সোমবার, ৩০ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

রাজনৈতিক শূন্যতায় উত্থান হবে কি সাম্প্রদায়িক শক্তির?

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন

রাজনৈতিক শূন্যতায় উত্থান হবে কি সাম্প্রদায়িক শক্তির?

যদি বলি, বাংলাদেশে এক গভীর রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে, তাহলে রাজনীতি অন্তঃপ্রাণ বাঙালি আমাকে হাই কোর্ট দেখিয়ে দেবেন। বলবেন, ‘মশাই, আপনার চোখে কি ছানি পড়েছে? রাজনৈতিক শূন্যতা কোথায় দেখলেন? কয়েক দিন আগে ১০ দশটি গণশকট পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে দেওয়া হলো। তারপর থেকে রাজনীতির প্রবল দুই পক্ষে যে বাহাস চলছে, সেটি কি আপনার চোখে পড়ছে না?’ সত্যিই তো। জ্বালাও-পোড়াও-ভাঙচুর ছাড়া রাজনীতি জমে নাকি? ক্ষমতার মসনদ কি অতই সোজা? হরতাল ও অবরোধ দিয়ে দিনের পর দিন দেশ অচল করে রাখার তাকত না থাকলে, সিংহাসন তো অস্তগামী সূর্যের মতো মরীচিকা।  

ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ভ্যান্ডালিজম’, সেই ভাঙচুর ও অগ্নি প্রজ্বলনে ভস্মীভূত করার নীতিই বাংলাদেশের কয়েক দশকের রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। গাড়ি পুড়িয়ে, ট্রেনের ফিসপ্লেট তুলে ফেলে, অরাজকতার পিন্ডি চটকিয়ে ক্ষমতায় যেতে হবে; এরপর মসনদে গিয়ে বলতে হবে, ‘ভাইসব, এবার দেশ গড়ার সময়। এখন অরাজকতা করলে, ইজ্জত কা সওয়াল। আমরা না শান্তিপ্রিয় জাতি!’ এটা সত্যিই আফসোসের যে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব পরবর্তী সময়ে সারা বিশ্ব যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের দিকে এগোচ্ছে, তখনো আমাদের রাজনীতিতে ক্ষমতায় যাওয়ার অনুঘটক হচ্ছে ভ্যান্ডালিজম! প্রবল শক্তিধর যে সব রাজনৈতিক পক্ষ পালাবদল করে ক্ষমতায় আসা যাওয়া করেন, তাদের চেতনা, উপলব্ধি ও দৃষ্টিভঙ্গিতে এখনো দৃঢ়ভাবে কায়েম আছে ভাঙচুর ও জ্বালাও-পোড়াওর জেহাদি জোশ।

অনেক মূল্যের বিনিময়ে বাঙালি কখনো কখনো গণতন্ত্র পেয়েছে বৈকি? কিন্তু কতিপয়তন্ত্রের বুজরুকির চোটে গণতন্ত্র বেশি দিন টিকতে পারেনি, আর মানুষের অধিকার ঢুকে গেছে কফিনের মধ্যে। তবে বাঙালিও নাছোড়বান্দা। গণতন্ত্রের জন্য তাদের সংগ্রাম নিরন্তর। সেই বেনিয়া ব্রিটিশের আমল থেকে তারা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছে। স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরেও ‘গণতন্ত্র’ নামের সোয়াচান পাখি পোষ মানছে না। গণতন্ত্রের কি বাঙালির সঙ্গে কোনো রেষারেষি আছে? 

আমার প্রায়শই মনে হয়, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মুক্ত আকাশে ওড়বার মতো ডানা নেই, প্রাণভরে বিশুদ্ধ বাতাস নেওয়ার মতো শক্তিশালী ফুসফুসও নেই। সোনার প্রাসাদে পাইক-পেয়াদা-বরকন্দাজ পরিবৃত হয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাতাসে আধো আলো-আঁধারির স্বপ্নিল পরিবেশ ছাড়া বাংলাদেশের গণতন্ত্র বেঁচে থাকতে পারে না। পাঁচিল ঘেরা নিবাস, তারকাঁটার আলয় ও মার্বেল পাথরের প্রাসাদের মধ্যে বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুষ্ট হয়ে ওঠে; উর্দিপরা বরকন্দাজদের সার্বক্ষণিক পাহারা ছাড়া এ গণতন্ত্র নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র এতটাই নাজুক যে, ৫০ বছর পরেও তাকে চারপাশ থেকে ৭০ অনুচ্ছেদের কংক্রিটের প্রাচীর বসিয়ে পাহারা দিয়ে রাখতে হয়। তাহলে ৫০ বছরে গণতন্ত্রের কী চর্চা হলো? গণতন্ত্রের সিপাহিরা বলবেন, ১৫ বছর তো সামরিক শাসনেই চলে গেল। বেশ মানলাম। বাকি ৩৫ বছরে গণতন্ত্র কতটা এগোল, সে প্রশ্ন কি করা যায়? 

গণতন্ত্রের পেয়াদারা আবারও বলে বসবেন, “ভাই, আপনি কি কালা হয়ে গেছেন?” শোনেননি, আমাদের মহামান্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে বলেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল পাঁচ দিনেও দিতে পারে না, আর বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন মাত্র ১০ মিনিটে ফলাফল দিয়ে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কি উচিত নয় তাদের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বঙ্গমুল্লুকে পাঠিয়ে নির্বাচন বিষয়ক বুজরুকির প্রশিক্ষণ নেওয়া? অনেকেই অবশ্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়ে লিখেছেন, বাংলাদেশের মহামান্য (!) প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ভাড়া করতে পারলে, ট্রাম্প কোনো পেরেশানি ছাড়াই বিপুল ভোটে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হয়ে যেতেন।

একদম গোড়ায় রাজনৈতিক শূন্যতার কথা বলেছিলাম। আরও স্পষ্ট করে বললে, আদর্শিক রাজনীতির শূন্যতা। নদীতে স্রোত না থাকলে যেমন শৈবালের জন্ম হয়, রাজনৈতিক শূন্যতায়ও তেমনি বেড়ে ওঠে পরগাছা ও আগাছা। কোনো শূন্যতায়ই অপূর্ণ থাকে না; আর রাজনৈতিক শূন্যতা এমন এক নির্বাত অবস্থা যা আকর্ষণ করে পতঙ্গ ও পঙ্গপাল। সাম্প্রদায়িক পঙ্গপালেরা এগিয়ে আসছে রাজনীতির নির্বাত অবস্থা পূরণ করার জন্য। ইতিমধ্যে গুজব ছড়িয়ে তারা একজনকে অঙ্গার করে দিয়েছে, বিশ্বসেরা ক্রিকেটারকে হত্যার শমন পাঠিয়েছে এবং হুঙ্কার দিয়ে বলেছে, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হবে। 

বাঙালি এক রাজনীতি-পাগল জাতি। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এ জাতির পাগলামি উন্মাদনায় পরিণত হয়েছে। পাকিস্তান তো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পূর্ব বাংলার মুসলিমদের রাজনৈতিক উন্মাদনার কারণে। সেই পাকিস্তান রাষ্ট্রকে আত্মসাৎ করে নিজেদের কব্জায় নিয়ে নিল সামরিক বাহিনী, সঙ্গে রইল সিভিল আমলা, ব্যবসায়ী ও পাঞ্জাবি এলিট। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগের একই ভেষজ ব্যবস্থাপত্রের প্রয়োগ যখন বাংলাদেশেও দেখতে পাই, মনটি কাতর হয়ে ওঠে। পাকিস্তান নামের নতুন উপনিবেশে কায়েম হলো শোষণ, বৈষম্য ও ধর্মীয় হেজিমনি। বাঙালির মধ্যে আবার পাগলামির লক্ষণ প্রকাশ হতে শুরু করল। রাজনীতির পাগলামি। রাষ্ট্র ভেঙে ফেলার পাগলামি।

রাজনীতি-উন্মাদ বাঙালি ভাষার জন্য জীবন দিল, ‘উন্নয়নের রাজনীতির বরপুত্র’ আইয়ুব খানকে বিদায় করে দিল গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে, আর বুকের মধ্যে রেখে দিল রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন ও জীবনানন্দকে। মুক্তিযুদ্ধ করে সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরেও বাঙালি জাতির উন্মাদনা থামেনি। তারা সাম্যমাদী রাষ্ট্র চায়, যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না, নিশ্চয়তা থাকবে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার। বঙ্গবন্ধুর মতো জাতীয়তাবাদী ও বিশুদ্ধ দেশপ্রেমিক নেতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হাজার হাজার মেধাবী যুবক নেমে পড়ল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। কিন্তু বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কি অত সোজা? সনাতন সামরিক বাহিনী, ব্রিটিশ আমলাতন্ত্র ও পুলিশ রেখে, শুধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঘাঁটি গেড়ে, জনগণকে প্রস্তুত না করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব? সেটি মাটির প্রদীপের নক্ষত্র স্পর্শ করার মতোই অসম্ভব। বাংলাদেশেও সেটি হয়নি। 

আন্দোলন ব্যর্থ হতে পারে, বিপ্লব নস্যাৎ হয়ে যেতে পারে; কিন্তু বিপ্লবের চেতনা অবিনশ্বর। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার চেতনাটি গুরুত্বপূর্ণ। কয়েকশ বছর আগে থেকেই আমরা এ ভূখন্ডে নানা বিদ্রোহ ও প্রতিবাদের আখ্যানের বর্ণনা পাই। কৃষক বিদ্রোহ, নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, তিতুমীর ও দুদু মিয়ার আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তানবিরাধী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম-বাঙালির শত বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের এ এক অনন্য ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা।

বাঙালির, মানে বাংলাদেশ নামক দেশটির রাষ্ট্রীয় ভূখন্ডে যাদের বসতি, তাদের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস শত বছরের, সেই সূত্রে এ ভূখন্ডের জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক চেতনাও একটি ধারাচ্ছিন্ন বিষয়। ভরসাটি সেখানে। মুক্তিযুদ্ধের আগে পরে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম হয়েছে, সমাজতন্ত্রের জন্যও জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছেন হাজার হাজার কৃষক-শ্রমিক ও মেধাবী শিক্ষার্থী। ফলে গণতান্ত্রিক নীতিমালার সঙ্গে সঙ্গে সমাজতন্ত্রের অনেক জের, জবর ও নোক্তা ঢুকে গেছে বাংলাদেশের সংবিধানে। 

মুক্তিযুদ্ধের আগে পরে যত বড় বড় আন্দোলন হয়েছে, তার পেছনে ছিল বড় বড় আদর্শ-কোনোটি উপনিবেশবিরোধী, কোনোটি ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার, কোনোটি গণতন্ত্র অথবা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার, কোনোটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য। সব আন্দোলন যেমন সফল হয়নি, তেমনি নির্বাচনের পরে প্রার্থী ও দল কথা না রাখায় মুলতবি হয়ে গেছে ন্যায্য অনেক দাবি দাওয়া; আর তামাদি হয়ে গেছে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা। তবে বাঙালি দমে যায়নি। আকাক্সক্ষার বাস্তবায়নের জন্য তারা গড়ে তুলেছিল গণজাগরণ মঞ্চ ও কোটা সংস্কার আন্দোলন। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার জন্য শত শত শিশু-কিশোর রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে শামিল হয়েছিল, স্থাপন করেছিল এক অনন্য বৈশি^ক নজির।

সনাতন কাঠামোবদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলো অনেক ক্ষেত্রে জনআকাক্সক্ষাকে ধারণ করতে পারছে না। ফলশ্রুতিতে বছর ছয়েকের মধ্যে তিনটি অভূতপূর্ব আন্দোলন দানা বেঁধে উঠল। তিনটি আন্দোলনই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, অন্যায়ের প্রতিকারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং এগুলোর কোনো সুবিন্যস্ত কাঠামো ছিল না। স্থায়ী ও সুবিন্যস্ত কাঠামো না থাকায় এসব আন্দোলনের ধারাবাহিকতা পরবর্তীতে আর লক্ষ্য করা যায়নি। এদিকে আদর্শিক রাজনীতির শূন্যতায় শক্তি সঞ্চয় করছে সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলো। ২০১৩ সালে তারা রাষ্ট্রক্ষমতা চ্যালেঞ্জ করেছিল, ২০১৬ সালে তাদের দাবি মেনে রাষ্ট্রকে সরিয়ে ফেলতে হয় রবীন্দ্রনাথের কবিতা, পরিবর্তন করতে হয় নজরুলের কবিতার শব্দ। প্রায় দেড় দশক ধরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায়। কিন্তু সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলো এতটা শক্তি সঞ্চয় করল কীভাবে? তাহলে কী চেতনায় কোনো গলদ আছে? নাকি চেতনার বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়েছে চেতনাবিরোধী শক্তি?

লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

সর্বশেষ খবর