শিরোনাম
সোমবার, ৩০ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

ইউক্রেন যুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাব ও আমাদের সতর্কতা

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার, এনডিসি (অব.)

ইউক্রেন যুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাব ও আমাদের সতর্কতা

যুদ্ধকবলিত ইউক্রেনে এখন বসন্ত। মাঠে ও বাগিচায় ফুটেছে অপরূপ সব ফুল : টিউলিপ, ড্যাফোডিল, গোলাপ, গ্লাডিওলাস...। সূর্যমুখী তো আছেই। কিন্তু ভয়াবহ রুশ আক্রমণে বিধ্বস্ত ইউক্রেনবাসীর মনে নেই বসন্তের আমেজ। অন্যদিকে, বাংলাদেশে এখন কৃষ্ণচূড়া-সোনালু-জারুল ফোটা দিনে গ্রীষ্মের কঠিন দাবদাহ। কিন্তু অসাধু একদল ব্যবসায়ী, মুনাফাখোর, মজুদদার, কালোবাজারি, সিন্ডিকেটবাজদের মনে রীতিমতো ফাল্গুনের আমেজ। ইচ্ছামতো দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে, তেলেসমাতি করে লক্ষ কোটি মানুষকে জিম্মি করে, পকেট কেটে তারা দিব্যি গাইছে বসন্তের গান। অথচ যুদ্ধের জেরে বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও এখন এক ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি। এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে খাদ্য নিরাপত্তারও বিঘ্ন ঘটতে পারে।

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া যুদ্ধ বর্তমানে একটি জটিল অবস্থায় পৌঁছেছে। উভয় পক্ষই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি টানার বিষয়ে অনমনীয়। ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়টি ইউরোপের এ যুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করবে। যুদ্ধরত দেশ দুটির মধ্যে আলোচনাও বন্ধ রয়েছে। রাশিয়ার আগ্রাসনে শুধু ইউক্রেনই ল-ভ- হয়নি, যুদ্ধের জেরে সারা বিশ্বের অর্থনীতিও প্রায় ল-ভ- হওয়ার পথে। যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংকটের মাত্রা বহুমুখী, কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ, রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যতটা ব্যতিব্যস্ত, যুদ্ধ থামাতে কিংবা যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট সংকট প্রশমনে বাস্তবিক অর্থেই কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এই নিবন্ধে মূলত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তার কিছু বিষয় আলোচনা করব। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি এবং প্রেসিডেন্ট পুতিন ও ন্যাটো জোটের নেতৃত্বে থাকা দেশগুলোর শীর্ষপর্যায়ের ব্যক্তিদের বক্তব্য দেখে মনে হয়, এ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে এবং তা কয়েক বছর পর্যন্ত চলতে পারে। সরাসরি যুদ্ধে যে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি, তার চেয়ে যুদ্ধের নানামুখী অভিঘাতের ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানি অনেক বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বের মোট রপ্তানির ৩০ শতাংশ গম উৎপাদন করে। ইউক্রেন একা বিশ্বের ২০ শতাংশ ভুট্টা রপ্তানি করে। সূর্যমুখী তেল রপ্তানিতে বিশ্বে ইউক্রেন শীর্ষে। রাশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় সার রপ্তানিকারক দেশ। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক খাদ্যশস্য, ভোজ্য তেল, জ্বালানি ও সার সরবরাহের শৃঙ্খল ভেঙে পড়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বাংলাদেশকে মূলত তিনটি উপায়ে প্রভাবিত করছে। প্রথমত গমের বাজার, দ্বিতীয়ত ভোজ্য তেলের বাজার, তৃতীয়ত সারের খরচ।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন মূলবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের এখন নাভিশ্বাস উঠেছে। বিশেষ করে গত নভেম্বর মাসে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির পরপরই জীবনযাত্রার খরচ বাড়তে শুরু করে। ইউক্রেন যুদ্ধের উসিলায় ভোজ্য তেলের দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে প্রমাদ গুনছে সাধারণ মানুষ। ভোজ্য তেল নিয়ে তেলেসমাতি কারবার ভোক্তাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করেছে। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের পরও একদল অসাধু দুর্ধর্ষ ব্যবসায়ীর কার্যক্রম ছিল বিস্ময়করভাবে মুনাফালোভী মনোভাবের। তাহলে এরা কি বাংলাদেশে সবচেয়ে শক্তিশালী? সাধারণ মানুষের মনে এই নিয়ে নানা প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের বাজারে। নিত্যপণ্যের দাম অতীতের প্রায় সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। অধিকাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেশি। এমন সব পণ্যের দাম অযৌক্তিকভাবে বেশি, যেগুলো দেশেই বিপুলভাবে উৎপাদিত হয় এবং এর সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই। মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় তীব্র চাপে পড়েছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের পূর্বাভাস দিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস সম্প্রতি বলেছেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বেড়ে চলা খাদ্য সংকট বিশ্বকে একটি মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে।’ জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, ‘এই যুদ্ধ দরিদ্র দেশগুলোর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।’ আইএমএফ প্রধান বলেছেন, ‘যুদ্ধের মারাত্মক প্রভাব পড়বে বিশ্ব অর্থনীতিতে যদি তা দীর্ঘ মেয়াদে চলতে থাকে। চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া সংকট পুরো বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশও এর অসহায় শিকার। গত ১৪ মে, ভারত সরকার গম রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশ হলো ভারতীয় গমের একক বৃহত্তম আমদানিকারক। এ ছাড়া গম হলো বাংলাদেশে দ্বিতীয় সর্বাধিক ব্যবহৃত খাদ্যশস্য। ভারত গম রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিতে না দিতেই, চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারে গমের দাম বেড়ে গেছে। তবে পরবর্তীতে, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশে গম রপ্তানি বন্ধ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত। কিন্তু রপ্তানিকারকদের নানা শর্ত ও জিটুজি (সরকার টু সরকার) পদ্ধতির বাইরে না যাওয়ার ঘোষণায় গম না পাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে। বাংলাদেশের আমদানিকারকরা বলছেন, জিটুজি পদ্ধতিতে গম আমদানিতে বেশ বেগ পোহাতে হবে ব্যবসায়ীদের। এ ক্ষেত্রে সরকারকেই জরুরিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। এটা ঠিক যে আমাদের প্রধান খাদ্য চালের চাহিদা মূলত অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে মেটানো হয়। তবুও আমাদের প্রায় প্রতি বছর বেশ কিছু পরিমাণ চাল উচ্চমূল্যে আমদানি করতে হয়। এই যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দাম ঊর্ধ্বমুখী, যে কারণে বাংলাদেশকে অধিক মূল্যে চাল আমদানি করতে হচ্ছে। এ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে চাল রপ্তানিকারক দেশগুলো থেকে পণ্যটির রপ্তানি হ্রাস পেতে পারে, যা এটির দাম আরও ঊর্ধ্বমুখী করবে। যুদ্ধের কারণে সারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষি, বিশেষ করে ধানের উৎপাদন ব্যাপকভাবে সারের ওপর নির্ভরশীল। রাশিয়া ও বেলারুশ প্রধান বৈশ্বিক সার রপ্তানিকারক দেশ। চলমান যুদ্ধ ও রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা এ বাজারগুলোকে ব্যাহত করেছে। বাংলাদেশ তার এ চাহিদার প্রায় ৭৫% রাশিয়া (৩৪%) ও বেলারুশ (৪১%) থেকে আমদানি করে থাকে। সারের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশকে অন্য দেশ থেকে পণ্যগুলো আমদানি করতে হবে এবং এতে দাম বেশি দিতে হবে। বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্যহারে ভুট্টা ও সয়াবিন আমদানি করে। বিশ্বব্যাপী এ পণ্যগুলোর দাম বাড়ছে। এতে দেশের হাস-মুরগি, গবাদিপশু ও মাছের খাবারের পণ্যগুলোর উৎপাদন খরচ বাড়াবে। আগামী দিনে প্রাণিজ পণ্যের সহজলভ্যতা হ্রাস এবং গম, ভোজ্য তেল ও চালের মতো পণ্যগুলোর উচ্চমূল্য এবং সরবরাহ বিঘ্নতা খাদ্য নিরাপত্তাকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।

মূল রণাঙ্গন থেকে দূরে থেকেও একটি জনপদে যুদ্ধের অভিঘাত কত ভয়ংকর হতে পারে, তা আমাদের পূর্বের প্রজন্ম দেখেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সংঘটিত (ইংরেজি ১৯৪৩ কিংবা বাংলা ১৩৫০) দুর্ভিক্ষে অবিভক্ত বাংলায় লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। যদিও বাংলায় উল্লেখযোগ্য কোনো যুদ্ধই হয়নি। সেই সময়ে কলকাতা মহানগরীর গৃহস্থ বাড়ির দরজায় প্রায়ই অনাহারক্লিষ্ট নরনারী ও শিশুর করুণ আর্তনাদ শোনা যেত। ‘মাগো একটু ফ্যান দাও’। তবে সেই ভয়ংকর দুর্ভিক্ষকালেও ‘কলকাতার বাবুদের’ আরাম আয়েশ আনন্দ বিনোদনের কমতি ছিল না। সেই সময় থেকে এ অঞ্চলের ব্যবসার সঙ্গে ‘মজুদদারি, মুনাফাবাজি ও কালোবাজারি’ শব্দগুলোর ব্যাপক প্রচার হতে থাকে। বিশ্বযুদ্ধের প্রায় ৮০ বছর পরেও আমাদের সমাজ জীবনে এই পাপ চলছেই। এই পাপ কি অবিরাম চলবেই?

রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের চলমান বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন। ১৯৭৪ সালে কিউবায় পাট রপ্তানি করতে গিয়ে চরম বিপদে পড়েছিল তৎকালীন সরকার। কিউবার ওপর সে সময় বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৭৪ সালে কয়েক মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ মূল্যে ৪০ লাখ পাটের থলে বিক্রির জন্য কিউবার সঙ্গে চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি)। বিজেএমসি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিএল ৪৮০ অ্যাক্টের অধীন নিষেধাজ্ঞা বিধি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল না। যুদ্ধবিধ্বস্ত ও বন্যাকবলিত বাংলাদেশে খাদ্য সংকট চলছে, বিধায় খাদ্য সাহায্যের জন্য তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সহায়তা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল। এই সময়ে বাংলাদেশের কাছ থেকে কিউবায় কোনো কৃষিপণ্য রপ্তানি করা হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দাবি করে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে অনড় অবস্থানে থাকে আমেরিকার সরকার। একপর্যায়ে খাদ্য ও ভোজ্য তেলে সহায়তা বাবদ প্রতিশ্রুত চালান আটকে দেয় দেশটি। অবশেষে কিউবায় পাট রপ্তানি বন্ধের পরই আবারও খাদ্য সহায়তা পাঠাতে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ততদিনে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। আর তাই, এই প্রেক্ষাপটে আমাদের কূটনীতিক, সরকারের সংস্থাগুলো ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চলমান স্যাংশন সম্পর্কে অবশ্যই ওয়াকিবহাল ও সচেতন থাকতে হবে। আমাদের অর্থনীতিতে এখন নানামুখী চাপ। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি ছাড়াও ক্রমশ আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে কমছে বিদেশের রেমিট্যান্স আয়। ডলারের বিপরীতে টাকার রেকর্ড অবমূল্যায়ন হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আসছে। সব মিলিয়ে গত ১৩-১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে চাপে রয়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি।

সার্বিক বিষয় আমলে নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে নানা রকম প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। এখনই বাস্তবায়নযোগ্য জরুরি নয়, এমন সব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ স্থগিত রাখাসহ নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। উন্নয়ন প্রকল্পে কৃচ্ছ্রতা সাধন ও ব্যয়ে লাগাম টানার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘খাদ্য সাশ্রয় করা বা আমাদের যা আছে সবগুলো ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সবাইকে একটু সাশ্রয়ী হতে হবে। আমাদের পানি, বিদ্যুৎ, খাদ্যশস্য, প্রতিটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবাইকে সাশ্রয়ী হতে হবে।’ গত ২০ মে এর জিসিআরজি বৈঠকে বিশ্বে সংকট নিরসনে আমাদের প্রধানমন্ত্রী চার দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের সংকট সামলাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকার কিছু পণ্যের ওপর থেকে অগ্রিম আয়কর তুলে নিয়েছে। এদিকে করোনাভাইরাস মহামারির অভিঘাত ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে চাপ তৈরি করেছে তা মোকাবিলায় অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে একসঙ্গে বসে করণীয় ঠিক করার নির্দেশ দিয়েছেন সরকার প্রধান। এই অবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চমূল্য ও মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো খুবই প্রয়োজন। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষকে সহায়তা দিতে হবে যেন তারা বাজার থেকে পণ্য কিনতে পারে। তাদের দিতে হবে সামাজিক সুরক্ষা। এ অবস্থায় বাজার মনিটরিং জোরদার করা প্রয়োজন। বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হতে পারে। আমদানিকারকরা যেন বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য আনতে পারেন, সেক্ষেত্রে সরকারের (বিকল্প উৎস সন্ধান, যোগাযোগ, নিগোসিয়েশন) উদ্যোগ ও সহায়তা প্রয়োজন। যথাযথ চ্যানেলের মাধ্যমে আরও বেশি রেমিট্যান্স প্রবাহ নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। এ অবস্থা থেকে আমাদের পরিত্রাণের অন্যতম প্রধান উপায় হলো কৃষিজাত খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি। গত ১৩-১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে চাপে রয়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। বলা বাহুল্য, ক্ষমতাসীন সরকার এই সংকটটি সৃষ্টি করেনি। এটি বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব। তবে জনগণের প্রত্যাশা সরকারই সমস্যার সমাধান করুক। রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে, সতর্ক, সাশ্রয়ী ও সচেতন হয়ে নাগরিকদেরও এক্ষেত্রে অবদান রাখার দায়িত্ব ও সুযোগ রয়েছে। আত্মতুষ্টি নয়, বাস্তবতার অস্বীকার (ডিনায়েল) করাও নয়। আতঙ্ক, ভয় নয়। প্রয়োজন সতর্কতা ও সচেতনতা। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সহস্র সুরভিত বর্ণিল ফুল ফুটুক গণমাধ্যমের মুক্ত বাগানে। শেষ হোক সর্বনাশা এই যুদ্ধ।

বর্তমান অবস্থা সরকারের জন্য একটি অগ্নিপরীক্ষা। গত ১৩ বছরে বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশে অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসাধারণ উন্নয়ন ঘটেছে। জনগণের মনে সরকারের এই ভাবমূর্তি অম্লান রাখতে হলে, সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠাসহ এই কঠিন পরীক্ষায় সরকারকে উত্তীর্ণ হতে হবে। একই সঙ্গে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান জনগণ আশা করে। বর্তমান সরকার অতীতে অনেক চ্যালেঞ্জ দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছে। বিশেষত করোনাকালীন নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনা দেশে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। আশা করি, সরকারের দূরদর্শী ও বিচক্ষণ পদক্ষেপ এবং সরকার ও নাগরিকদের সম্মিলিত প্রয়াসে চলমান সংকট কাটিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর