বুধবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

কাজী আরেফ আহমেদ স্মরণে

রওশন জাহান সাথী

কাজী আরেফ আহমেদ স্মরণে

কাজী আরেফ আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অন্যতম রূপকার। এ বছর তার ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার কালিদাসপুর স্কুলমাঠে জনসভা চলাকালে তাঁকে হত্যা করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান যখন শোষণ-বঞ্চনা-নির্যাতনে জর্জরিত-দিশাহারা তখন ষাট ও সত্তর দশকের তরুণরা মাতৃভাষা, মাতৃভূমি ও বাঙালির স্বার্থ রক্ষায় নিবেদিত হয়েছিল আপসহীন লড়াইয়ে, আত্মোৎসর্গের প্রতিজ্ঞা উৎসারিত হয়েছিল তাদের হৃদয় থেকে। এমন অনন্য তরুণদের একজন ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ।

রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী কর্মসূচি প্রণয়ন ও তা সফলভাবে মাঠের আন্দোলনে পরিণত করা তীব্র ধীশক্তির বিষয়। দূরদর্শী কাজী আরেফ ছিলেন এ কাজে সিদ্ধহস্ত। সবাইকে নিয়ে কাজ করার প্রবণতা যেমন তাঁর ছিল, তেমনি সাময়িক ব্যর্থতায় পিছিয়ে না যাওয়ার অনড় মনোভাবও ছিল। কার্ল মার্কসের ঐক্য-দ্বন্দ্ব-ঐক্যের সূত্রেই তিনি আস্থা রেখেছেন বরাবর।

বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র নামের যে বইটি অসমাপ্ত পা-ুলিপির ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত হয়েছে তাতে তৎকালীন ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিষয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ জানা যায়। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন-শোষণ-বঞ্চনার সেই কালে বাঙালির জাতীয় পরিচয় রক্ষায় তৎপর ছাত্রলীগের ভূমিকা সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে।

১৯৬৬ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ তথা জাতীয়তাবাদী প্রগতিশীল ছাত্রসমাজের উদ্যোগে সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। ছাত্রলীগের এমন কর্মসূচির প্রভাবে গাড়ির নম্বর, বাড়ির নামফলক, দোকানের সাইনবোর্ড বাংলায় লেখার সচেতনতা তৈরি হয়। পোস্ট অফিসের বদলে ডাকঘর, রোল নম্বরকে ক্রমিক মান, ক্লাস রুমকে শ্রেণিকক্ষ লেখার প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে চোখে পড়তে থাকে। বাংলা ভাষাকে স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার এ প্রচেষ্টার একজন সংগঠক ছিলেন কাজী আরেফ। তিনি তখন ঢাকা শহর ছাত্রলীগের সভাপতি।

বাঙালির মুক্তিসনদ ছয় দফা উত্থাপিত হয় ১৯৬৬ সালে। কিন্তু তা আগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে উত্থাপিত হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক মুদ্রা, বৈদেশিক মুদ্রার নিয়ন্ত্রণ, আধাসামরিক বাহিনী প্রদান ইত্যাদি দফাসংবলিত ছয় দফা দাবি যদি তৎকালীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে উপস্থাপিত হতো তাহলে তার ভবিষ্যৎ কী হতো তা নিয়ে আরেফ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তাঁর লেখায়।

কাজী আরেফ আহমেদ লিখেছেন, ‘আমি তখন ঢাকা শহর ছাত্রলীগের সভাপতি। ঢাকা শহর কমিটির মিটিংয়ে অনেকের অনেক বিরোধিতার পর ছয় দফার সমর্থনে প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যথাক্রমে আমার ও আবুল কাসেমের নামে পত্রিকায় বিবৃতি যায়। ছয় দফার প্রতি আমাদের সমর্থন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যে বেশ প্রভাব ফেলে।’

‘সে সময় অনেকেই বলেছিলেন এ কর্মসূচিতে দেশটাকে ভাঙতে বিদেশি হাত আছে। আবার কেউ কেউ সিআইএর দেওয়া কর্মসূচি বলেও আখ্যা দিয়েছিলেন। যারা এ সমস্ত কথা বলেছিলেন, তারা আর যা-ই করে থাকুন না কেন মূলত পাকিস্তানিদের পক্ষেই কথা বলেছিলেন। রাজনীতিবিদ ও প্রগতিশীল দলের লোকেরা যারা এর বিরুদ্ধে বলেছিলেন তারা ভুল রাজনীতির আবর্তে আটকে থেকে অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ষড়যন্ত্রের কর্মসূচি কখনো প্রচারসর্বস্বতা বা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের পরিধি ডিঙিয়ে মাঠের কর্মসূচিতে পরিণত হতে পারে না।’

নানামুখী বিরোধিতার শিকার ছয় দফার সমর্থনে প্রকাশ্যে মিছিল বের হয়েছিল কাজী আরেফ আহমেদের নেতৃত্বে। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বের হওয়া সে মিছিল জনমনে প্রবল সাড়া জাগিয়েছিল।

পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে ২৪ বছরের ধারাবাহিক আন্দোলনের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি করেছিল ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। এ মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ অভিযুক্তদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং মামলার বিরুদ্ধে জনগণের প্রবল প্রতিরোধ স্বাধিকার আন্দোলনকে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপান্তরের অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বন্দী অবস্থায় বিমানবাহিনীর সার্জেন্ট জহুরুল হককে ঢাকা সেনানিবাসে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী গুলি করে হত্যা করে।

এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ১৬ ফেব্রুয়ারি জহুরুল হকের লাশ নিয়ে মিছিল বের হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা একে একে পাকিস্তানের শিক্ষা ও তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিনের বাসভবন, কাউন্সিল মুসলিম লীগের প্রাদেশিক সভাপতি খাজা খয়েরউদ্দীনের বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়। ‘লক্ষাধিক মানুষের মিছিলকে আমরা আমরা আগরতলা মামলার ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এস এ রহমানের বাসভবনের দিকে নিয়ে যাই। উত্তেজিত জনতা তখন সেই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিচারপতি এস এ রহমান কোনোমতে বাসায় কর্মরত লোকজনদের সঙ্গে মিশে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছায় এবং চিরদিনের জন্য করাচি পাড়ি জমায়। ওই দিন জনতা নীলক্ষেত ও বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ি এবং বায়তুল মোকাররমের দুটি আগ্নেয়াস্ত্রের দোকান লুট করে। মিছিলসহকারে জনতা অস্ত্রগুলো আমাদের হাতে তুলে দেয়। পরবর্তীতে আগরতলা মামলা আর পরিচালনা সম্ভব হয়নি।’

সেদিনের সেই ঘটনাপ্রবাহ ও ছাত্রনেতাদের বিপুল তৎপরতা আগরতলা মামলাকে একটি শক্তিশালী বিস্ফোরকে পরিণত করে। আমি মনে করি তা জনগণকে সশস্ত্র যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল।

১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ ঐতিহাসিক গণআদালত আয়োজিত হয়েছিল। শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তানি দালালদের বিচার দাবিতে সৃষ্টি হয়েছিল গণজোয়ার। সহধর্মিণী ও রাজনৈতিক সহযোদ্ধা হিসেবে এ সময় আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি কাজী আরেফ আহমেদের দৃঢ়তা। সারা দেশের স্বাধীনতার পক্ষের সংগ্রামী জনতা, ছাত্র ও তরুণ সমাজকে এক কাতারে আনতে তিনি অতুলনীয় ভূমিকা রেখেছিলেন।

বিএনপি-জামায়াত শত বাধা সৃষ্টি করেছিল। আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যেও গণআদালতের ভবিষ্যৎ নিয়ে দ্বিধা তৈরি হয়েছিল। এমন অবস্থায় কাজী আরেফ বলেছিলেন, ‘১০ জন নিয়ে হলেও গণআদালত অনুষ্ঠিত হবে। কেউ ঠেকাতে পারবে না।’ আমিও সেদিন ছিলাম সেখানে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি আয়োজিত গণআদালত স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক মাইলফলক। আন্দোলনটি বাংলাদেশের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। সে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আজ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচার হচ্ছে।

কাজী আরেফ ও মণি ভাই (মার্শাল মণি) আমার রাজনৈতিক শিক্ষক ছিলেন। অনেক কঠিন তত্ত্ব তাঁরা অনেক সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন। তাঁদের সাবলীলতার কারণে সাহস করে অনেক প্রশ্ন করতে পারতাম। এমন নেতাদের রাজনৈতিক কর্মী হতে পারা আমার জন্য গর্বের।

আট, সাত ও পাঁচ-দলীয় জোটের যুগপৎ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল কাজী আরেফ আহমেদের। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক দেশ প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন অবিচল। ব্যক্তিগত মোহ দেখিনি কখনো। তবে যথার্থ মূল্যায়ন না পাওয়ায় আক্ষেপ ছিল তাঁর।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর কাজী আরেফ আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর নিজের দল জাসদ ও পাঁচ-দলীয় জোটের শরিকরা একমত হতে পারেনি। কাজী আরেফ দূরদর্শী ছিলেন। সেদিন নির্বাচনী ঐক্য হলে আজ জাতীয় রাজনীতিতে অনেক বেশি কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আসত বলে মনে করি। যিনি আন্দোলন রচনাকারী তিনি সবার চেয়ে এগিয়ে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে বাস্তবতা উপেক্ষা করে কালক্ষেপণ রাজনৈতিক ভুল, যার মাশুল দিতে হয়।

১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ। কুষ্টিয়া-১ আসনের দৌলতপুর ছিল তাঁর নির্বাচনী এলাকা। সেখানে তাঁর বাড়ি নয়। তাঁর বাড়ি মিরপুর উপজেলার কুচবাড়িয়ার খয়েরপুর গ্রামে। হাশেমদৌলা হাসু চেয়ারম্যানের বাড়িতে থেকে তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। অচেনা জায়গা থেকে নির্বাচনে দাঁড়ালে জিততে পারবেন না বুঝেও দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলেন। গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠার জন্য তিন জোটের রূপরেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নিশ্চিত পরাজয়কে আন্দোলনের অংশ হিসেবে নিয়েছিলেন।

১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি দৌলতপুরের কালিদাসপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় কাজী আরেফ আহমেদকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেই নৃশংস হত্যাযজ্ঞে আরও প্রাণ হারান লোকমান হোসেন, ইয়াকুব আলী, শমসের মন্ডল ও ইসরাইল হোসেন। আমি তাঁদের সবাইকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।

সেদিনের ওই সভা পরিচালনা করেছিল তৎকালীন তরুণ নেতা কারশেদ আলম। হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ও মামলার সাক্ষী হওয়ায় সেসহ অন্যরা এখনো হুমকির মধ্যে রয়েছে। মৃত্যুদন্ডসহ অন্যান্য সাজা পাওয়া আসামিরা এখনো ওই অঞ্চলে অবাধে বিচরণ করছে। সাজাপ্রাপ্ত আসামি মান্নান মোল্লা অবাধে তৎপরতা চলাচ্ছে। কাজী আরেফ আহমেদের ২২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে অভিযুক্ত সবার শাস্তি কার্যকরের দাবি জানাচ্ছি।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

সাবেক সভাপতি, মহিলা শ্রমিক লীগ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর