বৃহস্পতিবার, ৩ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

যে কারণে ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ

তপন কুমার ঘোষ

যে কারণে ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ

ডিজিটাল মুদ্রা ‘বিটকয়েন’ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। সম্প্রতি অবৈধ বিটকয়েন ব্যবসার একটি চক্রের সন্ধান পায় দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মূল হোতাকে দলবলসহ গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযোগ, অন্য ব্যবসার আড়ালে গোপনে চলছিল এ অবৈধ বিটকয়েন ব্যবসা। ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে একটি বিশেষ অ্যাপের মাধ্যমে। ২০ মে বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রথম পৃষ্ঠায় ‘অ্যাপসে পাচার হচ্ছে শত কোটি টাকা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ পেয়েছে।

২০০৮ সালে নতুন ধরনের ডিজিটাল বা ভার্চুয়াল মুদ্রার ধারণা দেন একদল সফটওয়্যার বিজ্ঞানী। নতুন এ মুদ্রা ক্রিপ্টোকারেন্সি নামে পরিচিতি লাভ করেছে। বিটকয়েন হচ্ছে প্রথম ক্রিপ্টোকারেন্সি। একজন জাপানি নাগরিক ২০০৯ সালে এটি প্রথম উদ্ভাবন করেন। বিটকয়েনে বাণিজ্যিক লেনদেন শুরু হয় ২০১০ সালে। পরে আরও কয়েকটি ডিজিটাল মুদ্রার প্রচলন হলেও বিটকয়েন সব থেকে বেশি পরিচিতি পেয়েছে। দ্বিতীয় বৃহৎ ডিজিটাল মুদ্রা হচ্ছে ‘ইথেরিয়াম’।

বিটকয়েন বাংলাদেশে কেন নিষিদ্ধ সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে ডিজিটাল মুদ্রা বা ক্রিপ্টোকারেন্সির বৈশিষ্ট্যগুলো একঝলক দেখে নেওয়া যাক। সংক্ষেপে বলা যায়, ক্রিপ্টোকারেন্সি হচ্ছে সাংকেতিক মুদ্রা যা দেখা যায় না, ধরা যায় না বা ছোঁয়া যায় না। এর কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। কম্পিউটারের মাধ্যমে অনলাইনে এর লেনদেন চলে। ইন্টারনেট সিস্টেমে প্রোগ্রামিং করা আছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি ওয়ালেটে জমিয়ে রাখা যায়। ওয়ালেট হলো ব্যক্তিগত ডাটাবেস বা তথ্যভান্ডার যা কম্পিউটার বা অন্য কোনো ডিভাইসে রক্ষিত থাকে। একজনের ব্যক্তিগত ওয়ালেট থেকে আরেকজনের ব্যক্তিগত ওয়ালেটে ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেন করা যায়। ক্রিপ্টোকারেন্সির বিনিময় মূল্য প্রচলিত মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়। কিছু কিছু দেশে সীমিত কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অনলাইন কেনাকাটায় ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েন গ্রহণ করলেও অনেক দেশেই মুদ্রা হিসেবে এখনো স্বীকৃতি পায়নি বিটকয়েন।

বিটকয়েনের বাজার অস্থিতিশীল অর্থাৎ বাজারদর ওঠানামা করে। এতে বাজার ঝুঁকি আছে। বাজারদর ওঠানামার কারণে যে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে তাকে বাজার ঝুঁকি বলা হয়। বিনিয়োগে কমবেশি ঝুঁকি থাকে। যেমন শেয়ারে বিনিয়োগ করলে ঝুঁকি আছে। দাম বাড়তে পারে, আবার দরপতনও হতে পারে। অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম মেনে চাহিদা এবং সরবরাহের ওপর ভিত্তি করে দাম ওঠানামা করে। বিটকয়েনের ক্ষেত্রে বাজারদর ওঠানামার মাত্রা অনেক। ফলে এখানে উচ্চমাত্রার ঝুঁকি আছে। ফুঁৎকারে উড়ে যেতে পারে বিনিয়োগ। সোজা কথায়, পুঁজি হারাতে পারেন বিনিয়োগকারী। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিটকয়েন মাঝেমধ্যেই খবরের শিরোনাম হয়েছে। চড়া দামে বিকোচ্ছে বিটকয়েন। ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ক বিটকয়েনে মোটা অঙ্ক বিনিয়োগের ঘোষণা দেন। তাঁর বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরির প্রতিষ্ঠান ‘টেসলা’ এ খাতে বিনিয়োগের পাশাপাশি ক্রেতাদের কাছ থেকে লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে বিটকয়েন গ্রহণ করবে- প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে এমন ঘোষণা দেওয়ার পর বিটকয়েনের গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায়। বিটকয়েনের বাজারে এর প্রভাব পড়ে। ঘোষণার পর মুদ্রাটির মূল্য রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে এপ্রিলের মাঝামাঝি ৬৪ হাজার ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। বিটকয়েনের সূচনালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত এটাই ছিল সর্বোচ্চ দর। কিন্তু যা ঘটার তা-ই ঘটেছে। বড় ধরনের দরপতন হয়েছে এ ডিজিটাল মুদ্রার। এক মাসের কিছু বেশি সময়ের ব্যবধানে এর দাম কমে ৪০ হাজার ডলারের নিচে নেমে এসেছে। দরপতন ৪০ শতাংশ।

প্রসঙ্গত, গত বছরের শুরুতে বিটকয়েনের বিনিময় মূল্য ছিল ৭ হাজার ডলারের সামান্য বেশি। কপাল খুলতে অথবা পুড়তে খুব বেশি সময় লাগছে না। বৈদ্যুতিক গাড়ির মূল্য বিটকয়েনে গ্রহণ করার ঘোষণা থেকে টেসলা পরে সরে আসায় এবং হাতে থাকা বিটকয়েনের একটা অংশ বিক্রির অভিপ্রায় ব্যক্ত করায় এ দরপতন বলে মনে করা হচ্ছে। এটার মধ্যে ফটকাবাজি থাকতে পারে বলে অনেকের অভিমত। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ক্রিপ্টোকারেন্সির ভিতরে এমন কিছু জটিল বিষয় রয়েছে যা একজন সাধারণ বিনিয়োগকারীর বুঝের মধ্যে আসার কথা নয়। যে কোনো দেশের বৈধ মুদ্রা ইস্যু করার দায়িত্ব ওই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। ডিজিটাল মুদ্রার ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা কোনো সংস্থার। অনিয়ন্ত্রিত ক্রিপ্টোকারেন্সির বাজার জালিয়াতির স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠতে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। এটা ব্যবহার করে মাদক, কালোবাজারি ও অর্থ পাচারের মতো অপরাধমূলক কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ার শঙ্কায় ডিজিটাল মুদ্রায় লেনদেন নিষিদ্ধ করেছে অনেক দেশ।

আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বিটকয়েন ও অন্যান্য ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেন নিষিদ্ধ করেছে অনেক আগেই। ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে জনগণকে এ মর্মে সতর্ক করে দিয়েছে যে ভার্চুয়াল মুদ্রা কোনো দেশের বৈধ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ইস্যুকৃত বৈধ মুদ্রা নয়। ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেন বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত নয়। এসব লেনদেনে আর্থিক ও আইনগত ঝুঁকি রয়েছে। ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেনের আর্থিক দাবির স্বীকৃতি নেই। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির প্রতিকার চাওয়ার কোনো জায়গা নেই। অননুমোদিত ভার্চুয়াল মুদ্রার মাধ্যমে লেনদেন থেকে বিরত থাকার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিতে সর্বসাধারণকে অনুরোধ করা হয়েছে।

লেখক : সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

সর্বশেষ খবর