তাঁর কায়দায় যেমন বলছেন তেমনি বিরতিহীন চলছে বিএনপির যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর নিত্য বয়ান। মানুষের কাছে এসব বিতর্কের আবেদন আছে, নাকি নেই- এসবে কেউ নজর দিচ্ছেন না। তবে নি®প্রাণ সংসদে করোনাকালে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে বিরোধী দল কিছুটা ধুলো উড়িয়েছে। এমনিতেই আদর্শিক ঊর্মিমুখর গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে কর্মকা- আগের মতো নেই। অন্যদিকে ছাত্র রাজনীতির সেই যৌবনকাল কবে হারিয়ে গেছে! জাতীয় রাজনীতিতেও রাজনীতিবিদ বলতে হাতে গোনা কিছু আজ, সেখানে তারাও প্রায় বাধ্যতামূলক ছুটিতে। করোনার সঙ্গনিরোধকালে রাজনীতিই বা কই! তবু বলতে হয়, মিডিয়ায় থাকতে হয় বলে কেউ ধার ধারুক আর না-ই ধারুক বলবেনই তারা।
রাজনীতিটা যে রাজনীতিবিদদের হাত ফসকে কবে বের হয়ে গেছে, দেশ পরিচালনায় রাজনীতিবিদদের কর্তৃত্ব যে খর্ব হয়ে গেছে, তাও কেউ বুঝছেন না। করোনাকালের বিমর্ষ বিকালে আষাঢ়ের মেঘে খেলা করা আকাশে, রাজনীতির মনমরা ঘুড়ি দেখি, নাটাই কার হাতে জানি না! জনগণ আজন্ম রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বে জীবন বাজির জুয়া খেলতে দ্বিধা করেনি। স্বাধীনতায়, মুক্তিযুদ্ধে, গণতন্ত্রের সংগ্রামে তার দেখা মিলেছে! জেলজুলুম মামলা রাজনীতিবিদরাই সইবেন, জীবন নিয়ে জুয়া খেলবেন মানুষের জন্য, কর্মীরাই জীবন দেবেন, রক্ত ঝরাবেন, নির্যাতন ভোগ করবেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই জনগণ নয়, প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল হবেন, কর্মী ও জনগণের শক্তিকে অবহেলা করবেন। সুবিধাবাদী সুযোগসন্ধানীদের সুসময়ের বন্ধু করে দুর্দিনের সাথীদের দূরে ঠেলবেন- এ কেমন কথা! অনেকে নিজেরা অর্থের লোভে পড়বেন, কর্মীদেরও ভাসাবেন। দলের জনপ্রিয়তাও হারাবেন অপকর্মে। এভাবেই আজ রাজনীতিবিদরা রাজনীতিকে কলুষিত করে, নিজেরাই নিজেদের শক্তি হারিয়ে জনগণের ক্ষমতার কতটা প্রতিনিধিত্ব করছেন? এটা অনেক বড় প্রশ্ন।
 আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত রাজনৈতিক শক্তির নির্লোভ গণমুখী আদর্শিক উত্তরাধিকারিত্ব হারিয়ে আমরা রাজনীতিকে দেউলিয়া করেছি। বঙ্গবন্ধুই জনগণকে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতার মালিক করেছিলেন। এটা তিনি বিশ্বাস করতেন। পাবলিক সার্ভেন্টদের কঠোরভাবে বলেছেন তাঁর গরিব কৃষক শ্রমিককে সম্মান করে কথা বলতে। ওরাই পড়াশোনা করিয়েছে, ওরাই বেতন দেয়। ওরা দুর্নীতি চোরাকারবারি করে না, বিদেশের এজেন্ট হয় না। তাই নয়, বঙ্গবন্ধুই এ দেশে রাজনীতিবিদদের কর্মীদের মর্যাদা সম্মান প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। প্রমাণ করেছিলেন পারিবারিক আভিজাত্যের, অর্থবিত্তের অহংকার জৌলুস ছাড়া গণমানুষের কল্যাণে রাজনীতি করে সাধারণ পরিবার থেকেও এমপি-মন্ত্রী হওয়া যায়। জননেতা হওয়া যায়। জননেতা শব্দটি আজ মানুষের হৃদয়ে নির্বাসিত হয়ে পোস্টারের স্বঘোষিত শব্দে পরিণত। আরও কত অলঙ্কার! বঙ্গবন্ধু নির্লোভ ত্যাগ আদর্শ ও সাহসের আলোয় নেতা-কর্মী তৈরি করেছিলেন। তিনিই ছিলেন রাজনীতি ও রাষ্ট্রের আদর্শ। তিনিই জনপ্রতিনিধিদের কলোনিয়াল প্রথা ভেঙে ক্ষমতাবানই করেননি, ইজ্জত বাড়িয়েছিলেন। পাবলিক সার্ভেন্টদের ওপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই সময় তাঁর ভিন্নমতের নেতা-কর্মীরাও আদর্শিক ছিলেন। কঠোর সরকারবিরোধী মওলানা ভাসানীকে রাজনীতির খরচ জোগান দিতেন বঙ্গবন্ধু। ভাবা যায় আজ কোথায় নেমে গেছি আমরা?
আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত রাজনৈতিক শক্তির নির্লোভ গণমুখী আদর্শিক উত্তরাধিকারিত্ব হারিয়ে আমরা রাজনীতিকে দেউলিয়া করেছি। বঙ্গবন্ধুই জনগণকে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতার মালিক করেছিলেন। এটা তিনি বিশ্বাস করতেন। পাবলিক সার্ভেন্টদের কঠোরভাবে বলেছেন তাঁর গরিব কৃষক শ্রমিককে সম্মান করে কথা বলতে। ওরাই পড়াশোনা করিয়েছে, ওরাই বেতন দেয়। ওরা দুর্নীতি চোরাকারবারি করে না, বিদেশের এজেন্ট হয় না। তাই নয়, বঙ্গবন্ধুই এ দেশে রাজনীতিবিদদের কর্মীদের মর্যাদা সম্মান প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। প্রমাণ করেছিলেন পারিবারিক আভিজাত্যের, অর্থবিত্তের অহংকার জৌলুস ছাড়া গণমানুষের কল্যাণে রাজনীতি করে সাধারণ পরিবার থেকেও এমপি-মন্ত্রী হওয়া যায়। জননেতা হওয়া যায়। জননেতা শব্দটি আজ মানুষের হৃদয়ে নির্বাসিত হয়ে পোস্টারের স্বঘোষিত শব্দে পরিণত। আরও কত অলঙ্কার! বঙ্গবন্ধু নির্লোভ ত্যাগ আদর্শ ও সাহসের আলোয় নেতা-কর্মী তৈরি করেছিলেন। তিনিই ছিলেন রাজনীতি ও রাষ্ট্রের আদর্শ। তিনিই জনপ্রতিনিধিদের কলোনিয়াল প্রথা ভেঙে ক্ষমতাবানই করেননি, ইজ্জত বাড়িয়েছিলেন। পাবলিক সার্ভেন্টদের ওপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই সময় তাঁর ভিন্নমতের নেতা-কর্মীরাও আদর্শিক ছিলেন। কঠোর সরকারবিরোধী মওলানা ভাসানীকে রাজনীতির খরচ জোগান দিতেন বঙ্গবন্ধু। ভাবা যায় আজ কোথায় নেমে গেছি আমরা?
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সংবিধান ও রাজনীতি থেকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল। জাতীয় নেতাদের হত্যা, আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্মম নির্যাতন করা হয়েছিল। সংবিধানকে চরমভাবে লঙ্ঘন করে বন্দুকের শাসন কায়েম করে সামরিকতন্ত্রের অন্ধকারে বিচারহীনতায় দেশকে খুনিদের উল্লাসমঞ্চ বানিয়েছিল। এক ডজন খুনিকে কূটনীতিক বানিয়ে বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক স্বাধীনতাবিরোধীই নয়, যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছিল। এমনকি সেনাশাসক জিয়াউর রহমান আমাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মুসলিম লীগ, চিনাপন্থি মুজিববিদ্বেষী আর মুক্তিযোদ্ধাদের মিলিয়ে একাত্তরে পরাজিত পাকিস্তানি ধারার রাজনীতির আধুনিক সংস্করণ ‘বিএনপি’র জন্ম দিয়েছিলেন। সেই ধারা থেকে বিএনপি বের হতে পারেনি। এখনো সেই ধারারই প্রতিনিধিত্ব করছে। কয়েক দিন আগে প্রখ্যাত সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী লিখেছিলেন, করোনার রাজনীতি উল্টোপথে বিএনপি। বিএনপি কে চালায় এ প্রশ্ন তুলে এতদিন আমরা দলটির যে ভুলগুলো বলে আসছি তার সারমর্ম তুলে ধরেছেন। আসলে অনেক কিছুই কে চালায় ক্ষমতায় বাস করেও যেন অনেকে জানে না!
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে সব সিটিতে মেয়র জয়ী জনপ্রিয় বিএনপির সেই ভোট বর্জন করে জামায়াতকে নিয়ে সহিংস প্রতিরোধের ডাক ছিল ফাঁদে পা দিয়ে আত্মঘাতী। ওয়াকওভার দেয় আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের। যারা সেদিন বোকা সিদ্ধান্তে সর্বনাশটা করেছিলেন তারা কার ক্যাপসুল খেয়েছিলেন? পরে জনগণকে না নিয়েই অসহযোগের নিষ্ফল অবরোধের আগুন-সন্ত্রাস মামলার জালে ক্ষয় করে দলকে। নেতারা যেখানে দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে বসার চেয়ার পাননি সেখানে আগে ঠিক করা প্রণব মুখার্জির সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠক বাতিল করেন শিবিরের হরতালের জন্য! চড়া ভুলে দলের সর্বনাশ পরতে পরতে। সর্বশেষ নির্বাচনে ড. কামালকে সামনে নিয়ে দাঁড়ালেও জামায়াতকে ভোটের আসনের ভাগ দিয়ে শাসক দলের অধীনে নির্বাচনে যে ৪০-৫০ আসন পাওয়ার সুযোগ ছিল তাও হারায়। এর আগে ক্ষমতায় থাকতে ভুলে যায় কারা তাদের এনেছিল ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী করে। আইএসআইয়ের জন্য দেশের দরজা খুলে দিয়ে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, বোমা, একুশের গ্রেনেড হামলার ভয়াবহতা, তিন স্তরের দলীয় প্রশাসন, হাওয়া ভবনের তত্ত্বাবধানে তৈরি রাজদুর্নীতির বাজিকরদের দাপট দৃশ্যমান হয়েছিল। বিরোধী দলকে শেষ করার কি ভয়ঙ্কর খেলায় মেতেছিল তারা। ক্ষমতার অন্ধ মোহে ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একতরফা নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার শেষ চেষ্টা ওয়ান ইলেভেনে ব্যর্থ হতেই, সেই যে সব হারিয়ে গেল আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! দাঁড়াতেই পারছে না এখন। শেখ হাসিনার কাছে পরিবারের আকুতিতে খালেদা জিয়ার মুক্তি মিললেও দল লাভহীন।
এদিকে ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার ক্যারিশমায় গণরায়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ এক দশক পর এবারে টানা তৃতীয়বারে শরিকদেরও ক্ষমতার ভাগ দেয়নি। বিএনপি দাঁড়াতে পারছে না, আর সারা দেশে সব পেশার সবাই আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে। ক্ষমতার দম্ভে অনেকে ভুলতেই বসেছেন এই আওয়ামী লীগ তার ৭১ বছরের দীর্ঘ সময়ে রাজপথের সংগ্রামে রক্তই ঝরিয়েছে। নির্যাতন, জেল, মামলা, হামলা, হত্যার শিকার হয়েছে। কত দুঃসময় গেছে। বঙ্গবন্ধুর পর কন্যা শেখ হাসিনা প্রায় ৪০ বছর দলের নেতৃত্ব দিয়ে সাফল্যের গৌরব অর্জন করলেও ২১ বারের বেশি মৃত্যুর দুয়ার থেকে অমিত সাহসে ফিরেছেন। আজ তিনিই সরকার, দল ও মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক শক্তির ঐক্যের প্রতীক। তিনিই শক্তি। তাঁর ১০ বছর উন্নয়নের মহাযাত্রার দশক। যদিও দুর্নীতি, দলের একদল নেতা, মন্ত্রী, এমপির লুটপাট, সুবিধাবাদীদের ব্যাংক লুট, শেয়ার লুট, অর্থ পাচার নিয়ে অসন্তোষ আছে, কিন্তু বর্তমান করোনাকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চরম ব্যর্থতা, চিকিৎসা খাতের হরিলুটের ভয়াবহতা সব অর্জন ধূসর করে দিয়েছে। দলের নেতা আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম যথার্থ বলেছেন, দাফতরিক কাজে ব্যস্ত জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিবরা ব্যর্থ হয়েছেন। আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, অনুপ্রবেশকারী দুষ্টচক্রের হাত থেকে দলকে রক্ষা করতে হবে। দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারিতেও তারা দমেনি। নাসিম, নাছিম দুই ভাই-ই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে দুঃসময়ের পাঠ নেওয়া। ৩২ নম্বর থেকে একজন দুঃসময় সুসময়ে শেখ হাসিনার পাশে, আরেকজন সুধাসদন থেকে ও ওয়ান ইলেভেনে সরকারি চাকরি ছেড়ে পাশে থাকা। দুজনই প্রথম ক্ষমতাকালীন স্টাফ। তো দুষ্টচক্র আর আমলাতন্ত্রের সিন্ডিকেট থেকে কি বের হতে পারবে? না পারলে আজ বিএনপি সুদিনের কোকিলদের পাচ্ছে না, আওয়ামী লীগ অতীতে পায়নি ভবিষ্যতে পাবে না। কিন্তু করোনাকালের দায়টাই ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে জবাবদিহির জায়গায় আওয়ামী লীগকে দাঁড় করাবে। সব দেশের ক্ষমতাসীন দলের জন্যই করোনা হবে রাজনীতির চ্যালেঞ্জ।
’৯৬ সরকারেও অ্যারাবিয়ান ব্ল্যাকহর্সের মতোন গতিশীল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় রাজনীতির দীর্ঘ সংগ্রামে উঠে আসা জননেতাদের কি দাপুটে মন্ত্রিসভা। আবদুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সালাহউদ্দিন ইউসুফ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, আ স ম আবদুর রব, জাঁদরেল সিএসপি থেকে আসা শাহ এ এম এস কিবরিয়া, এইচ কে সাদেক, শেষে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, পরে আমির হোসেন আমু, আবদুল জলিল, শেখ ফজলুল করিম সেলিমও যোগ দিয়ে দক্ষতা প্রমাণ করেছিলেন। কি দাপুটে সব নেতা আর ব্যক্তিত্ব। কি জাঁদরেল সব সচিব তারা নিয়ন্ত্রণে রেখে কাজ করেছেন। এটাই সত্য শেখ সেলিমের সময় চিকিৎসা খাত লুটের মুখ দেখা দূরে থাক, উন্নয়নের আলো দেখেছে সরকারি হাসপাতাল। এত বরাদ্দও ছিল না। পরে বিএনপির ড. মোশাররফ জমানা থেকে যে দুর্নীতি শুরু আর থামল না। বরাদ্দ বাড়ার সঙ্গে তুমুল লুটের রাজত্ব। এখনো বহাল। ১০ বছরে এক মিঠুই ৯০০ কোটি লুটে নিয়েছে সরকারি হাসপাতালে মেশিনের বদলে খালি বাক্স পর্যন্ত দিয়ে! অর্ধশত নাকি তার বেনামি কোম্পানি। এবার সংসদে প্রধানমন্ত্রী কথা বলতে দিয়েছেন। বিরোধী দলের কাজী ফিরোজ রশীদ, মুজিবুল হক চুন্নু, পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ, বিএনপির হারুনুর রশীদ কঠোর সমালোচনা করেছেন। এমপি একরামুল করিম চৌধুরীর ভিডিও ভাইরাল। মানুষের কথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী যে জবাব দিয়েছেন সবাই তাজ্জব! ভেন্টিলেশনে মারা যায়, পিপিইকে পিপিপি বলে এটা ঠিক মতোন ব্যবহার করতে না পারায় চিকিৎসকরা আক্রান্ত হয়ে মারা যায়! মনে হয় থামলেই ভালো হয়। অবশেষে দুদক এ খাতের ডন মিঠুকে তলব করেছে। আশা কেবল সিন্ডিকেট নয়, দুর্নীতির সব মুখোশ খুলে যাবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা জড়িত তারা পাকড়াও হবে।
এবার মন্ত্রিসভায় কয়েকজন ছাড়া বেশির ভাগই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ। এতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় আমলাদের সিন্ডিকেট বেপরোয়া, জনগণের ক্ষমতা মুখ থুবড়ে পড়েছে। এক সচিবের আগ্রাসী দাপট সচিবালয় ছাড়িয়ে এলাকার রাজনীতিতে হাত রাখে! করোনাকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ই সব ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে। মানুষের ভরসার উচ্চতায় শেখ হাসিনা। এত মানুষকে খাদ্য সহায়তা, অর্থ সাহায্য দিলেন, এত বরাদ্দ স্বাস্থ্য খাতে করোনা মোকাবিলায় তবু এ দশা কেন। কাল ক্ষমতা গেলে রাজনীতিবিদরা মামলা জেল ভোগ করবেন। কর্মীরা নির্যাতনের শিকার হবেন। সচিব কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তে থাকবেন, সুবিধাভোগী লুটেরা আস্তানা ও সুর বদলাবেন নতুন ছাতায়!
তাহলে ক্ষমতার রাজনীতিতে একদল আমলাকে সীমাহীন খবরদারি করতে দিয়ে পাবলিক সার্ভেন্টদের প্রভুর আসন দেওয়া কেন? জনগণের নির্বাচিত মন্ত্রী-এমপিরা যেন ডামি। বহুবার বলেছি সংবিধান ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সঙ্গে এটা অসংগতিপূর্ণ। মন্ত্রী-এমপিরা নিজেদের সামর্থ্যে করোনার রাজনীতিতে ত্রাণ বিতরণ করছেন। সাহায্য করছেন। যারা ব্যবসায়ী নন বা যাদের ধনাঢ্য দাতা শুভার্থী নেই, নির্লোভ সৎ তারা পিছিয়ে আছেন। তবু করছেন। প্রশাসনের কর্তারা চেয়ারম্যান মেম্বার দিয়ে ত্রাণ বিতরণ করে যাচ্ছেন করোনা ও বন্যায়। চেয়ারম্যান মেম্বাররা জেলে যাচ্ছেন, বরখাস্ত হচ্ছেন সেই প্রচলিত রিলিফ চুরির তকমায়। কিন্তু ত্রাণ বণ্টনে জড়িত সরকারি কর্মকর্তারা একদম সফেদ। মারহাবা! তাদের কোনো অনিয়ম নেই। ওপরে তাদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সরকার বদল হলেও তারা থাকবেন, জেলে যাবেন মন্ত্রী এমপিরা। কিন্তু জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কী বলবেন ভোট এলে? তাদের তো জনগণের কাছে জবাবদিহিতে পড়তেই হবে। মানুষের সঙ্গে থেকেই তাদের রাজনীতি। মানুষের বিপদে বসে থাকতে পারেন না।
সচিবদের জেলার সমন্বয়ক করা হয়েছে। তারা কতবার গেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলায়? জনগণের কাছে তাদের না জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহি? ক্ষমতা আমলার, জবাবদিহি রাজনীতিবিদদের! কী বেহাল অবস্থা! গণমাধ্যমেও আসে না জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিবরা কোথায়? আসে না নেতাদের কণ্ঠে সাংবাদিক কাজল ফকিরের মুক্তি চাই। আসলে নেতাই নেই। কাজল আওয়ামী লীগ আমলে এত দিন নিখোঁজ, এত দিন জেলে গরিব বলে কেউ তার মুক্তির জন্য ভাববে না? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকরা পীড়নে, কেউ দেখবে না? আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ করোনায় এলাকার দায়িত্ব পালন করে কানাডায় পরিবারের কাছে গেছেন। বাপরে যেন মহাপাপ! তিনি অন্যায় করেছেন যে বিতর্কে ফেলতে হবে? রাজনীতিবিদ দোষে-গুণে হলেও তাদের যখন তখন ধরা যায়। তাদের ধরতেই গণমাধ্যমের মজা আলাদা। সচিবরা জেলায় কদিন গেলেন, কী করলেন মিডিয়ায় নেই, ফেসবুকেও নেই। কি মানসিকতা!
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যবসায়ী মোরশেদ খান ও ব্যবসায়ী সোহেল এফ রহমান চার্টার্ড বিমানে লন্ডন গেছেন চিকিৎসায়। সর্বশেষ আ হ ম মুস্তফা কামাল (লোটাস কামাল) চিকিৎসার জন্য যাত্রী হয়ে বিমানে লন্ডন গেছেন। এসব নিয়ে বিতর্কের কী আছে? দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা আমরা দুর্নীতিতে দেউলিয়া করেছি। কোথায় শক্তিশালী চিকিৎসাব্যবস্থা? মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে যার সামর্থ্য আছে সে যাবে। আর এটা কি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শিক নির্লোভ ত্যাগী রাজনীতির জমানা? অর্থমন্ত্রী কি পোড় খেয়ে উঠে আসা রাজনীতিবিদ? তিনি মেধাবী সফল ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিতে এসে মন্ত্রী। তার টাকায় যাবেন, প্রধানমন্ত্রী অনুমতি দিয়েছেন। তিনি সব সময় বিদেশে চিকিৎসা করান। চিকিৎসার জন্য ধনী গরিব সবাই বিদেশ যান, কারণ জীবন আগে। আমেরিকাই না, সিঙ্গাপুর তো এখন ডালভাত। ব্যাংককে হুট করে চলে যায় মানুষ। ভারতে তো ঢল নামে আকাশ, রেল ও সড়কপথে। মধ্যপ্রাচ্য থেকেও তাদের রোগী আসে।
আমাদের দেশ থেকে যায় সকল শ্রেণি পেশার মানুষ। আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা যত দিন না মানুষের আস্থা অর্জন করবে তত দিন এটা চলবে। কে কোথায় গেল সেটা বিতর্কের নয়, বিতর্ক আমাদের স্বাস্থ্য খাত কেন আস্থা অর্জন করতে পারেনি, উল্টো সরকারি খাতে হরিলুট বেসরকারি খাতে অমানবিক বাণিজ্য। কেন এতটা ভঙ্গুর তা নিয়ে আজ করোনা আক্রান্ত প্রিয় স্বদেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে প্রশ্ন। করোনা পৃথিবীজুড়ে মহাপ্রলয় ঘটিয়ে এখন আমাদের এখানে তা-ব শুরু করেছে। ২ হাজার ছাড়িয়েছে সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা। ২ লাখের দিকে যাচ্ছে আক্রান্তের হিসাব। একেকটা মৃত্যু কত বেদনার! একেকটা আক্রান্তে কি ভয়ঙ্কর অবস্থা। আর জীবন-জীবিকার লড়াইয়ে সরকারি খাত নিরাপদ, বেসরকারি খাত কঠিন চ্যালেঞ্জে। অর্থনীতির মহাবিপর্যয় পৃথিবীজুড়ে, ঝড় এখানেও লাগবে। কর্মহারা হচ্ছে কত মানুষ। তবু দুর্নীতি, লুট, মুনাফা, লোভ, হিংস্রতা, বেইমানি, নির্দয় অমানবিক ঘটনা থামছে না। ক্যান্সারে লড়ে চলে গেলেন জনপ্রিয় শিল্পী এন্ড্রু কিশোর। আমাদের সহকর্মী ভালোবাসার কবি সাংবাদিক মাশুক চৌধুরী, ফারুক কাজী, কত মুখ শেষ যাত্রায়। আমার চন্দ্রস্মিতা করোনাকে জয় করেছে ঘরে থেকে। তার মা এভারকেয়ারের আইসিইউতে ১৬ দিন থেকে ফিরেছেন সন্তানের কাছে। যুদ্ধে কাহিল। কত লাখ মানুষ অবসাদে আজ প্রাণহীন! ভ্যাকসিন অক্সফোর্ড, চীন, ভারতসহ অনেক দেশ সাফল্যের পথে বলছে। আমাদের বায়োটেকের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আসিফ মাহমুদও আশাবাদী, যেখানে তাঁকে সফল না হলেও বীরত্বের অভিবাদন জানানোর কথা সেখানে বিকৃতরা বিতর্ক করে! অসুস্থ সাবেক মন্ত্রী সাহারা খাতুনকে ব্যাংকক নেওয়া হয়েছে। বড় শিল্পপতি এভারকেয়ারে লড়ছেন, আরেক হাসপাতালের মেশিন নেওয়া হয়েছে। ওবায়দুল কাদের যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন সেখানে মেশিন প্যাকেটবন্দী অকেজো। সাপোর্ট দিয়েছে ল্যাবএইড। মানুষের দোয়া, আল্লাহর রহমত, প্রধানমন্ত্রীর চেষ্টায় সিঙ্গাপুর হয়ে ফিরে আসা। মানে দেশের সরকারি হাসপাতাল তো বেহালই, বেসরকারিতেও আস্থা নেই। ডাক্তার আছেন, ডায়াগনস্টিক কই? দক্ষ নার্স টেকনিশিয়ান কই? ব্যবস্থাপনা কই? সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার নার্স সবকিছুর সংকট। রাজনৈতিক সরকারকে এ ভয়ঙ্কর কঠিন সময়ে রাজনৈতিক অভিজ্ঞ দক্ষ নেতৃত্বকে আজ কাজে লাগানোর সময়। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিমের মতো অভিজ্ঞ নেতাদের ঘরে বসিয়ে রাখার সময় নয়। আমির হোসেন আমুর মতো দাপুটে নেতারা বারবার আসেন না। দক্ষ মেধাবী তোফায়েল আহমেদ ওয়েলকানেকটেড। গুড ম্যানেজার। হতে পারতেন এ সময় রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার ক্রাইসিস ম্যানেজার। এঁরা প্রবীণ। মাহবুব-উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম এমনকি অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত, ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্না এমপি, ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলালসহ অনেককেই এ দুঃসময়ে কাজে লাগানো যায়। একদিকে চিকিৎসাব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ, সিন্ডিকেটের দুর্নীতিমুক্ত করা, আরেকদিকে মনিটরিং করা। আবার সারা দেশে জনগণের দুয়ারে ত্রাণসামগ্রীসহ সর্বাত্মক সহযোগিতা পর্যবেক্ষণ করা। রাজনৈতিক সরকারের সঙ্গে নেতা-কর্মী ও জনগণের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিটা শক্তিশালী করা। নতুবা ক্ষমতা যখন থাকবে না সব তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। মহাজোটগতভাবেও প্রধানমন্ত্রী অভিজ্ঞ সিনিয়র নেতাদের নিয়ে নিয়মিত পরামর্শক মিটিং করতে পারেন। এতে জনমনে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আজকের রাজনীতি, আজকের আওয়ামী লীগকে আমার অচেনা লাগে। যে বয়সে হৃদয়ে কিশোরীর মুখ লালনের কথা সে বয়স থেকেই আমার হৃদয়ে কেবল বঙ্গবন্ধুর ছবি গাঁথা। রাজনীতিবিদরাই ছিলেন তারুণ্যে নায়কের আসনে। বঙ্গবন্ধুই আমার আদর্শ। সে আদর্শের নাম মানুষের প্রতি ভালোবাসা দায়িত্ববোধ। গভীর দেশপ্রেম। এ দেশ আমি ছাড়িনি, আমার সন্তানও ছাড়বে না। মানুষের কথা বলবই। সাদাকে সাদা কালোকে কালো। আমিও হৃদয় ক্ষয়ে এসেছি অনেকটা পথ হেঁটে আজ ক্লান্ত অবসন্ন। ক্ষমতার অন্ধ মোহে অহংকারে ভ্রান্ত পথে যারা হাঁটছেন, মনে রাখবেন শেখ হাসিনা সব সামলে রাখছেন। হেফাজতকেও ম্যানেজ করছেন, জঙ্গিবাদকে দমন, জামায়াতকে কোণঠাসা করেছেন। দেশ সাম্প্রদায়িক শক্তির ওপর। এখানে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের শক্তিতে গণমুখী নির্লোভ দক্ষ নেতৃত্বে সরকার ও দলকে জনগণের শক্তিকে সুসংগঠিত না করলে ক্ষমতা হারালে জাতিকেই চড়া মূল্য দিতে হবে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে নেতা-কর্মীরা দোজখে বাস করবেন। তাই ক্ষমতায় জনগণের মন জয় করেই থাকতে হবে। কেউ যদি মনে করেন বিএনপি শেষ, ভুল করবেন। ’৭০-এর নির্বাচনেও নৌকার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে অনেকে। ’৭১ বিরোধীই নয়, আওয়ামী লীগবিরোধী পাকিস্তানি ধারার শক্তি ক্ষমতা হারালে মাথা তুলবে।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        