রবিবার, ২৩ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

শিশু অধিকার সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

এম এ মান্নান

শিশু অধিকার সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

আজকে যে শিশু সে আগামী দিনে পরিবার, সমাজ ও দেশের কান্ডারির ভূমিকা পালন করবে। শিশুকে আমরা কীভাবে গড়ে তুলব তার ওপর পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির কল্যাণ জড়িত।

রসুল (সা.) প্রেরিত হয়েছিলেন মানব জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে পরিচালিত করার জন্য। শিশুদের জন্যও রয়েছে তাঁর মূল্যবান নির্দেশনা। আমরা জানি, মানবশিশু জন্মলাভ করেই কথা বলতে পারে না। হাঁটতে বা চলতে পারে না। নিজের ভালো-মন্দ সে বোঝে না। তাকে গড়ে তুলতে হয় তিলে তিলে। শিশুকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে অভিভাবকদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। এটা শিশুর প্রতি বাবা-মা ও মুরব্বিদের দায়িত্ব। শিশুর প্রাপ্য হক। ইসলাম এ হক পালনে বাবা-মা ও স্বজনদের তাগিদ দিয়েছে।

সবারই জানা, আমরা সবাই একসময় শিশু ছিলাম। আমাদের মা-বাবা শিক্ষক মুরব্বি সবার পরিচর্যায় আমরা বর্তমান অবস্থায় এসেছি। আমাদের মধ্যে যারা এখন ভালো অবস্থানে আছি, যদি আমরা আমাদের মা-বাবা মুরব্বি, শিক্ষকসহ অন্যদের কাছ থেকে যথাযথ পরিচর্যা ও সুশিক্ষা না পেতাম তবে আমাদের অবস্থা কোথায় থাকত তা চিন্তা করলে অনুভব করা যায়। শিশুকালে সুশিক্ষা ও পরিচর্যা পাওয়া শিশুর আল্লাহ-প্রদত্ত অধিকার। ইসলামে এটি ‘হুকুফুল আতফাল’ বা শিশু অধিকার হিসেবে বলা হয়। আমরা জানি, কৃষক যখন ফসল বোনে তখন বীজতলায় সঠিকভাবে পরিচর্যার মাধ্যমে চারা সৃষ্টি করে। চারা ভালো হলে ভালো ফসল দেয়। পক্ষান্তরে চারা তৈরির সময় ভালো পরিচর্যা না হলে সে চারায় ভালো ফসল হয় না। কারণ যে চারা পুষ্ট হয় সে চারা ভালো ফসল দেয়। ঠিক তেমনি যদি আমরা শিশুদের সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে পারি তবে আমাদের জাতি একটি সুন্দর ভবিষ্যতের অধিকারী হবে। আমাদের উত্তরাধিকাররা হবে দেশের সুনাগরিক। তারা কোনো অন্যায়ে জড়িত হবে না। জড়িয়ে পড়বে না জঙ্গিবাদ বা উগ্রবাদের ফাঁদে। তারা হবে দেশপ্রেমিক। লাল সবুজ পতাকা ও মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার।

আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে। আল কোরআনে মানুষকে অতি উচ্চমর্যাদা দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি মানুষকে অতি সুন্দর অবয়বে সৃষ্টি করেছি।’ সুরা ত্বিন, আয়াত ৪।

কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি আদম -সন্তানকে (অর্থাৎ মানুষকে) মর্যাদা দান করেছি এবং জলে-স্থলে তাদের আরোহণ করিয়েছি। পবিত্র বস্তু তাদের রিজিক দিয়েছি এবং আমার বহুসংখ্যক সৃষ্টির ওপর সুস্পষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৭০।

মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘আমি মানুষকে মদা মাটির সিক্ত কাদা থেকে সৃষ্টি করেছি।’ সুরা হিজর, আয়াত ২৬।

আরেকটি আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই তো ওই সত্তা যিনি তোমাদের তোমাদের মায়েদের গর্ভে নিজের ইচ্ছামতো আকৃতিতে গঠন করেন। তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।’ সুরা আলে ইমরান, আয়াত ৬।

মানব জাতি সৃষ্টির সেরা। মানুষকে যিনি সৃষ্টি করেছেন এটি তাঁরই ঘোষণা। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরাই সর্বোত্তম জাতি, মানুষের কল্যাণের জন্য যাদের সৃষ্টি করা হয়েছে।’ সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১১০। প্রশ্ন হলো, সব মানুষই তো সৃষ্টির সেরা, তবে এর মধ্যে আল্লাহর কাছে কোন মানুষ প্রিয় হিসেবে বিবেচিত হবে? এ প্রশ্নের জবাবও আল্লাহ নিজেই দিয়েছেন। ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে অধিক খোদাভীরু ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে বেশি সম্মানিত।’ সুরা হুজুরাত, আয়াত ১৩।

সংগত কারণেই শিশু প্রতিপালনে তারা যাতে ইমানদার হয়, আল্লাহর প্রতি নিঃসংকোচ আনুগত্য পোষণ করে এমন শিক্ষা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ইসলামী শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি জীবনমুখী শিক্ষায়ও শিশুদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে। আমাদের দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। শিক্ষার নামে অজস্র প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও তার কোনোটিতে শুধু ধর্মীয় বিষয় শিক্ষা দেওয়া হয়। জীবনমুখী শিক্ষা অনুপস্থিত। ফলে ধর্মীয় শিক্ষা শেষে জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রে সংকটে পড়তে হয়। আবার কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুধু জীবন বা কর্মমুখী শিক্ষা দেওয়া হয়। ধর্মীয় শিক্ষা এবং নৈতিক শিক্ষা উপেক্ষিত হয়। এর ফলে এ শিক্ষার মাধ্যমে যারা গড়ে ওঠে তার অনেকেই নৈতিকতার সংকটে ভোগে। সুনাগরিক বা দায়িত্বশীল নাগরিক বলতে যা বোঝায় তার অভাব অনুভূত হয়।

এ অভাব দূর করতে দেশের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আধুনিকী-করণের বিকল্প নেই। আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। আল্লাহ মানুষকে গোলামি করার জন্য সৃষ্টি করেননি। যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়েছেন তারা আল্লাহর নির্দেশনাই পালন করেছেন। ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় দেশপ্রেম ও দেশের মুক্তিসংগ্রাম সম্পর্কে শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা যেমন জরুরি, তেমন থাকা উচিত সব ধরনের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার সুযোগ। ইসলামের মানবতাবাদী চিন্তাধারার আলোকে শিশুদের গড়ে তুলতে হবে। ইসলামে জ্ঞান অর্জন ফরজ বা অবশ্য -পালনীয় কর্তব্য। জ্ঞান অর্জনের অর্থ শুধু ধর্মীয় জ্ঞান নয়। জীবনের সব ক্ষেত্রে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে শিশুদের গড়ে তুলতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বুঝতে হবে আল্লাহই সব জ্ঞানের উৎস। যা অর্জন করা প্রতিটি শিশুর আল্লাহ-প্রদত্ত অধিকার।

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর