ভেবেছিলাম একটা পরিবর্তন দেখব। মানুষের মাঝে তৈরি হবে সহনশীলতা। হানাহানি-সংঘাত দূর হবে। হিংসা-বিদ্বেষ লোপ পাবে। থাকবে না ভেদাভেদ। অন্যায়-অসংগতিকে না বলবে সবাই। জাগতিক চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশ কষবে না। জীবন শুরু করবে সবাই নতুনভাবে। করোনায় বদলে যাবে সবকিছু। সব ধারণাই আজ ভুল। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা সুজাতা চক্রবর্তীর সেই গানের মতো- ‘ভুল সবই ভুল, এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সে ভুল/... প্রশ্ন করি নিজের কাছে কে আমি, কোথায় ছিলাম কোথায় যাব এই আমি।’ ছবির নাম ছিল ‘অতল জলের আহ্বান’। আগের দিনের গানের অর্থ থাকত। সিনেমায় থাকত কাহিনি। মনের গভীরে দাগ কেটে যেত। হৃদয়ের ভিতরে জমে থাকা শেষ স্মৃতির তোলপাড় হতো। ঝড় বয়ে যেত স্বপ্নের মায়াজাল ছিন্ন করে। এখন কোনো কিছুই দাগ কাটে না। মহামারীও আঘাত হানে না মানুষের ভিতরে বাইরে। সবকিছু বড্ড বেশি সস্তা, হালকা। সম্পর্কের বাঁধনগুলো মুহূর্তে তছনছ হয়ে যায় কাচের চুড়ির মতো। রিনঝিন শব্দ তোলারও সময় পায় না। কঠিনতম এ সময়ে বিশ্বে আজ নেমেছে অদ্ভুত আঁধার। মহামারী আরও খারাপ করে দিয়েছে সবকিছু। বদলে গেছে মানুষ। হিংসা-বিদ্বেষ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। নষ্ট চক্র হার মানিয়েছে অতীতের সব সময়কে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় এক বন্ধু বলেছিলেন, এবার দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। একটা পরিবর্তন আসবে। রাজনীতিবিদরা আর কোনো অন্যায়ের সঙ্গে জড়াবেন না। পরস্পরের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়াবেন না। দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকবে। গণতন্ত্রের চর্চার কেন্দ্র হবে জাতীয় সংসদ। স্বস্তি ও শান্তি ফিরে আসবে। প্রতিষ্ঠানগুলো অর্জন করবে শ্রদ্ধা। পেশাদারিত্ব থাকবে সবখানে। মনটা খারাপ হয়ে যায়। তখন অনেক বন্ধুকে দেখতে যেতাম কাশিমপুর ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। কারও কারও পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিলাম বাড়িতে। আদালতে যেতাম অনেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। পলাতকদের সঙ্গেও কথা হতো ফোনে। কারাগারগুলোয় নেতাদের মাঝে সৌহার্দ্য ছিল। কুমিল্লা কারাগারে ইমামতি করতেন প্রয়াত বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। ঢাকায় রান্নার কাফেলা বসিয়েছিলেন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। খেলাধুলা, আড্ডা আসর জমাতেন সবাই মিলেমিশে। বিশেষ ব্যবস্থায় কারা অন্দরে হিন্দি সিনেমাও চলত। দলবেঁধে সবাই দেখতেন। কেউ কেউ মনোযোগ দিয়েছিলেন ধর্মকর্মে। কারাগারের মসজিদগুলো সংস্কার হয়েছিল রাজনীতিবিদদের অর্থায়নে। দুপুর, রাতের খাবারের টেবিলে নেতারা আলোচনা করতেন ক্ষমতায় এলে মিলেমিশে থাকবেন। কঠোর ব্যবস্থা নেবেন ওয়ান-ইলেভেনের খলনায়কদের বিরুদ্ধে। আবার অনেকে বলতেন জীবনেও রাজনীতি করবেন না। কিন্তু হায়! কী দেখছি এখন? ‘তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম’ সেই গানের মতোই যেন সবকিছু। ইতিহাসকে মনে না রাখাই ইতিহাসের শিক্ষা। আমাদের রাজনীতিবিদরাও এর বাইরে যাবেন কীভাবে?
কেউ বুঝতে চান না দেশে স্বাভাবিক অবস্থা না থাকলে অস্বাভাবিকতা তৈরি হয়। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ আর অবৈধ চিন্তাধারার মানুষের তৎপরতা বাড়ে। নিজেরাই বিভেদের পর্দা টেনে আনে অকারণে। প্রয়াত অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের কথা মনে পড়ছে। তিনি তখন কাকরাইল থাকতেন। এ বাড়িতে মাঝেমধ্যে যেতাম। কুমিল্লার ছেলে হিসেবে একটু বেশি স্নেহ করতেন। খুব কাটকাট কথা বলতেন। মাঝেমধ্যে থাকত স্নেহের ধমকও। একদিন বললাম, স্যার আপনার সেøাগান ধর্ম কর্ম সমাজতন্ত্র। বুঝলাম না পরিষ্কার করে- ধর্ম আর সমাজতন্ত্র! তিনি ধমকের সুরে বললেন, ‘বুঝবে কী করে? মানুষ বোঝো? মানুষকে আগে বুঝতে হবে।’ কথা বাড়ালাম না সেদিন। আজ মনে হচ্ছে ঠিকই বলেছেন। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনোভাব বুঝেই রাজনীতিটা করতে হয়। দেশটা সব মানুষের। সমাজ আছে, ধর্ম আছে, সমাজ বাদ দিয়ে তো রাজনীতি হয় না। শতভাগ অসাম্প্রদায়িক চেতনার রাজনীতিবিদ ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। গণমানুষের জন্য লড়েছেন আমৃত্যু। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার। পাকিস্তান আমলে এক সমাবেশ করতে গিয়ে বাধা পেলেন। সঙ্গে থাকা বঙ্গবন্ধু বললেন, ১৪৪ ধারা মানব না। মওলানা ভাসানী নীরবে মোনাজাত ধরলেন। বাকিটা শোনা যাক বঙ্গবন্ধুর লেখা আত্মজীবনী থেকে- “সভা আরম্ভ হবার সাথে সাথেই ১৪৪ ধারা জারি করা হলো। পুলিশ এসে মওলানা সাহেবকে (আবদুল হামিদ খান ভাসানী) একটা কাগজ দিল। আমি বললাম, ‘মানি না ১৪৪ ধারা, আমি বক্তৃতা করব।’ মওলানা সাহেব দাঁড়িয়ে বললেন, ‘১৪৪ ধারা জারি হয়েছে। আমাদের সভা করতে দেবে না। আমি বক্তৃতা করতে চাই না, তবে আসুন, আপনারা মোনাজাত করুন। আল্লাহুম্মা আমিন।’ মওলানা সাহেব মোনাজাত শুরু করলেন। মাইক্রোফোন সামনেই আছে। আধঘণ্টা পর্যন্ত চিৎকার করে মোনাজাত করলেন, কিছুই বাকি রাখলেন না, যা বলার সবই বলে ফেললেন। পুলিশ অফিসার ও সেপাইরা হাত তুলে মোনাজাত করতে লাগল। আধঘণ্টা মোনাজাতে পুরো বক্তৃতা করে মওলানা সাহেব সভা শেষ করলেন। পুলিশ ও মুসলিম লীগওয়ালারা পুরো বেয়াকুপ হয়ে গেল।” অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের আড়ালের অনেক চিত্রই তুলে ধরেছেন। রাজনীতি অনেকভাবেই করা যায়। কিন্তু সবকিছু ঠিক রেখে কজন তা পারে? জগৎ সংসারে সবকিছু কঠোরতা দিয়ে হয় না। হুমকি-ধমকিতে চলে না। মানুষের মন জয় করতে হয়। মানুষকে জানাতে হয় বাস্তবতা।
কবি নজরুল বলেছেন, ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই/এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনও মন্দির-কাবা নাই।’ নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘যদি তুমি কারও সঙ্গে তোমার ভাষায় কথা বল, তার কাছে যেতে পারবে, যদি তার ভাষায় কথা বল, তার হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারবে।’ বাস্তবে কি সবার হৃদয়ে প্রবেশ করা যায়? মুখ -মুখোশের আড়ালে মানুষের চেহারা ঢেকে আছে এখন। করোনায় মানুষ বাধ্য হচ্ছে মাস্ক পরতে। এতে কারও মুখের ভাব প্রকাশ আর বোঝা যায় না। প্রকৃতি হয়তো বাস্তবতা দেখেই বদলে দিয়েছে বিশ্বকে। অন্ধকার নামিয়ে দিয়েছে চোখ -ধাঁধানো আলোকরশ্মির উচ্ছলতায়। ছোটবেলায় বাবা চিৎকার করে বলতেন মসজিদে যাও। মায়ের কোরআন তিলওয়াতের শব্দে ঘুম ভাঙত। মা পড়তেন, ‘ওয়া লানা-আ’মা-লুনা-ওয়া লাকুম আ’মা-লুকুম, ওয়া নাহনু লাহু মুখলিম্বুন।’ অর্থাৎ ‘আমাদের আমল আমাদের জন্য, আর তোমাদের আমল তোমাদের জন্য। আর আমরা খাঁটিভাবে একমাত্র আল্লাহরই দাসত্ব করছি।’ আমার মা একজন মুক্তিযোদ্ধার মা। আমার ভাইকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। একজন মুক্তিযোদ্ধার বোন, ভাইকে পাঠিয়েছিলেন যুদ্ধে। বোনের ছেলেও বাদ যায়নি। একজন মুক্তিযোদ্ধার খালা তিনি। একাত্তরে সারা রাত প্রার্থনায় বসতেন নিজের সন্তান, ভাই, বোনের ছেলেসহ সব মুক্তিযোদ্ধার কল্যাণ কামনায়। এই বাংলাদেশ ৩০ লাখ শহীদের কষ্টের অর্জন। সে অর্জনের ওপর কোনো ধরনের আঘাত, হানাহানি, সংঘাত মানতে পারব না। সব সময় একটা সহনশীল সমাজ ছিল আমাদের। সে সমাজ এখন কেন প্রশ্নবিদ্ধ? কবি নজরুল একদিকে লিখেছেন ইসলামের জয়গান আরেকদিকে শ্যামাসংগীত। নজরুল ছাড়া ঈদ, রমজান হয় না। আবার পূজাও হয় না। কবি আল্লামা ইকবাল তাঁর যবুর ই আজমে লিখেছেন,
‘কেন জিজ্ঞাসা করছ আমার কথা?
মানুষের কথা ভাব আর দ্যাখ চেয়ে
এই হৃদয় আরও উন্নত হলে পরে
হবে সে মহান স্বর্গধারায় নেয়ে।’
ঈর্ষাপরায়ণ হিংসুটে নষ্ট, ভন্ডরা কারণে অকারণে তৈরি করে বিদ্বেষ। ধর্মের সঙ্গে মানবতার কোনো বিরোধ নেই, কখনো ছিল না। এ দেশেই সারা রাত যাত্রাপালা দেখে ভোরে নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরতে দেখেছি। এখন সে পরিবেশ নেই। একজনের বিপদে ছুটে আসত ১০ বাড়ির মানুষ। এখন সাহায্য-সহযোগিতায় টেনে আনা হয় ধর্ম আর দল। বিভাজনের শেষ নেই। একদল আছে জিহাদি মনোভাবে, আরেক দল কথায় কথায় আক্রমণ করছে আলেম-ওলামাদের। এভাবে হয় না। সম্পর্কটা সবারই সম্মানের হতে হবে। সবাইকে সহনশীল হতে হবে। দীর্ঘদিনের স্বাভাবিক সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে হবে। বাংলাদেশ আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সিরিয়া নয়। যুদ্ধ করে মুক্তিযোদ্ধারাই দেশটা স্বাধীন করেছেন। আর স্বাধীন করেছেন বলেই লম্বা লম্বা কথা বলতে পারছেন সবাই। রাজা উজির মারছেন। কারণে অকারণে সস্তা বিতর্ক তৈরি করছেন। মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার মহানায়ক। ইতিহাস বিকৃতির সুযোগ নেই। বাংলাদেশের সংবিধান, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত নিয়ে আপস হবে না। হতে পারে না। সরকার এ নিয়ে আপস করলে দেশ থাকে না। দেশ না থাকলে সরকার থেকে কী হবে? অসাম্প্রদায়িক চেতনা রক্তের দামে পাওয়া কষ্টের অর্জন। এ অর্জন ম্লান হলে অস্তিত্ব বিলীন হবে। কোনো মহলের আড়াল থেকে উসকানি তৈরির সুযোগ নেই। একজনের দোষের দায় সবার নয়। গণহারে আলেম-ওলামা ও ইসলামের বিরুদ্ধেও কটাক্ষের সুযোগ নেই। বুঝতে হবে, সারা দুনিয়ার সব মুসলিম দেশেই ভাস্কর্য রয়েছে। সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়ায় ভাস্কর্য থাকলে আমাদের সমস্যা কোথায়? ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনির, তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের, পাকিস্তানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাস্কর্য রয়েছে। আগে খোঁজ নিন। ভাস্কর্য আর মূর্তি এক নয়। দুটি সম্পূর্ণ আলাদা। একটির সঙ্গে আরেকটি টানবেন না।
সরকারকে বলছি, বক্তব্য আরও পরিষ্কার করুন। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাজ হয় না। কাজ করতে জেগে থাকতে হয়। দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের সঠিক স্থানে রাখতে হয়। ব্যক্তিত্বহীন, জনবিচ্ছিন্ন, অপরিচিত মুখ নিয়ে সাময়িক চলা যায়। দীর্ঘ সময় নয়। খারাপ সময়ে জনবিচ্ছিন্ন, ভোট মোকাবিলা না করা মানুষ লেজ গুটিয়ে বসে থাকে। চারপাশে ইতিবাচক পরিবেশ নষ্টের চেহারা দেখছি। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্বের হুমকি দেখছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ঘুরে দাঁড়াতে হবে। দেশের ইতিবাচক চিন্তাধারার আলেম-ওলামাদের সঙ্গে রাখুন। রক্তের অর্জন বিসর্জন দিলে চলবে না। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অবিচল অবস্থানে থাকতে হবে। সব আস্ফালনের লাগাম টানতে হবে কঠোরভাবে। অবশ্যই বাংলাদেশ চলবে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত সংবিধানের ভিত্তিতে। কারও হুমকিতে মাথা নত হয়ে নয়।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।