বর্তমান বিশ্বে সব থেকে আলোচিত ও সমালোচিত বিষয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আফগানিস্তান থেকে তার বাহিনীকে সফলভাবে প্রত্যাহার করে নেওয়া। শতবর্ষ আগে ব্রিটিশরা আফগানিস্তান দখল করেছিল। হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া কেউ ফিরতে পারেনি। চার দশক আগে রাশিয়া আফগানিস্তানে ঢুকেছিল। তাদেরও আফগানিস্তান দখল সুখকর হয়নি। তারপর নাইন/ইলেভেনের অজুহাতে আমেরিকা মাথা দিয়েছিল আফগানিস্তানে। দুই দশকে কয়েক হাজার সেনা খুইয়েছে, ডলারের শ্রাদ্ধ হয়েছে বেশুমার। তার পরও আমেরিকা যে আফগানিস্তান থেকে হাত গুটিয়েছে ভাবীকালে এ সিদ্ধান্ত অবশ্যই ইতিহাসের পাতায় প্রশংসা পাবে। আমাদের স্বাধীনতার পরপর আমেরিকা যেভাবে ভিয়েতনাম থেকে তাদের সেনা তুলে নিয়ে গিয়েছিল, আফগানিস্তান থেকে তার চেয়ে করুণভাবে তাদের চলে যেতে হয়েছে। তবে আমেরিকান সেনাসহ তাদের সহযোগী লক্ষাধিক মানুষকে তারা সফলভাবে আফগানিস্তান থেকে বের করে নিতে পেরেছে। এজন্য বর্তমানে বাইডেনের যত সমালোচনাই হোক ভবিষ্যতে এটা তার সফলতার অন্যতম উদাহরণ হয়ে থাকবে। আফগানিস্তানে আমেরিকার একজন সেনার মৃত্যু লাখো কোটি ডলারে পূরণ হওয়ার নয়। একসময় জাপানের মতো ক্ষুদ্র একটি দেশ মহাচীন দখল করে নিয়েছিল। তেমন একটা খুব বড় না, অনেকটাই দ্বীপরাষ্ট্রের মতো ব্রিটেন আমেরিকা দখল করেছিল। সেখানে ব্রিটেনের পতাকা উড়ত। সারা পৃথিবী ছিল ব্রিটেনের করায়ত্ত। বলা হতো ব্রিটিশ রাজত্বে কখনো সূর্য ডোবে না। সেই ব্রিটেনও আজ সবকিছু ছেড়েছুড়ে নিজের ঘরে ঢুকেছে। গত শতাব্দীতে যা চলেছে এ শতাব্দীতে তা চলার কথা নয়। তাই আমেরিকার বিশ্ব মোড়লিপনার দিন শেষ। বিশ্বশান্তির জন্য তাদের এখন পৃথিবীকে পদানত করার চিন্তা মনমানসিকতা থেকে সরিয়ে ফেলা উচিত। সে কাজই তারা করেছে। আমেরিকা যেভাবে ইরাক-আফগানিস্তান দখল করে বসেছিল, তারা ভেবেছিল যা খুশি তা করতে পারবে। এটা যা খুশি তা করার যুগ নয়। সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলার যুগ। শেষ পর্যন্ত সে কাজটাই জো বাইডেন করেছেন এজন্য তিনি কোনো একদিন অবশ্যই প্রশংসা পাবেন। অন্যদিকে তালেবান যদি ২০ বছর আগের পুরনো তালেবানই থাকে তাদের জন্য দুঃখ ছাড়া আর কিছু নেই। তারা যদি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে, নারী জাতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে পারে, বিশ্বনবী (সা.)-এর অছিয়ত ‘প্রয়োজনে শিক্ষা অর্জনের জন্য চীনে যাও’ নারীসমাজের শিক্ষার দ্বার খুলে দিতে পারে তাহলে কষ্টসহিষ্ণু আফগানকে কেউ পদানত করতে পারবে না এটাই সবার বিশ্বাস।
বেশ কিছুদিন রীতিমতো নাজেহাল হওয়ার পর পরীমণি জামিন পেয়েছেন। মামলা-মোকদ্দমা হলে বিচার ও বিচারের আগে জামিন একটি স্বতঃসিদ্ধ প্রচলিত প্রথা। আমাদের দুর্ভাগ্য, কোনো কিছুই ঠিকভাবে নিয়মমতো চলছে না। পরীমণি যেদিন গ্রেফতার হন তার গ্রেফতারে ছয়-সাত ঘণ্টা অথবা তারও বেশি সময় লেগেছে। একটানা অতক্ষণ লাইভে গিয়ে পরীমণি নানা ধরনের চিৎকার-চেঁচামেচি করেছেন। আমি ফেসবুক চালাতে জানি না। আল্লাহর দেওয়া লাইভই ভালোভাবে চালাতে পারি না। আর ইন্টারনেটে লাইভে গিয়ে মানুষ নিয়ে ডাকাডাকি, হইচই করব কী করে? এটা বুঝি, পরীমণি চলচ্চিত্রের একটি পরিচিত উচ্চাভিলাষী লাগামহীন সুন্দরী মেয়ে। তার প্রতিভা সুন্দরভাবে কাজে লাগালে কত মানুষের কাছে আশার প্রদীপ হয়ে থাকতে পারতেন। হয়তো ভালো মানুষ পাননি, ভালো মানুষের হাতে পড়েননি তাই তার সুন্দর স্বাভাবিক শিক্ষা হয়নি। কিন্তু তাকে নিয়ে সারা জাতি যা দেখল তা মোটেই ভালো নয়। তার বাড়িতে টনে টনে মদ-গাজা-ভাঙের যে গোডাউন দেখা গিয়েছিল আমার কেন যেন মনে হচ্ছে সবই সাজানো ব্যাপার। আসলে আমাকে নিয়ে এসব ব্যাপারে কিছুটা অসুবিধা আছে। কারণ এসব লাইন আমার একেবারে জানা নেই। আমি জীবনে বিড়ি-সিগারেট জ্বালিয়ে দেখিনি। বছর চল্লিশ আগে গোপালগঞ্জের বিজন সাহার দাঁত মাজার গুল মুখে দিয়েছিলাম, দাঁত মেজেছিলাম। ১৫ মিনিট পর বমি হয়েছিল। তাই গাঁজা-ভাঙের কথা লিখতে কিছু দুর্বলতা থাকে। খুব ভালো হয় না, যুক্তিযুক্ত হয় না। কিন্তু কেন যেন পরে মনে হয়েছে সত্যিই ব্যাপারটা সাজানো নয়তো? দেশের আইন চলবে আইনের মতো। সেখানে কারও প্রভাব-প্রতিপত্তি জায়গা পাবে না। পুলিশ-টুলিশের ওপর সামান্য প্রভাব খাটলেও কোর্ট-কাচারিতে ওসব খাটে না। গত পর্বে এক জায়গায় লিখেছিলাম, আমি তো পরীমণিকে নিয়ে ভাবছি না। তার মামলা চলবে, জামিন হবে। কিন্তু যে বিচারক বারবার আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন তার ভবিষ্যৎ পদোন্নতি নিয়ে ভাবছি। পরীমণির মামলায় পদে পদে আইনের ব্যত্যয় তার ভবিষ্যতে হিমালয় পর্বতের অথবা চীনের প্রাচীরের মতো বাধা হয়ে দাঁড়াবে। দেখুন, কত তাড়াতাড়ি সত্য হলো। হাই কোর্ট জানতে চেয়েছে, বারবার পরীমণিকে রিমান্ড কেন? তদন্ত কর্মকর্তাকেও জবাব দিতে বলা হয়েছে। যে ব্যাখ্যাই দিন, তাদের কাজটি যে আইনানুগ হয়নি, হাই কোর্টের হস্তক্ষেপই তার যথেষ্ট প্রমাণ।
পরীমণি আমার বড় মেয়ে থেকে অনেক ছোট, ছোট মেয়ের একটু বড়। কোনো মেয়ে লাঞ্ছিত হোক অসম্মানিত হোক তা আমি মনেপ্রাণে চাই না। আমাদের সমাজে মেয়েদের নারীদের মায়েদের সম্মান থাকা উচিত আরও অনেক বেশি। দেশের প্রধান কর্তৃত্বই আমার বোন নেত্রী হাসিনার হাতে। তার পরও মেয়েদের নিয়ে যখন নাহক টানাহেঁচড়া হয় তখন দুঃখ বেদনায় বুক চৌচির হয়ে যায়। অপরাধী হলেও নারীর বিচার মানবিক গুণাগুণ রেখে করা দরকার। কোনো অপরাধ করলেই তার সঙ্গে অমানবিক হতে হবে এটা কোনো সভ্যতা অনুমোদন করে না। কাশিমপুর কারাগার থেকে পরীমণি মুক্তি পেয়েছেন, তার ভক্তদের হাত নেড়ে উৎসাহিত করেছেন, ভক্তরা অনেকে তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ধন্য হয়েছেন। পরীমণি যদি এ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন তাহলে তার ভবিষ্যৎ আলোকময় সুন্দর কুসুমাস্তীর্ণ হতে পারে। আর যদি কোনো শিক্ষা না নেন, মানুষের মতো আচরণ না করে ফাজিলের মতো করেন তাহলে আমরা যারা মায়ের সন্তান আল্লাহ-রসুলের পরে যাদের কাছে মায়ের সম্মান তারা কষ্ট পাব, খারাপ লাগবে।
সময়টা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। শোকের মাস থেকে জিয়াকে নিয়ে বড় টানাটানি। বিএনপি কিন্তু অনেকটাই তলিয়ে গিয়েছিল। বিএনপি ও তাদের নেতা তারেক রহমান আগামী এক বছর আপ্রাণ চেষ্টা করে সাধারণ মানুষের অন্তরে যে জায়গা করতে পারতেন না তার ১০ গুণ জায়গা করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের অপরিণামদর্শী লোকজন। অনেক নেতানেত্রী সঠিকভাবে ভেবে দেখেননি শেখ হাসিনা জিয়ার কবর নিয়ে কী বলেছেন? তিনি রূপক অর্থে বলেছিলেন, চন্দ্রিমা উদ্যানে কি জিয়াউর রহমানের সত্যিকারের লাশ আছে? তাহলে তার কবর নিয়ে এত বিশৃঙ্খলা কেন? তিনি কবরে যাওয়ায় আপত্তি করেননি, তার আপত্তি ছিল মারামারি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে। ইদানীং কে কোথায় কীভাবে ইউটিউবে কীসব দিয়ে দেয় তা তারাও হয়তো জানে না। আমি ইউটিউব দেখতে জানি না। হঠাৎ হঠাৎ টেপাটেপি করতে করতে কখনো ইউটিউবে এটাওটা বেরিয়ে আসে। সেদিন হঠাৎই দেখলাম শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, ‘কাদের সিদ্দিকী বলেছেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পাগল’। সেতুমন্ত্রীর সমালোচনা যে আমি দু-এক বার করিনি তা নয়। কিন্তু কোনো দিন তাকে পাগল বলতে যাইনি। কেন পাগল বলব? তিনি একজন যথার্থ রাজনীতিবিদ। কেউ তাকে জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়নি। তিনি রাজনীতি করে এত দূর এসেছেন। আমার কোনো লেখায় বা আমার কণ্ঠে ওবায়দুল কাদের পাগল এ শব্দ শোনাতে পারলে আমি রাজনীতি ছেড়ে দেব। কাউকে অসম্মান করে কথা বলা আমার ধাতে সয় না। আমি মতিয়া চৌধুরী, হাসানুল হক ইনু, শাজাহান খান, কর্নেল তাহের, অধ্যাপক আনোয়ার- এ ধরনের কিছু মানুষকে একেবারেই পছন্দ করি না। তবু তাদেরও পাগল-ছাগল বলে মুখ খারাপ করি না। মুখে বাধে, জিব আড়ষ্ট হয়ে আসে। সেই জনাব ওবায়দুল কাদের জিয়ার কবর নিয়ে বলেছেন, হাজার হাজার লোক জানাজায় শরিক হলেই কফিনে জিয়াউর রহমানের লাশ ছিল এটা প্রমাণ করে না। কথাটা খুবই যুক্তিযুক্ত। অথচ অন্য এক মন্ত্রী যা তার ক্ষমতার মধ্যে নয়, তাই বারবার বলছিলেন, সংসদ ভবনের আঙিনা থেকে জিয়ার কবর ও অন্যান্য স্থাপনা সরিয়ে ফেলবেন। এ ক্ষমতা কিন্তু যিনি বলেছেন তার নেই। এখানে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী চমৎকার কথা বলেছেন। বলেছেন, জিয়াউর রহমানের কবর সরানোর কোনো সরকারি সিদ্ধান্ত হয়নি। আগুনে পানি ঢেলে দেওয়ার মতো উপযুক্ত কথা। সত্যিই আমরা বুঝতে পারি না আওয়ামী লীগের কিছু অতি উৎসাহী নেতা, মন্ত্রী দেশে অশান্তি সৃষ্টি করে কী লাভ পান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সব কথার অর্থ যে তার দলের অনেকেই বুঝতে পারেন না তা তাদের কার্যকলাপেই বোঝা যায়। কী পরিপ্রেক্ষিতে কী mean করে নেত্রী কোন কথা বলেছেন তা বোঝবার উপযুক্ত লোকজন নেত্রীর আশপাশে নেই। যদি থাকত তাহলে এমন হতো না। আমরা ছিলাম নেতা হাঁ করলে হামিদপুর বুঝতাম। আমাদের নেতাকে বেশি চিল্লাতে হতো না। লাইন ধরিয়ে দিলে আমরা সাফল্যের লক্ষ্যে পৌঁছে যেতাম। কিন্তু সত্যিই রাজনৈতিক শৃঙ্খলা ভেঙে যাওয়ায় প্রবীণ-নবীনের কোনো পার্থক্য না থাকায় এক মারাত্মক এলোমেলো অবস্থা। রাজনৈতিক নেতৃত্ব তো না বললেই চলে, মন্ত্রিসভার সদস্যরা এক একজন এক এক দিকে কথা বলেন।
আজ কয়েকদিন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিশ্বপন্ডিতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। আইনমন্ত্রীর বাবা সিরাজুল হক ছিলেন এক অসাধারণ মানুষ। বঙ্গবন্ধুর বন্ধু কলকাতার বেকার হোস্টেলে একসঙ্গে থাকতেন। সিরাজুল হককে ভাই বলে ডাকতাম। তিনি আমাকে সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। চমৎকার মানুষ ছিলেন। তাঁর ছেলে কেন যে অনেক সময় আগ বাড়িয়ে কথা বলেন বুঝতে পারি না। উনি সেদিন পবিত্র সংসদে বলার চেষ্টা করেছেন, ‘জিয়াউর রহমান যদি মুক্তিযোদ্ধাই হবে তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেনি কেন?’ বঙ্গবন্ধু হত্যায় লাভবান তিনি। তিনি কী করে বিচার করবেন? বিচার করতে গেলে তিনিই তো বরং আসামি হতেন। বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে যেভাবেই হোক নানা কলাকৌশলে তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তা না হলে তিনি তো আর দশজনের মতো একেবারে সাধারণ থাকতেন। তিনি কত মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছেন, সেনাবাহিনীর কত লোককে ফাঁসি দিয়েছেন এসব না বলে আইনমন্ত্রীর উচিত ওই ঘটনাগুলো আইনের আওতায় আনা এবং তাকে বিচারের সম্মুখীন করা। কি দুর্ভাগ্য আমাদের, কেউ বঙ্গবন্ধুকে সামান্য একটু ছাড়ও দেয়নি। কিন্তু জিয়াউর রহমানের সাত খুন মাফ। আমার জানা মতে জিয়াউর রহমানের সময় ফাঁসির কাতারে কাদেরিয়া বাহিনীর বেশ কয়েকজন ছিল। তাদের অনেকের নাম-ঠিকানা মিল ছিল না। কারও বাপের নাম ঠিক নেই, কারও নিজের নামই ঠিক নেই তবু ফাঁসি। এমনি কয়েকজনকে ফাঁসির কাষ্ঠে নিয়ে নামধাম জিজ্ঞাসার পর গরমিল হওয়ায় ফাঁসি থেকে বেঁচে যায়। কেউ পাঁচ বছর, কেউ সাত বছর জেল খেটে মুক্তি পায়। তার অধিকাংশের সন্তান-সন্ততি আওয়ামী লীগ করে না, তারা বিএনপি করে!
ফাঁসি থেকে বেঁচে যাওয়া জীবিত তিন-চার জন তারা নিজেরাও বিএনপি করে। এই হলো আমাদের ভবিতব্য! তাই এ কথা অবশ্যই বলব, কেউ বেশি সুখে নেই। তাই খুশির ঢেঁকুর তুলবেন না। বিশ্বরাজনীতি লক্ষ্য করুন, দেশের অবস্থা দেখুন। মহান প্রভু আল্লাহকে ভরসা করে লকডাউন তুলে দিয়ে খুব ক্ষতি হয়নি। বরং ভালোই হয়েছে। গতকাল করোনায় সর্বশেষ মৃত্যু ছিল ৭০ জন, শনাক্তের হারও ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। তাই আল্লাহকে ভরসা করুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।
লেখক : রাজনীতিক।
www.ksjleague.com