বুধবার, ১৮ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

দেশের ফুটবলে বসুন্ধরা কিংস

ইকরামউজ্জমান

দেশের ফুটবলে বসুন্ধরা কিংস

স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ফুটবল চত্বরে দুটি ক্লাবের মাঠে আগমন আমার কাছে ঘটনাবহুল, তাৎপর্যময় এবং স্মরণীয় মনে হয়। প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করা ক্লাব দুটির একটি হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে ক্রীড়ানুরাগী ও খেলোয়াড় শেখ কামালের গড়া আবাহনী ক্রীড়া চক্র। যেটি এখন ঢাকা আবাহনী লি. হিসেবে পরিচিত। এবং অন্য খেলোয়াড় ও ক্রীড়াপিপাসু পরিবারের মালিকানাধীন বৃহৎ করপোরেট গ্র“প বসুন্ধরার- ‘বসুন্ধরা কিংস’। দুটি ক্লাবের শুরু এনকার ক্লাব হিসেবে হলেও জাতীয় ক্লাবের পরিচিতি পেতে সময় লাগেনি। ক্লাব দুটির পরিচিতি শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও আছে। তবে ফুটবলের জন্য আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি এবং পেশাদার ক্লাব হিসেবে বসুন্ধরা কিংস আবাহনীর চেয়ে অনুপাতে অনেক ওপরে।

আবাহনী ক্রীড়া চক্রের মাঠে পদার্পণ ঢাকার প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে ১৯৭২ সালে অংশগ্রহণের মাধ্যমে! আবাহনী প্রথম লিগ শিরোপা জিতেছে ১৯৭৪ সালে। আর বসুন্ধরা কিংসের মাঠে আত্মপ্রকাশ ২০১৩ সালে। অর্থাৎ আবাহনীর মাঠে আগমনের চার দশকেরও পরে। বসুন্ধরা কিংস প্রথম ২০১৬ সালে খেলেছে পাইওনিয়ার লিগ। এরপর ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে অভিষেক মৌসুমেই চ্যাম্পিয়ন। এরপর ২০১৮-১৯ সালে প্রিমিয়ার লিগে ঢাকা আবাহনীর প্রাধান্য খর্ব করে চ্যাম্পিয়ন। পরের মৌসুমে আবার চ্যাম্পিয়ন ঢাকা আবাহনীকে অনেক পেছনে ঠেলে দিয়ে। এর পর থেকে বসুন্ধরা কিংস নিজেকে চিহ্নিত করেছে দেশের ফুটবলে ঢাকা আবাহনীর সবচেয়ে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। কিংস প্রথম থেকেই চেয়েছে ফুটবল পরিবর্তনের পথ ধরে এগিয়ে চলবে। অন্য ক্লাবগুলো থেকে পার্থক্য সৃষ্টি করতে তারা সফলও হয়েছে।

ফুটবল পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে- দুটি ক্লাবের মাঠে আসার মধ্যে অনেক বছরের ব্যবধান হলেও ক্লাব দুটির আগমন সময়ের দাবিতে। সময়ের প্রয়োজনে। দুটি ক্লাব দেশের ফুটবলে সময়ের সঙ্গে বিকশিত হতে পেরেছে বলেই দাগ কাটতে সক্ষম হয়েছে। পেরেছে দেশের ফুটবল রাজ্যে অনুকরণীয় হতে। ক্লাব দুটির বৃহৎ ক্রীড়াঙ্গনে আসার পেছনে আছে নির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও স্বপ্নে মিল। ক্লাব দুটি প্রথম থেকেই চেয়েছে তারুণ্যের প্রতিনিধিত্ব করতে। তাদের ফুটবলময় আশা-আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নের পথ ধরে হাঁটতে। চেয়েছে দেশের ফুটবলের মানোন্নয়ন এবং অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখতে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, দুটি ক্লাবই তাদের মাঠের পারফরম্যান্সের মাধ্যমে নতুন সময় ও ভক্ত তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। পেরেছে ঢাকার ফুটবলে অন্যান্য ক্লাবের ঝুড়ি থেকে সমর্থক ও ভক্তদের নিজেদের অনুকূলে টানতে। মাঠের ফুটবলকে পরিচিত করেছে ভিন্নভাবে। পাল্টে দিয়েছে মাঠের ছবি। দেশের ফুটবলে আবাহনী ও বসুন্ধরা কিংস ভেনু অ্যাডেড ব্র্যান্ড। আবাহনী ক্রীড়া চক্র ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনে একটি বড় ধাক্কা খেয়েছে। যদিও ক্লাবটির সঙ্গে দলীয় রাজনীতির কোনো সম্পর্ক ছিল না। যা হোক, কঠিন সময় পার করে আবাহনী একটি সময় থেকে দেশের ফুটবলে জনপ্রিয় ক্লাব হিসেবে নিজেকে পরিচিত করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে মাত্র এক দশকের মধ্যে ‘বসুন্ধরা কিংস’-এর উত্থান এবং দেশের ফুটবলে বিভিন্নভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখার পেছনে আছে ক্লাব প্রশাসনের পেশাদারি। তাদের প্রত্যয় এবং দায়বদ্ধতা। উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহারিক দক্ষতা। সময়কে বুঝতে পারার সক্ষমতা। চমৎকার সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি টিম হয়ে ক্লাব পরিচালনা। আকাক্সক্ষা, বিশ্বাস ও প্রত্যাশা এ তিনটি প্রবল শক্তিকে ক্লাব কর্তৃপক্ষ আয়ত্তের মধ্যে আনতে পেরেছে বলেই দেশের ফুটবলে একটি চমৎকার পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছে। হতে পেরেছে অন্যদের জন্য আদর্শ। দেশে প্রথম পূর্ণাঙ্গ পেশাদার ক্লাব বসুন্ধরা কিংস। ক্লাব নতুন সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করছে। ইউরোপের ক্লাবগুলোর মতো সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বসুন্ধরা কিংসের আছে। ক্লাবের নিজস্ব অ্যারেনা আছে। নিজেদের মাঠে তারা প্রিমিয়ার ফুটবল খেলে। আছে অনুশীলনের জন্য ভালো মাঠ, পুনর্বাসনব্যবস্থা ভালো কোচিং স্টাফ ও আবাসন। এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে এবং হচ্ছে গ্র“পের কর্ণধারদের খেলাধুলার প্রতি প্রচ- আগ্রহ, ভালোবাসা ও বৃহৎ বাণিজ্যিক গ্র“পের সামাজিক দায়বদ্ধতায়। খেলার চর্চা সুস্থ জীবনবোধের সন্ধান দেয়, এ দর্শন থেকেই ক্রীড়াঙ্গনে অনেক বড় বিনিয়োগ গ্র“পের।

বসুন্ধরা গ্র“প শুধু ফুটবল নয়, অন্যান্য খেলায়ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছে এবং করছে। ক্লাব হিসেবে শুধু বসুন্ধরা কিংস নয়, এ গ্র“পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের চেয়ারম্যান। তাঁর ছোট ভাই সাফওয়ান সোবহান তাসভীর শেখ জামাল ডিসির প্রেসিডেন্ট। স্বাভাবিকভাবেই দুই ক্লাবে বসুন্ধরা গ্র“পের বড় পৃষ্ঠপোষকতা আছে।

বসুন্ধরা গ্র“পের চেয়ারম্যান সাবেক হকি খেলোয়াড় এবং ক্রীড়া অন্তপ্রাণ ব্যক্তিত্ব আহমেদ আকবর সোবহান ২০১৯ সালে জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশের খেলাধুলায় প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে এ দেশের খেলোয়াড়দের বিশ্বপর্যায়ে লড়াই করার জন্য গড়ে তোলাই বসুন্ধরা গ্র“পের লক্ষ্য। আমি আশা করি বসুন্ধরা কিংস দেশের ফুটবলের পুরনো গৌরব ফিরিয়ে আনতে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করতে বিশেষ অবদান রাখবে। দেশের ফুটবলের ভবিষ্যৎ তারকাদের গড়ে তুলতে বসুন্ধরা কিংস কাজ করে যাবে বলেই আমি আশাবাদী। বসুন্ধরা কিংস এগিয়ে যাক। সেই সঙ্গে এগিয়ে যাক বাংলাদেশের ফুটবল।’

৩০০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত হয়েছে বসুন্ধরা স্পোর্টস কমপ্লেক্স। আধুনিক এ স্পোর্টস কমপ্লেক্সে আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়ামে আছে সব ধরনের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা। ফুটবল ছাড়াও কমপ্লেক্সে থাকবে অনেক খেলার আউটডোর ও ইনডোর ফ্যাসিলিটি। ফুটবলের জন্য বড় একাডেমি। নারী ফুটবলের জন্য পৃথক মাঠ এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। ইউরোপের কয়েকটি ক্লাব ইতোমধ্যে বসুন্ধরা কিংসের স্পোর্টস কমপ্লেক্স নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কমপ্লেক্সের কাজ শুরু হয়েছে ২০১৯ সালে, পুরো কাজ সম্পন্ন হবে ২০২৪ সালে। শুধু দেশে নয়, উপমহাদেশে আর কোথাও কোনো ফুটবল ক্লাবের এত বড় নিজস্ব স্পোর্টস কমপ্লেক্স নেই। আধুনিক স্পোর্টস কমপ্লেক্স দেশের জন্য গর্বের বিষয়। ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বসুন্ধরা গ্র“পের বিনিয়োগ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা।

বসুন্ধরা কিংস প্রথম থেকেই বিভিন্নভাবে ফুটবল কার্যক্রমকে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করেছে খেলাকে মাঠে ধরে রাখা, খেলার প্রসার, নতুন খেলোয়াড় সৃষ্টি এবং খেলার মানোন্নয়নের জন্য। এর মধ্যে আছে চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ, প্রিমিয়ার লিগ, পাইওনিয়ার লিগ, ফেডারেশন কাপ, বিভিন্ন জেলার ফুটবল লিগ। এ ছাড়া বাংলাদেশ ফুটবল সাপোর্টার্স ফোরাম একাডেমি কাপ। রংপুর বিভাগের সব জেলা নিয়ে ‘বসুন্ধরা কিংস ফুটবল টুর্নামেন্ট’ এসবিএফ কার্নিভ্যাল প্রমুখ। ঢাকার বাইরে দুটি জেলায় মাঠ ও স্টেডিয়াম ‘রিনোভেশন’ করেছে। আগামীতে আয়োজন করতে যাচ্ছে স্কুল টুর্নামেন্ট মেধাবী ফুটবলার খুঁজে বের করার জন্য। প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচির আওতায় বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ক্যাম্প করার পরিকল্পনা নিয়েছে। ঢাকায় অনূর্ধ্ব-১৮ ফুটবলার অন্বেষণ কর্মসূচিতে উপস্থিত হয়েছিল ৫ হাজারের বেশি তরুণ। এ তরুণদের থেকে বাছাই করে তৈরি করা হয়েছে একটি স্কোয়াড। এ স্কোয়াডের কয়েকজন ব্রাজিল গেছে উন্নততর ফুটবল প্রশিক্ষণের জন্য। বয়সভিত্তিক ভালো দল গঠনের ক্ষেত্রে কিংসের অগ্রগতি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।

বসুন্ধরা গ্র“প সমতার ক্রীড়াঙ্গনে বিশ্বাসী। আর তাই নারী দল গঠন করেছে। এ দল পর পর দুই মৌসুম নারী ফুটবল লিগে শিরোপা জিতেছে। নারী ফুটবলে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা এ ফুটবলে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে। কিংসের উদ্দেশ্য পুরুষ ও নারী ফুটবলকে সযতেœ লালনপালন করে দেশের বৃহত্তর ফুটবলে অবদান রাখা।

বসুন্ধরা কিংসের প্রথম থেকেই লক্ষ্য ছিল শুধু দেশের মাটিতে নয়, বিদেশে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভালো ফুটবল খেলে দেশকে মহিমান্বিত করা। প্রিমিয়ার লিগে প্রথম থেকেই এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য চিন্তাভাবনা করে দল গঠন করেছে এবং মাঠে সফলও হয়েছে। বসুন্ধরা কিংস চাইছে এএফসি ক্লাব ফুটবলের আঞ্চলিক গ্র“পে চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরবর্তী ধাপে খেলতে। এটি অনেক বড় চ্যালেঞ্জ তবে অসাধ্য নয়। আত্মবিশ্বাস এবং সামর্থ্যরে শতভাগ প্রয়োগে সবকিছুই সম্ভব। সময়মতো শুধু জ্বলে উঠতে হবে।

১৮, ২১ ও ২৪ মে ভারতের কলকাতার সল্টলেক স্টেডিয়ামে বসুন্ধরা কিংস এএফসি এশিয়ান কাপে গ্র“প চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে লড়বে যথাক্রমে মালদ্বীপের মার্জিয়া স্পোর্টস, ভারতের এটিকে মোহনবাগান ও গোকুলাম কেরালা এফসির বিপক্ষে। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে অংশগ্রহণ মানে দেশের প্রতিনিধিত্ব। দেশের মানুষ তাকিয়ে থাকবে আশাভরা মন নিয়ে বসুন্ধরা কিংসের দিকে। বসুন্ধরা কিংস পুরোপুরি একটি ভারসাম্যময় দল। দ্বিতীয় লিগে দলের শক্তি আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে নতুন দুজন বিদেশি খেলোয়াড় অন্তর্ভুক্ত করে। কোনো ধরনের চাপে ভোগা নয়, খেলতে হবে নির্ভার ফুটবল। খেলাটা উপভোগ করতে পারলে তীব্রভাবে চাওয়ার ফল মিলবে।

                লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর