শুক্রবার, ১১ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জনক বঙ্গশার্দুল মেজর গনি

আবুল কাশেম হৃদয়

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জনক বঙ্গশার্দুল মেজর গনি

বিভাগোত্তর বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষের সূচনালগ্নেই বাঙালিদের মধ্যে সামরিক মনোভাবের জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জনক মেজর আবদুল গনি (১৯১৫-১৯৫৭)। পাকিস্তানের নবনিযুক্ত সেনাপ্রধান ব্রিটিশ জেনারেল স্যার ফ্রাঙ্ক মেসার্ভির অনুমতি নিয়ে তিনি পূর্ব বাংলার বাঙালি যুবকদের দ্বারা ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করেন। মেজর আবদুল গনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের রিক্রুটিং অফিসারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনিই প্রথম বাঙালিদের মধ্যে সামরিক মনোভাবের জাগরণ সৃষ্টি করছিলেন। যা ছিল তাঁর স্বপ্নসাধ। তিনি সে স্বপ্ন পূরণের কারিগর হলেও প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট কর্নেল ভি জে ই প্যাটারসন। বাঙালি যুবকদের নিয়ে রেজিমেন্ট গঠনে মেজর আবদুল গনির স্বপ্ন পূরণের সূচনা হয় এভাবেই। তিনি বাঙালিদের সেনাবাহিনীতে প্রবেশ ঘটাতে উৎসাহের পাশাপাশি তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। চষে বেড়িয়েছিলেন পূর্ব বাংলার এক জেলা থেকে আরেক জেলায়। দীর্ঘ দেহী যুবকদের তিনি খুঁজে খুঁজে জোগাড় করেছিলেন। তিনি যেখানেই গেছেন সেখানেই যুবকের ঢল নেমেছিল। তাঁর হাত দিয়ে সৃষ্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে আটটি বড় রেজিমেন্টে পরিণত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখা চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ‘বেবী টাইগার্স’-এর একটি কোম্পানি নিউক্লিয়াস হিসেবে নবম ইস্ট বেঙ্গল গঠন হয়। এই ৯টি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের হাত ধরেই গড়ে উঠে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। জীবনবাজি রেখে পাকিস্তানি সেনাদের রুখে দিতে তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকরা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক কুমিল্লা সেনানিবাসের বাঙালি সেনা ইউনিটগুলোকে নিরস্ত্র করার সময় ১৭ জন বাঙালি অফিসার ও অন্যান্য র‌্যাংকের ৯১৫ জন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যের প্রাণ উৎসর্গসহ অগণিত বাঙালি সৈনিকের আত্মত্যাগের ফলে আসে বাঙালির দীর্ঘদিনের আরাধ্য স্বাধীনতা। ফলে বিভাগোত্তর বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষের সূচনাতেই মেজর আবদুল গণি বাঙালি সৈনিকদের স্বাতন্ত্র্য পরিচয় বিকাশের যে স্বপ্ন বুকে লালন করেছেন তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়। ১৯১৫ সালের ১ ডিসেম্বর কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার নাগাইশ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মেজর মোহাম্মদ আবদুল গনি। তিনি ছিলেন সুঠাম বলিষ্ঠ দেহের এবং উদার মনের অধিকারী। তাঁর ব্যবহার ছিল অমায়িক কিন্তু কথা বলার ভঙ্গি ছিল স্পষ্ট ও স্বচ্ছ। দেশ ও জাতির কল্যাণে সত্য ও স্পষ্ট কথা সহজ সরল ও নির্ভীকভাবে তিনি বলতে পারতেন। অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়াতে ইতস্ত করতেন না। ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কুর্মিটোলায় প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠার দিন সেখানে পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের গভর্নর স্যার ফ্রেডারিক বোর্ন, মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন, পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি মেজর জেনারেল আইয়ুব খানসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ও কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সে অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে জিওসি আইয়ুব খান সবার উদ্দেশে বলেন, এখন থেকে বাঙালি সৈনিকরা বাংলা নয় উর্দুতে কথা বলবে। এ কথা শুনেই ক্ষিপ্রতার সঙ্গে প্রতিবাদ করে ওঠেন মেজর আবদুল গনি। তিনি বলেন, ক্ষমা করবেন স্যার। আমরা বাঙালি সৈনিকরা উর্দুতে কথা বলতে পারব না কারণ আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। মেজর জেনারেল আইয়ুব খান ধমক দিয়ে মেজর গনিকে থামিয়ে দিলেও এই সাহসী ভূমিকার কারণে তিনি টাইগার গনি নামে পরিচিত পান। সে সময় ক্ষুব্ধ হলেও পরবর্তীতে দেশ, জাতি ও সেনাবাহিনীর কল্যাণে মেজর গনির অবদানের কথা স্বীকার করেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান। ১৯৫৭ সালের ১১ নভেম্বর জার্মানির ফ্রাঙ্কফুটে মেজর আবদুল গনির মৃত্যুর পর তিনি এক শোকবার্তায় বলেন, ‘মেজর গনি সেনাবাহিনী ও জাতির জন্য যে সেবা করে গেছেন তার মূল্য অত্যন্ত বেশি’। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খানকে (পরবর্তীতে ফিল্ড মার্শাল ও প্রেসিডেন্ট) পূর্ব পাকিস্তানের জেনারেল অফিসার কমান্ডিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী বলতে কিছু ছিল না। দেশ বিভাগের সময় পাকিস্তানের হাতে ছিল দুটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন। এদের একটিতে ছিল তিনটি মুসলিম কোম্পানি। অন্যটিতে ছিল একটি শিখ ও একটি ডোগরা কোম্পানি। সে সময় ঢাকায় সেনা সদর দফতর করার জন্যও তেমন কিছু ছিল না। মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান পুরো পূর্ব পাকিস্তান ঘুরে ঢাকায় একটি ও কুমিল্লায় একটি সেনানিবাস স্থাপন করেন। এ দুটি এলাকা পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির জেনারেল হেডকোয়ার্টার অনুমোদন করে। ‘ফ্রেন্ড নট মাস্টার্স’ গ্রন্থে আইয়ুব খান লিখেছেন, ‘শুরুর দিকে কুমিল্লা সেনানিবাস সম্পর্কে তিনি ভাবেননি। ঢাকার উত্তর দিকে রাজেন্দ্রপুরেই নতুন সেনানিবাস প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ময়নামতিতে একটি ক্ষুদ্র লাইট ইনফ্যান্ট্রি ইউনিটের চেয়ে বেশি কিছু ছিল না।’ জানা গেছে, কুর্মিটোলাতে প্রথম কুঁড়েঘর তৈরি হয়েছিল মেজর গনির জন্যই।

১৯৫৭ সালের ১১ নভেম্বর জার্মানির ফ্রাঙ্কফুটে বিশ্ব সাবেক সৈনিক সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করা কালীন সময়ে মেজর আবদুল গনি মারা যান। মেজর গনির মরদেহ ১৭ নভেম্বর পাকিস্তানের করাচিতে আনা হয়। সেখান থেকে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর একটি কার্গো বিমানে করে আনা হয় ঢাকায়। পরে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় কুমিল্লা সেনানিবাসে সমাধিস্থ করা হয়।

লেখক : মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক ও সম্পাদক, দৈনিক কুমিল্লার কাগজ।

[email protected]

সর্বশেষ খবর