হজের ইতিহাস ও এর বিধিবিধানের সঙ্গে ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর পরিবারের স্মৃতি গভীরভাবে জড়িত। যে মক্কায় গিয়ে মুসলিম উম্মাহ আজ হজ আদায় করেন, সেই ভূমি একসময় বিরান ও অনাবাদি ছিল। সেখানে না ছিল পানির ব্যবস্থা, না ছিল খাবারের ব্যবস্থা। মক্কায় তখন কোনো মানুষও বাস করত না। নুহ (আ.)-এর মহাপ্লাবনে কাবাঘরও চিহ্নহীন হয়ে পড়েছিল। আল্লাহর নির্দেশে জনমানবশূন্য সেই প্রান্তরে স্ত্রী হাজেরা (আ.) ও দুধের শিশু ইসমাইল (আ.)-কে রেখে আসেন ইবরাহিম (আ.)। অল্প দিনে সঞ্চিত খাবার-পানি ফুরিয়ে যায়। শুকিয়ে যায় হাজেরা (আ.)-এর স্তনের দুধ। শিশু ইসমাইল ক্ষুধায় কান্না শুরু করেন। অস্থির মা পানির খোঁজে ছোটাছুটি করতে থাকেন। একবার তিনি দৌড়ে যান সাফা পাহাড়ে, একবার মারওয়া পাহাড়ে। এভাবে সাতবার তিনি দুই পাহাড় প্রদক্ষিণ করেন। এরপরই আল্লাহর কুদরতে দুই পাহাড়ের মাঝে জমজম কূপ সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে অলৌকিক এই কূপকে ঘিরে গড়ে ওঠে জনপদ। এটাই মক্কা নগরী।
আল্লাহ এই কূপের ভিতর এমন এক অলৌকিকত্ব রেখেছেন, প্রতি বছর লাখ লাখ হাজি এখান থেকে পানি পান করেন, নিজ দেশে পানি নিয়ে আসেন, শুধু তাই নয়, পাইপ টেনে মক্কা থেকে পানি নিয়ে যাওয়া হয়েছে মদিনায়, সেখানেও লাখ লাখ মানুষ এর পানি পান করেন, তবু জমজমের পানি ফুরায় না। কেয়ামত পর্যন্ত ফোরাবেও না। এটাই আল্লাহর কুদরত।
ইবরাহিম (আ.)-এর পরিবারের অসিলায় একসময়ের বিরান মক্কাকে মহান আল্লাহ এমনভাবে জাগিয়ে দিলেন, এ শহর চিরজাগ্রত। এ শহর কখনো ঘুমায় না। যত বড় শহরই হোক, প্রত্যেক শহরেরই একটা বিশ্রামের সময় আছে। কিন্তু মক্কার নেই। শুধু রোজা কিংবা হজের মৌসুম নয়, বছরের কোনো সময়ই মক্কা নগরী ঘুমায় না। অনেক হাজি ভাবেন, রাত দুটোর সময় সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকবে, তিনি নিরিবিলি তাওয়াফ করবেন, হাজরে আসওয়াদে চুমু খাবেন। কিন্তু কাবা চত্বরে গিয়ে দেখেন সেই মাঝরাতেও তার মতো আরও অসংখ্য হাজি তাওয়াফ করছেন। একজন দুজন নয়, হাজার হাজার মানুষ।
ইসমাইল (আ.) যখন বড় হলেন, মক্কায় ফিরে এলেন ইবরাহিম (আ.)। আল্লাহর নির্দেশে পিতা-পুত্র কাবাঘর পুনর্নির্মাণের কাজে হাত দিলেন। নির্মাণকাজ যখন শেষ হলো, আল্লাহ ইবরাহিম (আ.)-কে আদেশ করলেন, তিনি যেন বিশ্ববাসীর উদ্দেশে হজের ঘোষণা দেন। আল্লাহর সেই নির্দেশনা পবিত্র কোরআনে উদ্ধৃত হয়েছে এভাবে : আর মানুষের মাঝে হজের ঘোষণা দাও, তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে, আর সব শীর্ণ উটের পিঠে, বহুদূরের গভীর পর্বত-সংকুল পথ বেয়ে (সুরা হজ, ২৭)।
৫ হাজার বছর আগে তখন মিডিয়া, ইন্টারনেট ছিল না। মক্কা থেকে হজের ঘোষণা দিলে সেটা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছানোর কথা নয়। বিষয়টা বাহ্য চোখে অযৌক্তিক। কিন্তু ইবরাহিম (আ.) কোনো ধরনের প্রশ্ন তোলেননি, দ্বিধায় ভোগেননি। বরং আল্লাহর প্রতি অনুগত থেকে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর সেই ঘোষণা কুদরতিভাবে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে। ইবরাহিম (আ.)-এর সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে এখন প্রতি বছর সারা পৃথিবী থেকে লাখ লাখ মানুষ মক্কায় যায় হজ করতে।
হজের ঘোষণার মতো আল্লাহর অনেক বিধান আমাদের যুক্তিতে ধরে না। সন্দেহ থেকে কেউ সংশয়বাদী, কেউ নাস্তিক হয়ে যায়। ইসলাম মূলত পূর্ণাঙ্গ আনুগত্যের নাম। আল্লাহর কোনো বিধান আমাদের বোধগম্য হোক কিংবা না হোক, আমাদের মেনে নিতে হবে। হতে পারে কোনো বিষয় এখন বোধগম্য হচ্ছে না, কিন্তু ৫০০ বছর পর সেটা বোধগম্য হতে পারে। তাই আল্লাহর বিধানের ক্ষেত্রে সব সময় আমাদের আনুগত্যের পরিচয় দিতে হবে।
মক্কা নগরীর জন্য ইবরাহিম (আ.) বিশেষ এক দোয়া করেছিলেন। সেটা আল্লাহ কোরআনে উল্লেখ করেছেন : হে আমাদের পালনকর্তা, আমি নিজের এক সন্তানকে তোমার পবিত্র গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় আবাদ করেছি। হে আমাদের পালনকর্তা, যাতে তারা নামাজ কায়েম করে। অতঃপর আপনি কিছু লোকের অন্তরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করুন এবং তাদের ফলমূল দ্বারা রিজিক দান করুন, যেন তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে (সুরা ইবরাহিম, ২৭)।
ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া আল্লাহ কবুল করেছেন। মানুষের অন্তরে মক্কার আকর্ষণ এমনভাবে প্রোথিত করেছেন, মানুষের অনুভবে মক্কা কখনো পুরোনো হয় না। যারা একবার যায়, তারা বারবার যেতে ব্যাকুল হয়। আবার মক্কার পার্শ্ববর্তী তায়েফকে আল্লাহ রকমারি ফল দ্বারা সমৃদ্ধ করেছেন। তাই আমরা অন্তর্চক্ষু নিয়ে হজে যাব। হজের সফরে যদি আমাদের অন্তর্চক্ষু খোলা থাকে, সফরের পদে পদে আমরা আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন এবং ইবরাহিম (আ.)-এর স্মৃতির স্মারক দেখতে পাব। তবেই আমাদের হজ সার্থক হবে।
গ্রন্থনা : সাব্বির জাদিদ