রবিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

আমাদের চলচ্চিত্রের কী হবে

হোসেন আবদুল মান্নান

সিনেমাটি দেখার পর প্রায় সপ্তাহখানেক গত হলো। ভাবছিলাম, এসব বললে কার কী আসে যায়? আর আমি বলার কে? সিনেমার আমি কোন বিশেষজ্ঞ বুদ্ধাবতার যে এ নিয়ে কথা বলব বা বলার অধিকার রাখি অথবা এই অরণ্য রোদনের ফলে কোথাও কার দৃষ্টি আকর্ষণে যাবে? 

২. সম্প্রতি আকস্মিকভাবে হলে গিয়ে একটি সিনেমা দেখার সুযোগ পেয়ে যাই। ঠিক কত বছর পরে এমনটা হলো তা স্মরণ করতে পারছি না। তবে বছর তিনেক আগে চট্টগ্রামের একটি সিনেপ্লেক্সে গিয়ে  HASINA : A DaughterÕs Tale শিরোনামে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর আটপৌরে পারিবারিক জীবনভিত্তিক এক অসাধারণ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দেখেছিলাম। পরে অবশ্য টিভিতে একাধিকবার দেখেছি। এর আগের হিসাব করলে অন্তত ২৫ বছর হবে সরাসরি হলে গিয়ে আমার সিনেমা দেখা। সেদিন একটি হাতঘড়ি মেরামতের উদ্দেশে বসুন্ধরা শপিং মলের পাঁচ তলায় যাই। হঠাৎ এক পুরনো বন্ধুকে পেয়ে আলাপ প্রসঙ্গে জানলাম, সে এখানকার সিনেপ্লেক্সে সরকারি অনুদানে নির্মিত একটা মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র দেখতে এসেছে। সিনেমার নাম ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’। সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মি. তার শো শুরু হবে। আমি বললাম, দ্যাখ, আমার ঘড়ির কাজটা হয়নি আরও সময় লাগবে। তাহলে আমিও সিনেমা দেখব নাকি, কী বল? সে বলল, চল বন্ধু, এ তো দেখছি মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।

৩. সিঁড়ি বেয়ে হেঁটে ওপরে যেতে যেতে তাকে বলছিলাম, অনুদানের ছবিগুলো কেমন হয় এর একটু ধারণা পেতে চাই। কারণ আমার একটি গল্পও মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণের নিমিত্ত তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুদানপ্রাপ্ত হয়েছে। নাম ‘অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া’। তারা এখনো শুটিংয়ের পর্যায়ে আছে। আগামী স্বাধীনতা দিবসের আগে প্রদর্শনের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। সে বলল, দারুণ খবর বন্ধু! তোমার গল্পের ছবিটা রিলিজ পেলে জানাবে কিন্তু। ওটাও দেখতে আসব। আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম। ইতোমধ্যে আমাদের টিকিট হয়ে গেল। হাতে পেয়েই দেখলাম মূল্য ৩৫০ টাকা। অর্থাৎ জনপ্রতি ৩৫০ টাকা। এ ধারণাটিও আমার জন্য দরকার ছিল।

বলা বাহুল্য, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বিজয় ৫০ উপলক্ষে সদ্য মুক্তি পাওয়া ছবি এটি। 

৪. বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সের রাজকীয় অডিটোরিয়ামে প্রবেশ করে আমি বিস্মিত। সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট, সাউন্ড সিস্টেম, লাইটিং, স্পেস ইত্যাদি বলা যায় সবই বিশ্বমানের। আমাদের বিশেষ মর্যাদার পিছনের অপেক্ষাকৃত  অভিজাত সংরক্ষিত আসনে বসার ব্যবস্থা করা হলো। যথারীতি শুরু হলো কাহিনি চিত্রের নামকরণের ধারাবাহিকতা। এর কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় নূরুল আলম আতিক। বিহারি অধ্যুষিত মফস্বল শহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নারকীয় তান্ডব, হত্যাকান্ড, নির্যাতন, ধর্ষণ অত্যাচারের বিচিত্র ঘটনা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ সিনেমা। মুক্তিযুদ্ধের বিচিত্র ঘটনাবলি যে শুধু দৃশ্যমান ছিল না বরং বহুকেন্দ্রিক ও বহুমাত্রিক গভীরে  ছিল এর একটি নমুনা এতে ফুটে উঠেছে। এর কাহিনিতে মূলত একাত্তরের আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরের মধ্যে ঘটে যাওয়া নানা দৃশ্যপটে শান্তি কমিটি ও আলবদরের পাশবিকতার গল্পও তুলে ধরা হয়েছে। চিত্রায়ণ, সংলাপ রচনা, অভিনয়শৈলীতেও যথেষ্ট মুন্সিয়ানা প্রদর্শনে সক্ষম হয়েছেন কলাকুশলীরা। বিশেষ করে আহমদ রুবেল, লায়লা হাসান, ভাবনা ও জ্যোতিকা জ্যোতির অভিনয়ে অনবদ্য কথন শৈল্পিকতা উঠে এসেছে। এমন নন ফিকশন ধরনের ছবি বানানো নিঃসন্দেহে শ্রমসাধ্য এবং কষ্ট নিষ্ঠার ফল। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রতিশ্রুতি, মননশীলতা, আন্তরিকতা ও দেশপ্রেমবোধ এদের কর্মের ভিতরেই অনেকটা প্রতিফলিত তথা উদ্ভাসিত।

৫) আমার প্রায় দুই ঘণ্টা সময় মন্দ কাটেনি। কোথাও সামান্য অস্পষ্টতার বিষয়ে আলাপ করারও সুযোগ ছিল। তথাপি ভীষণভাবে যা আমাকে হতাশ করেছে তা হলো দর্শক। নেই বললেই চলে। আনুমানিক ২০-২৫ জন হবে। বেশ বিস্তৃত অবয়বের অত্যাধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল মুষ্টিমেয় দর্শক। ইন্টারবেলে আলো জ্বলে উঠতেই লক্ষ্য করলাম দর্শকরা বেশ বুদ্ধা ও প্রাপ্তবয়স্ক। এ ছবিরই একজন বড় অভিনেতা সবান্ধব উপস্থিত ছিলেন বিধায় আমাদের চারপাশকে নির্জনতা গ্রাস করতে পারেনি। কিন্তু মাঝপথে তার প্রস্থানে আমরা অনেকটা জনশূন্য হয়ে যাই। দ্বিতীয়ার্ধে দর্শক সংখ্যা নেমে আসে ১৫-১৬-তে। আমরা পুরো কাহিনির ভিতর দিয়ে চলেছি, কোনো ছেদ পড়েনি। বরং শেষ দিকটা অনেক বেশি অভিনয় নৈপুণ্যে ভরপুর ছিল। কলাকুশলীরা ছিলেন একাগ্র ও সপ্রতিভ। আমরা ষোলোআনা উপভোগ করেছি এবং মাতৃভূমির স্বাধীনতায় মানুষের নিরন্তর ত্যাগের কথা পুনর্বার স্মরণ করেছি। এ যেন ফিরে দেখা একাত্তর।

৬) তবে ভাবছিলাম, এসব কাজ কাদের জন্য হচ্ছে? স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমরা কাদের শোনাব বা জানাব এর সহজ উপায় কী? কারা বিরোধিতা করেছিল, তাদের টার্গেট কী ছিল? ৫০ বছর বাদে এ বিস্মৃতি-প্রবণ জাতির পক্ষে বিকল্প আর কোনো মাধ্যমে গেলে প্রজন্ম পরম্পরায় যুদ্ধ দিনের ঘটনাবলিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে? সিনেমাবিমুখ বা হলবিমুখ নতুনদের জন্য আরও তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে কিছু করার মনে হয় এখনই যথার্থ অনুকূল পরিবেশ এবং আসল সময়। অন্যথায়, দীর্ঘদিনের দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আঙুলে গোনা কজনের বলয়ে বা  আধিপত্যে থেকে এবং সরকারের কাছ থেকে ফি বছর অর্থ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত তথ্যভিত্তিকও ঘটনাবহুল, বাস্তবনির্ভর ছবি/মুভি দেখার সুযোগ এ প্রজন্ম কখনই পেতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধ করেনি, দেখেনি বা একাত্তরে রণাঙ্গনের পরিবর্তে পাকিস্তানে বাস করা কাহিনিকারদের লেখা থেকে আসল মুক্তিযুদ্ধ খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অজানা, অশ্রুত, অকল্পনীয় ও অভাবনীয় কাহিনির অন্বেষণে বাংলার আনাচে-কানাচে পথেপ্রান্তরে যেতে হবে। যোগাযোগের জন্য সময় বের করে নিতে হবে নিজ উদ্যোগে, নিজ আয়োজনে ও নিজ খরচে। বছর শেষে সরকারের টাকার জন্য কয়েকজন বিশেষভাবে পরিচিত মুখের কাছে পৌঁছার দৌড়ঝাঁপ, সান্নিধ্যে উপনীত হওয়ার প্রবল আকাক্সক্ষা, ক্ষমতাবানদের ধরাধরি, অন্তহীন তদ্বির এসবের অবসান চাই। আমার জানা মতে, এটা খুব সামান্য আর্থিক অনুদান। এ থেকেই সামগ্রিক ব্যয় মেটানোর নিরন্তর প্রয়াস বা আংশিক বাঁচিয়ে কোনো রকম একটা কিছু দাঁড় করানোর নাম হৃদয়ছোঁয়া কোনো গল্পের চলচ্চিত্র নির্মাণ নয়। এর থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। আমাদের কিংবদন্তি হুমায়ূন আহমেদ পরবর্তী যুগে নতুন নতুন আরও বিত্তবান, চিত্তবান ও জ্ঞানের বহুমাত্রিকতা নিয়ে প্রতিভাবানদের এ জগতে এসে স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে বসবাস করতে হবে। মেধার সংযোগ ছাড়া ভালো কিছু হয় না এবং হবে না। তা না হলে, সেলুলয়েড কখনো খুঁজে পাবে না আমাদের দেখা ’৭১ এবং মুক্তিযুদ্ধ।

                লেখক : গল্পকার ও গবেষক।

সর্বশেষ খবর