শুক্রবার, ১২ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ক্ষোভে কষ্টে অপমানে ফুঁসছে তারা

মনজুরুল আহসান বুলবুল

ক্ষোভে কষ্টে অপমানে ফুঁসছে তারা

১. ডিজেল-কেরোসিন নিয়ে তুলকালাম গেল কয়েক দিন।

সরকারি ভাষ্য : ২০১৩ সালে দেশে ডিজেলের লিটার ছিল  ৬৮ টাকা, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে ২০১৬ সালে লিটার -প্রতি ৩ টাকা কমিয়ে ৬৫ টাকা করা হয়। সে সময় যে পরিমাণ কমার কথা ছিল তা হয়নি। বলা হয়েছিল : যে লোকসান হয়েছে তা কিছুটা পোষাতে বাড়তি দাম রাখা হলো। এরপর গত সাড়ে পাঁচ বছরে দেশে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়েনি।

এ বছর শুরু থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বেড়েই চলেছে। ফলে গত সাড়ে পাঁচ মাসে ডিজেলের জন্য বিপিসির লোকসান হয়েছে প্রায় ১১৪৭.৬০ কোটি টাকা। একই সঙ্গে ডলারের মূল্য ২০১৬ সালে ৭৯ টাকা থেকে চলতি মাসে ৮৫.৭৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ফলে ডলারে মূল্য পরিশোধে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হচ্ছে।

সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে : ভারতে জ্বালানির মূল্য কমার পরও পশ্চিমবঙ্গে ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ৯০ রুপি বা ১০৪ টাকা, দিল্লিতে ৯৮.৪২ রুপি বা ১১৪ টাকার সমান। নেপালেও এ মূল্য ১১২.৩৯ নেপালি রুপি বা ৮১ টাকা। প্রতিবেশী এসব দেশের চেয়ে আমাদের মূল্য কম রয়েছে। এ কারণে আবার চোরাকারবারিরা এখান থেকে প্রতিবেশী দেশে ডিজেল পাচার করছে। পাশের দেশগুলোয় দাম বাড়তি থাকলেও আমাদের দেশে দাম রাখার জন্য সরকার ধন্যবাদ পেতেই পারে। আলোচনায় এ বাস্তবতা মাথায় রাখতে হবে অবশ্যই।

২. কিন্তু এ মুহূর্তে আর কি কোনো বিকল্প ছিল?

সংবাদমাধ্যমের তথ্য : সাত বছর টানা মুনাফা করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। কিন্তু তাদের লাভের টাকা নিয়ে নিয়েছে সরকার।

সংস্থাটির কর্মকর্তারা গোপনে এ কথা বলছেন : এ টাকা সরকার না নিলে অন্তত ছয় মাস ডিজেল ও কেরোসিনের দাম না বাড়ালেও চলত; কিন্তু ছয় মাস পরে আবার বর্তমান পরিস্থিতিতেই পড়তে হতো। বিশ্লেষকরা বলছেন : দাম না বাড়ালেও বছর শেষে বিপিসির লোকসান কিছুতেই ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি হতো না। এ পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিয়ে বা কর ছাড় দিয়ে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এড়ানোর সুযোগ ছিল।

সংবাদমাধ্যমে বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না দিতে হলে মূল্য না বাড়িয়েও হয়তো আরও ছয় মাস চালিয়ে নেওয়া যেত। মুনাফা করা বিপিসির লক্ষ্য নয়। কিন্তু ঘাটতি বাড়তে থাকলে জ্বালানি আমদানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সরকারকে পরিস্থিতি জানানোর পর দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দিয়েছে, বিপিসি তা বাস্তবায়ন করছে।

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অবস্থান : সরকার আর ভর্তুকি দিতে রাজি নয় বরং বিপিসিকে কীভাবে লাভে রাখা যায় সেদিকেই নজর বেশি।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মত : করোনাকালের এ কঠিন সময়ে দাম না বাড়ানোই যুক্তিসংগত ছিল। দাম না বাড়িয়ে কর কমিয়েও সাময়িকভাবে সমস্যা মোকাবিলা করা যেত। এখন ডিজেল আমদানিতে মোট কর দিতে হয় প্রায় ৩৪ শতাংশ। ১ লিটার ডিজেলে এখন কর ও ভ্যাট দাঁড়ায় ১৯ টাকার মতো।

২০১৯-২০ অর্থবছরে বিপিসি সরকারের কোষাগারে ৬ হাজার ৭৪ কোটি টাকা ভ্যাট, ১ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা আমদানি শুল্ক, ১ হাজার ১৮১ কোটি টাকা আয়কর এবং ৩০০ কোটি টাকার লভ্যাংশ জমা দিয়েছে। এ ছাড়া ওই অর্থবছর সরকার বিপিসির ৫ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত অর্থ নিয়ে নিয়েছে। সরকারি কোষাগারে গেছে মোট ১৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকা। সেখান থেকে এ বছর সংকটকালে কি ২-৩ হাজার কোটি টাকা ছাড় দেওয়া যেত না- এটি একটি যৌক্তিক প্রশ্ন।

তবে দাম বাড়ানো নিয়ে জ্বালানি বিভাগের ব্যাখ্যায় বারবার বলা হচ্ছে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কথা। প্রতিবেশী ভারতে জ্বালানির উচ্চ দামের কথাও বলা হচ্ছে। ভারতে প্রতিদিন সকাল ৬টায় বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে জ্বালানির দাম সমন্বয় করা হয়। যখন বিশ্ববাজারে দাম কমে সঙ্গে সঙ্গে ভারতেও কমে যায়। বাংলাদেশে দাম নির্ধারণ করা হয় নির্বাহী আদেশে। ভোক্তা অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বলছেন : আইন না মেনে দাম বাড়ানো হয়েছে; কোনো গণশুনানির ব্যবস্থা করা হয়নি।

বিভিন্ন জরিপ বলছে : করোনাকালে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন দরিদ্র হয়েছে। করোনা প্রণোদনা দিয়ে সরকার যে মানবিক অবস্থানে উচ্চাসনে উঠেছিল সেই মানবিক চেহারা কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ হলো সন্দেহ নেই। বাস্তবতা হলো : ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি = পরিবহন ভাড়া বাড়ল; পণ্যসামগ্রীর দাম বাড়বে; বাড়বে বিদ্যুতের দামও; সেচের মূল্য বাড়বে। সব মিলিয়ে আয়হীনে নির্ধারিত আয়ের মানুষের চিঁড়েচ্যাপ্টা দশা।

৩. এ দাম বাড়ানো নিয়ে যে অরাজক অবস্থা চলল তিন দিন ধরে তার দায় কে নেবে? বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দাম বাড়ানোর প্রজ্ঞাপন জারি করে সংশ্লিষ্ট কর্তারা ‘উইকেন্ডে’ চলে গেলেন। তাদের পিছু পিছু শুক্রবার সকাল থেকেই ধর্মঘট ডাকলেন পরিবহন মালিকরা।

ফলাফল : পরিবহন ধর্মঘটে জনগণের ভোগান্তি। কক্সবাজারে আটকা পড়েন ২০ হাজার পর্যটক [ধন্যবাদ কক্সবাজার পুলিশকে; তারা অন্তত বিনা ভাড়ায় এই আটকে পড়াদের চট্টগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন]। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ফাঁকা। ইচ্ছামতো ভাড়া নিয়েছেন মাইক্রোবাস ও অটোরিকশা চালকরা। কমলাপুর ট্রেনস্টেশনে যাত্রীর উপচে পড়া ভিড়।

বেনাপোলে আটকা পড়েন ভারতফেরত যাত্রীরা। বাস ধর্মঘট, কিন্তু বুয়েট ভর্তি পরীক্ষাও দিতে হবে ছেলের; অগত্যা মোটরবাইক চালিয়েই বগুড়া থেকে ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় চলে এলেন আইনুল হক। নাটোরের বঙ্গবন্ধু কলেজ থেকে পাস করা ছেলে আশিক আলীকে বুয়েটের পরীক্ষা কেন্দ্রে পাঠিয়ে কয়েকটি ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় অপেক্ষা করছিলেন মা আরিফা বেগম।

৪. এ তিন দিন বাংলাদেশে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে কেউ ছিলেন তা মনে হয়নি।

ক্ষমতাধরদের নানা বাণী এ অসহায় মানুষকে যেন ব্যঙ্গই করেছে। কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান বললেন : ‘পরিবহন ধর্মঘট’ নয়, গাড়ি বন্ধ রেখেছেন মালিকরা। আমলা থেকে রাজনীতিক পরিকল্পনামন্ত্রী বললেন : জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এটাই শেষ নয়, মানে আরও বাড়বে। সর্বক্ষমতাধর মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মন্তব্য : প্রধানমন্ত্রী তেলের দাম বৃদ্ধিজনিত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।

বিপদগ্রস্ত মানুষের প্রতি সহানুভূতির কোনো নামনিশানা নেই।

দেশের প্রতি দায়, মানুষের প্রতি দায়িত্ব আছে বলেই না বিদেশে অবস্থান করেও প্রধানমন্ত্রী পরিস্থিতির প্রতি নজর রেখেছেন। কিন্তু দেশে যারা ছিলেন দেশের মানুষের প্রতি তাদের কোনো দায় নেই?

কথার কুস্তিগির শাজাহান খান বলেছিলেন : ধর্মঘট নয়, গাড়ি বন্ধ রেখেছেন মালিকরা। আর ভাড়া বাড়ার পর মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বলেন : আমরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করলাম!

মানুষকে কতটা বোকা ভাবেন খান সাহেব!

পরিবহন সেক্টর ভাড়া বাড়ানোর দাবি করতেই পারে; কিন্তু সরকারি প্রজ্ঞাপন জারির সঙ্গে সঙ্গেই কোনো নোটিস না দিয়ে, সরকারকে কোনো সময় না দিয়ে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, বিএনপির ত্রিচক্র প্রতাপশালীরা দেশজুড়ে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত করল, তাদের ধমক দেওয়ার মতো কি কেউ দেশে নেই?

পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকার ভিতরে মোট বাস চলে : ১২ হাজার ৫২৬টি, গ্যাসে চলে : ১১ হাজার ২০০টি, ডিজেলে চলে : ৬২৬টি। ঢাকা থেকে দূরপাল্লায় মোট বাস : ১৬ হাজারটি, গ্যাসে চলে : ১১ হাজার ২০০টি, ডিজেলে চলে : ৪ হাজার ৮০০টি।

তার মানে ঢাকার ভিতর প্রায় ৯৫ শতাংশ বাসই চলে গ্যাসে। দূরপাল্লার ৬০ শতাংশ চলে গ্যাসে। তাহলে ডিজেলের দাম বাড়ায় সব বাসের ভাড়া বাড়ানোর দাবি কেন?

ডিজেলের দাম বেড়েছে, কিন্তু সিএনজিচালিত পরিবহন বন্ধ করা হলো কেন?

এ প্রশ্ন করার জন্য কি কেউ নেই এ দেশে?

বিআরটিএ নামক যে সরকারি প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতির কারণে আলোচনার শীর্ষে তাদের ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারলাম এটা জানতে যে ভাড়া বাড়ানো ছাড়া আর কী কাজ তাদের।

সেখানে লেখা আছে : রূপকল্প ও অভিলক্ষ্য।

রূপকল্প : ডিজিটাল, টেকসই, নিরাপদ, সুশৃঙ্খল, পরিবেশবান্ধব আধুনিক সড়ক পরিবহনব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

অভিলক্ষ্য : আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে অংশীজনের সচেতনতা বৃদ্ধি, যুগোপযোগী সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের মাধ্যমে ডিজিটাল, টেকসই, নিরাপদ, সুশৃঙ্খল, পরিবেশবান্ধব আধুনিক সড়ক পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলা।

এটা পড়লে বুঝতে পারি : টেকসই, নিরাপদ, সুশৃঙ্খল, পরিবেশবান্ধব আধুনিক সড়ক পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলা বিআরটিএর কাজ। তিন দিনে যে দেশে সড়ক পরিবহনব্যবস্থা ভেঙে পড়ল তা দেখার দায়িত্ব কি তাদের ছিল? বিআরটিএ কি কোনো দিন সড়কে বা পরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে কোনো ভূমিকা রাখতে পেরেছে? কোনো নজির আছে?

বিআরটিএর হাস্যোজ্জ্বল কর্তাদের তো দেখা গেল সড়ক ও মানুষকে জিম্মি করে যারা বীভৎস হাসি হাসছেন তাদের সঙ্গে সুর মেলাতে। নির্বিঘ্ন উইকেন্ড শেষে বিআরটিএ কর্মকর্তাদের ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা দেখে এক পাঠকের মন্তব্য : একসময় ঘানিতে তেল ভাঙানো হতো। ঘানিতে তেল যত বেশি বের হয় মালিক তত খুশি। বোবা গরুগুলোর ততক্ষণ ঘানি টানতে হবে যতক্ষণ মালিক চাইবে।

৫. দেশের সাধারণ মানুষের ঘাড়ে জোয়াল রেখে যারা অতিমাত্রায় তেল চকচকে হচ্ছেন তাদের বলি : যারা জোয়াল টানে তারা জোয়াল উল্টে দিতেও পারে।

তোমারে বধিবে যারা; রাগে, ক্ষোভে, কষ্টে, অপমানে ফুঁসছে তারা। [সমাপ্ত]

                লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর