বুধবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

লাহোর প্রস্তাব

বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় এবং ভারতীয় নেতাদের মতামত না নিয়ে ভারত সরকারের যুদ্ধে যোগদানের কারণে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা আলোচনা করতে এবং ১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহে  মুসলিম লীগের পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণের জন্য মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪০ সালে লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সাধারণ অধিবেশন আহ্বান করেন।

মুসলিম লীগ কর্মীদের একটি ক্ষুদ্র দল নিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪০ সালের ১৯ মার্চ লাহোরের উদ্দেশে যাত্রা করেন। অধিবেশনে যোগদানের জন্য বাংলার মুসলিম লীগ দলের নেতৃত্ব দেন এ কে ফজলুল হক এবং তাঁরা ২২ মার্চ লাহোরে পৌঁছেন। বাংলার প্রতিনিধি দলকে বিপুল জয়ধ্বনি দিয়ে বরণ করা হয়।

জিন্নাহ তাঁর দুই ঘণ্টার অধিক বক্তৃতায় কংগ্রেস ও জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের সমালোচনা করেন এবং দ্বিজাতিতত্ত্ব ও মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি দাবির পেছনের যুক্তিসমূহ তুলে ধরেন। তাঁর যুক্তিসমূহ সাধারণ মুসলিম জনতার মন জয় করে।

২৩ মার্চ সাধারণ অধিবেশনে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সেটি উত্থাপন করেন এবং চৌধুরী খালিকুজ্জামান ও অন্যান্য মুসলিম নেতা তা সমর্থন করেন। প্রস্তাবটি উপস্থাপনের সময় ফজলুল হক বক্তব্য দেন। লাহোর প্রস্তাব নিম্নরূপ :

ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব এলাকাসমূহের মতো যেসব অঞ্চলে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেসব অঞ্চলে ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ (স্টেটস্) গঠন করতে হবে যার মধ্যে গঠনকারী এককগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম।

বাংলার মুসলমান, যারা উনিশ ও বিশ শতকের প্রথম দিকে নিজেদের আত্মপরিচয় খুঁজে ফিরছিল, পরিশেষে লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে তার সন্ধান পায়। লাহোর প্রস্তাব তাদের একটি জাতীয় চেতনা প্রদান করে। তখন থেকে মুসলিম রাজনীতির প্রধান ধ্যান-ধারণা শাসক শ্রেণি অন্যদের অবিচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর পরিবর্তে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অস্তিত্ব অর্জনের দাবির রূপ পরিগ্রহ করে।

২৪ মার্চ প্রবল উৎসাহের মধ্য দিয়ে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। কংগ্রেস সমর্থক সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রসমূহ লাহোর প্রস্তাবকে ক্যামব্রিজে বসবাসরত দেশত্যাগী ভারতীয় মুসলমান রহমত আলী কর্তৃক উদ্ভাবিত নকশা অনুযায়ী ‘পাকিস্তানের জন্য দাবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। ১৯৪০ সালের প্রস্তাবের কোথাও পাকিস্তানের উল্লেখ নেই এবং ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’-এর দাবি জানাতে গিয়ে লীগের মুখপাত্ররা কী চাচ্ছেন সে সম্পর্কে মোটেও দ্ব্যর্থহীন ছিলেন না। কংগ্রেস সমর্থক সংবাদপত্রসমূহ মুসলিম নেতৃত্বকে একটি সুসামঞ্জস্য স্লোগান সরবরাহ করে, যা অবিলম্বে তাদের একটি রাষ্ট্রের ধারণা প্রদান করে। মুসলমান নেতাদের পক্ষে সাধারণ মুসলিম জনগণের কাছে লাহোর প্রস্তাবের ব্যাখ্যা প্রদান এবং এর প্রকৃত অর্থ ও গুরুত্ব হৃদয়ঙ্গম করাতে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারত। কিন্তু কংগ্রেসি সংবাদপত্রসমূহ কর্তৃক প্রস্তাবটিকে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ হিসেবে নামকরণ হওয়ায় সাধারণ মানুষের মাঝে এর পূর্ণ গুরুত্ব জনে জনে প্রচার করার ব্যাপারে মুসলমান নেতাদের অনেক বছরের পরিশ্রম কমিয়ে দেয়। পাকিস্তানের ধারণাটির প্রতি জোর দেওয়ার মাধ্যমে হিন্দু সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রসমূহ একজন আইনজীবীর অত্যধিক শব্দবহুল আচ্ছন্ন বর্ণনাকে উদাত্ত আহ্বানে পর্যবসিত করতে সাহায্য করে।

১৯৪১ সালের ১৫ এপ্রিল মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে লাহোর প্রস্তাবকে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্রে একটি মৌল বিষয় হিসেবে সন্নিবেশ করা হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতা পর্যন্ত এটি লীগের প্রধান বিষয় ছিল। তবে লাহোর প্রস্তাবের যথাযথ বাস্তবায়নের বদলে মুসলিম লীগ পাকিস্তান নামের উদ্ভট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি প্রকারান্তরে যে প্রতারণা করে তার অবসান ঘটে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে।

অপূর্ব আজাদ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর