ইতিহাসের পাতায় পাতায় জ্বলজ্বল করে লেখা আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শীর্ষ সংগঠক, বঙ্গবন্ধু আদর্শের একনিষ্ঠ সৈনিক আবদুর রাজ্জাকের নাম। তিনি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নির্লোভ, সৎ, ত্যাগী, সাহসী, স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী এবং সফল রাজনীতিবিদদের নাম উচ্চারণে জনমনেই প্রথম ভেসে ওঠেন আবদুর রাজ্জাক। ছিলেন তিনি ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’। আর সেই চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পেরেছিলাম তাঁরই প্রেরণায়। কখনো শিশুর মতো, কখনো বাবার মতো, কখনো ভাইয়ের মতো, কখনো বন্ধুর মতো থেকেছেন তিনি। সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন তিনি আজীবন দেখেছেন এবং আমাদের মধ্যে তা সঞ্চারিতও করেছেন। ব্যক্তিত্বে, রুচিবোধে, সততা, নিষ্ঠা, জ্ঞানে ও প্রজ্ঞায়, সৌজন্যে এবং উদারতায় আবদুর রাজ্জাক রাজনীতির জগতে এক অনুপম ও অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত। বৃহত্তর পরিধিতে দেশ-সমাজের কথা ভেবেছেন এবং দেশ-সমাজের উন্নতির জন্য কাজও করেছেন। পরিশ্রম ও আত্মত্যাগের ব্রত ছিল জীবনভর। শোষিত-বঞ্চিত মানুষের সুখ-দুঃখ, কল্যাণ ও মঙ্গলে থেকেছেন পাশে পাশে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে থেকেছেন, সাধারণের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা ভেবে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। দুঃশাসনের বিরুদ্ধে, সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে একাগ্রচিত্তে লড়াই করেছেন। চরিত্র, আচার-আচরণ, কর্মকান্ড, আদর্শ সব মিলিয়ে আবদুর রাজ্জাক পরিণত হয়েছিলেন জননেতায়।
রাষ্ট্র ও সমাজে অন্যায়, অনিয়ম, বৈষম্য ও শোষণ তাঁকে প্রতিবাদী হতে প্রেরণা জুগিয়েছে। পাশাপাশি মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়েছেন। ছাত্রজীবনেই আবদুর রাজ্জাক স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে যোগ দেন। নিষ্ঠাবান, কর্মকুশল, একাগ্রচিত্ত আবদুর রাজ্জাকের পুরো জীবনটাই কেটেছে সংগ্রামে-আন্দোলনে, কারাগারে, স্বাধীনতাযুদ্ধ ও দেশ গড়ার মহান ব্রতে। যে আদর্শ নিয়ে স্বাধীন দেশে পথচলা শুরু করেছেন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার যে শপথ নিয়েছিলেন, সে পথে তিনি সংগঠিত করেছিলেন সাংগঠনিকভাবে দলকে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে দলকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন জাতির পিতার নির্দেশ পালন করে। পরে বাকশালের সম্পাদক হিসেবে জাতির পিতার দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচি সাফল্যমন্ডিত করার প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়েছিলেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতার নির্মম হত্যাকান্ডের পর প্রায় দীর্ঘ আড়াই বছর তিনি কারাবন্দী থাকেন। দলের নেতা-কর্মীরা যখন দিশাহারা সে সময় তিনি জেলে বসেই দলকে সংগঠিত করার জন্য, জাতির পিতার হত্যার বদলা নেওয়ার জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করে দল পরিচালনা করতেন। পঁচাত্তর-পরবর্তী যে দুঃসময় গেছে, যে দুর্যোগ ঘটেছে জাতীয় জীবনে, সামরিক জান্তার শোষণ-নিপীড়নে ছাত্রলীগের কর্মীরা যখন অসহায়-দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন, তখন সেই পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য ছাত্রলীগ কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছিল। তা করার জন্য কারাগার থেকে তিনি আমাদের যাবতীয় দিকনির্দেশনা দিতেন সব সময়। আর দিকনির্দেশনা দিতেন জেল থেকেই। পঁচাত্তর-পরবর্তী ক্ষমতা দখলকারীরা নানা প্রচেষ্টা চালিয়েও তাঁকে তাদের অনুগত করতে পারেনি। শত নিপীড়নেও তিনি কাবু হননি, মাথা নত করেননি। বঙ্গবন্ধুর দীক্ষাই তাঁকে দুঃসাহসী করে তুলেছিল। তাই নিঃশঙ্কচিত্তে তিনি শত নির্যাতন-প্রতিকূলতা উপেক্ষা করেছেন। সুবিধাভোগী বা সুযোগসন্ধানী হওয়ার অভিলাষের কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করেননি। জেল থেকে মুক্তি পেয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আওয়ামী লীগের দিগ্ভ্রান্ত কর্মীদের আবারও সংগঠিত করে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত দলে পরিণত করার কাজে। মনে পড়ে সেই দিনটির কথা যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। আজ থেকে প্রায় ৪৮ বছর আগের কথা। আমি তখন সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র। আর তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমন্ডলীর একজন সদস্য। কেন্দ্রীয় নেতা এবং বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত ও কাছের মানুষ হিসেবে বলা চলে তখন তিনি দোর্দ- প্রতাপশালী একজন নেতা। ঢোলা পাঞ্জাবি-পায়জামা আর স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরা সাদাসিধে চালচলনের সেই নেতাকে দেখে আমি যারপরনাই বিস্মিত হয়েছিলাম। আমার কাছে বড় নেতা মানে মনে হতো জাঁকালো বেশভূষার কোনো একজন মানুষ। তাঁকে দেখেই সেদিন ভেঙে গেল আমার সেই ভ্রান্ত ধারণা। ওই দিন আমার কাছে তাঁকে মনে হয়েছিল একজন ঋদ্ধ-সিদ্ধ পুরুষ। আমাকে যখন রাজেন্দ্র কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো তখন তিনি আমাকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন পরম মমতায়। তাঁর আবেগ-ভালোবাসা আমাকে মোহমুগ্ধ করেছিল। একজন সাধারণ কর্মীকে যিনি এত আপন করে বুকে টেনে নিতে পারেন, তিনি যে অনেক বড় মনের একজন নেতা, সেদিনই প্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। এরপর তো প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেই প্রমাণ পেতাম। কর্মীদের প্রতি রাজ্জাক ভাইয়ের ছিল অপরিসীম ভালোবাসা-দায়িত্ববোধ। কর্মীপ্রাণ এমন নেতা খুঁজে পাওয়া ভার। কোনো কর্মী বিপদে পড়লে তিনি ছুটে আসতেন সবার আগে। আন্দোলন-সংগ্রামে কোনো কর্মী যদি গ্রেফতার হতেন, তার মুক্তির জন্য যত ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায় সবই নিতেন। জেলে থাকা অবস্থায় কর্মীরা যেন দুঃসহ কষ্ট ভোগ না করে সেদিকেও ছিল তাঁর নজর। তাঁর চিন্তা-চেতনায় কর্মীদের মঙ্গল কামনা ছিল বিরাজমান। রাজ্জাক ভাই ছিলেন দলের নেতা-কর্মীদের বিশ্বাস ও আস্থার কেন্দ্রস্থল। সেই বিশ্বাস ও আস্থা ছড়িয়ে পড়েছিল আপামর জনসাধারণের মাঝে। কর্মনিষ্ঠা, কর্মকুশলতা ও আদর্শের প্রতি একনিষ্ঠ কর্মী হয়ে নিরলস শ্রমের মাধ্যমে তিনি নিজেকে জনগণের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনা ধারণকারী জনকল্যাণকামী একজন নেতা হিসেবে। মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায়ও তিনি দেশ, জাতি, রাজনীতি নিয়ে ভাবনার কথা বলেছেন। রাজ্জাক ভাই আজ আমাদের মাঝে নেই।
লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।