শনিবার, ১২ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

পাল্টে যাচ্ছে বরেন্দ্রর কৃষি প্রকৃতি

শাইখ সিরাজ

পাল্টে যাচ্ছে বরেন্দ্রর কৃষি প্রকৃতি

সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ। বৃষ্টিহীন বর্ষা শেষেও উত্তপ্ত শরৎ। আমরা চলছিলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে নাচোলের পথ ধরে। যতদূর চোখ যায় কেবল সবুজের সীমারেখা। বরেন্দ্র এমন সবুজ আর সমৃদ্ধ ছিল না। গত শতাব্দীর সেই আশির দশক থেকে এ অঞ্চলের কৃষি সংস্কৃতির সঙ্গে আমার পরিচয়। বহুবার প্রতিবেদন ধারণ করতে এ অঞ্চলগুলোতে আসা হয়েছে। সে সময় দেখেছি সেচের অভাবে কৃষিকাজ তেমন হতো না। ফলে কর্মহীনতাই ছিল সেখানকার দারিদ্র্যের মূল কারণ। বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে বছরে একটা ফসল হয়তো ফলানো যেত। কিন্তু এরপর সারা বছর জমিগুলো পড়ে থাকত চাষ-আবাদ ছাড়াই। যতদূর চোখ যেত ধু-ধু প্রান্তর। কোথাও কোথাও খরার এমন প্রকোপ ছিল বড় বড় গাছকেও দেখতাম পাতাহীন শুকনো কয়েকটা ডাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। বরেন্দ্রর মানুষজনের ছিল পানির কষ্ট। ছিল অভাব।

বারিড-পাইপ সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে বরেন্দ্র পাল্টে যায়। এক ফসলি জমিগুলোতে দুই অথবা তিন ফসল হতে থাকে। ক্রমেই সবুজ হয়ে ওঠে বরেন্দ্র। সঙ্গে একটু একটু করে সমৃদ্ধি ধরা দেয় কৃষকের হাতে। বিগত এক দশক ধরে ধান চাষের জন্য প্রসিদ্ধ এ অঞ্চলে শুরু হয়েছে অন্যরকম কৃষি সমৃদ্ধির কার্যক্রম। ড্রোনের চোখে ওপর থেকে দেখলেই বোঝা যায় সবুজ ধানের জমিগুলোতে ঢুকে গেছে গাঢ় সবুজ রঙের আরেক কৃষি। মূলত তরুণদের হাত ধরেই বদলে যাচ্ছে বরেন্দ্রর চাষাবাদ, মাঠের চিত্র। উচ্চমূল্যের ফল-ফসল চাষে উদ্যোগী হচ্ছেন তারা। সম্প্রসারিত হচ্ছে বাণিজ্যিক কৃষি। এমনই এক উজ্জ্বল উদাহরণ তৈরি করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোলের রফিকুল ইসলাম। আমরা যাচ্ছিলাম নাচোলের খাসুরায় রফিকুলের ফলের বাগানে।

রফিকুলের বয়স ৪০-৪৫ হবে। শিক্ষকতা দিয়ে পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন। টেলিভিশনে আধুনিক কৃষি দেখে শুরু করলেন উচ্চমূল্যের ফল-ফসলের চাষ। জেনেবুঝে কৃষিতে যুক্ত হলে সেখান থেকে লাভ করা যায়। আর রফিকুল সেই সত্যই অনুধাবন করে কঠোর পরিশ্রমে পাল্টে দিয়েছেন নিজেকে। এখন কৃষিতেই ধ্যান-জ্ঞান। উচ্চমূল্যের ফল-ফসল নিয়ে রফিকুলের বিশাল কর্মযজ্ঞ। বছর দুই আগেও তার কার্যক্রম আমরা তুলে ধরেছিলাম হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে। এ দুই বছরে রফিকুল এগিয়ে গেছেন আরও অনেকখানি পথ। সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতা থেকেও শিখেছেন নানান কিছু। বেড়েছে তার কৃষির অঙ্গন। নিজের পাশাপাশি এলাকার অনেকের কর্মসংস্থানের পেছনে সরাসরি অবদান তার।

রফিকুল আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি আমাদের তুলনামূলক উঁচু একটা জায়গায় নিয়ে গেলেন। সেখানে বেশ কিছু শেড। বোঝা গেল শ্রমিকদের থাকার জায়গা। আমরা যখন রফিকুলের কৃষি খামারে পৌঁছলাম, তখন কৃষি শ্রমিকদের মধ্যাহ্নভোজের সময়। বিশাল বিশাল রান্নার পাত্রে ভাত, মুরগির মাংস, ডাল রান্না করা। আর শ্রমিকরা সারি বেঁধে খেতে বসেছেন। কেউ খাওয়া শেষ করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছেন। একদিকে চলছে বাঁশের কাজ। আগামী কৃষি কাজের প্রস্তুতি। বেশ কর্মচঞ্চল। কম করে হলেও ১০০ জন হবে। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম। তারা জানালেন বরেন্দ্রে কুল, পেয়ারা, ড্রাগন, মাল্টা আর অমৌসুমি আমের চাষ বেড়েছে। এর ফলে তারা বারো মাস কাজ পাচ্ছেন। এখন আর অভাব নেই। বয়স ৫০-৫৫ হবে একজনের, নাম মোতালেব, পুরনো দিনের স্মৃতি স্মরণ করে বললেন, আগে এমনও দিন গেছে, দুই দিনে এক বেলা হয়তো খেতে পেরেছি, তাও পেট ভরে খেতে পারতাম না। আর এখন হাজার দশেক টাকা সব সময়ই ঘরে থাকে। মনে পড়ল বছর চারেক আগে কুড়িগ্রামে গিয়েছিলাম কৃষকের ঈদ আনন্দ অনুষ্ঠান ধারণ করতে। সেখানে এক কৃষক মঙ্গার কথা তুলে বলছিলেন, ‘আগে আমাদের চিন্তা ছিল কী খাব, আর এখন ভাবী কী দিয়ে খাব!’ তাদের কথা শুনে মন ভরে গেল। কৃষি সমৃদ্ধ এক দেশের স্বপ্নই তো আমরা দেখে আসছি।

পুরুষদের পাশাপাশি এলাকার অনেক নারীরও কর্মসংস্থান হয়েছে রফিকুলের এ কৃষি উদ্যোগে। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে মেয়েরাও যুক্ত হয়েছে। তাদের সঙ্গে কথা শেষে রফিকুলকে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। কৃষি শ্রমিকদের জন্য রান্না করা দুপুরের খাবার খেলাম মন ভরে। তারপর খাওয়া-দাওয়া শেষে গেলাম রফিকুলের ফলের বাগানে।

পাঁচ দাগে মোট সাড়ে ৮০০ বিঘা জমিতে আম, মাল্টা, পেয়ারা আর ড্রাগনের বাগান। ১৫০ বিঘায় গোরমতি আমের বাগান। বারি-৪ আর আম্রপালি মিলে হবে প্রায় ১৫০ বিঘার মতো। বারোমাসি কাটিমন আমের চাষ ১০০ বিঘায়। মাল্টার চাষ ৮০ বিঘায়। প্রায় সাড়ে ৩০০ বিঘায় পেয়ারা। শরিফা আছে ৪০ বিঘা জমিতে। একেকটি বাগান এত দীর্ঘ যে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হেঁটে যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। এ অমৌসুমেও রফিকের বাগানে পুরোদমে চলছে আম পাড়ার কাজ। প্রায় বছর পাঁচেক আগে হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানেই প্রথম তুলে ধরেছিলাম চুয়াডাঙ্গার আবুল কাশেমের বারোমাসি কাটিমন আমের বাগান নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন। রফিকুল জানালেন, সেই প্রতিবেদন দেখেই কাশেমের কাছ থেকে প্রথম কাটিমন আমের চারা সংগ্রহ করেন। এখন তার গাছে গাছে আম। এ অমৌসুমের আম থেকে পাচ্ছেন ভালো লাভ। বাগান থেকেই ২৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন।

আগেই বলেছি রফিকুলের আমের বাগানগুলো এত বিশাল যে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে যেতেই আধা ঘণ্টার চেয়ে বেশি সময় লেগে যায়। মোটরবাইকে করে বাগানের মাঝখানের মেঠোপথ দিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়ল সাথি ফসল হিসেবে পেঁপে, পেয়ারা ও আখের চাষ। কৃষি যত বেশি বাণিজ্যিক ততটাই যন্ত্রনির্ভরতার দাবি রাখে। উন্নত বিশ্বে বাণিজ্যিক কৃষির যে সম্প্রসারণ দেখেছি, তারই জোয়ার আমাদের দেশেও ইতোমধ্যে লাগতে শুরু করেছে। রফিকুলদের মতো উদ্যোক্তারাই নিজেদের প্রয়োজনে যান্ত্রিক কৃষির প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করছেন। তিনি নেদারল্যান্ডসের গ্রিন হাউসে ক্যাপসিকাম চাষের পর্বটির কথা উল্লেখ করে বলেন, এমন উদ্যোগ তিনিও নিতে চান। বর্তমান সময়ে কৃষি শ্রমিক পাওয়া কঠিন, তাই বাণিজ্যিক কৃষির ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া সফলতা আসবে না।

ভবিষ্যৎ বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়েও ভাবছেন রফিকুল। তিনি তার উদ্যোগকে ছড়িয়ে দিতে চান আরও বড় পরিসরে। নতুন নতুন ফল-ফসল চাষে উদ্যোগী হতে চান। তাই সরকারের কাছ থেকে তিনি প্রশিক্ষণ প্রত্যাশা করেন। তার দাবি গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস (গ্যাপ) সার্টিফিকেশন পেতে সরকারের তরফ থেকে সহযোগিতা। নিজের উৎপাদিত ফল-ফসল পৌঁছে দিতে চান বিশ্ববাসীর হাতে। চান রপ্তানি আয় বাড়াতে।

ভাবতে ভালো লাগে রফিকুলের মতো তরুণ উদ্যোক্তাদের হাতে রচিত হচ্ছে নতুন কৃষি। কৃষির পট পরিবর্তনের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে কৃষকের সংজ্ঞাও। আজকের দিনে বাণিজ্যিক কৃষি সম্প্রসারণ মানেই যান্ত্রিক কৃষির সম্প্রসারণ। কৃষি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন শিল্পোদ্যোক্তারাও। যে তরুণ কৃষকরা আগামীর কৃষিচর্চার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে চাচ্ছেন তাদের দিকে সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। উদ্যোগী তরুণদের কৃষি কার্যক্রমকে গতিশীল করতে তাদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার পাশাপাশি রপ্তানিমূলক কৃষিপণ্য উৎপাদনে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়ার বিকল্প নেই। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, অন্যদিকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বিশ্ব অর্থনীতির সংকটময় পরিস্থিতি, আমার বিশ্বাস কৃষি সাফল্যের মধ্য দিয়ে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। আজকের কার্যকরী পদেক্ষপ রচনা করবে আগামীর সাফল্য।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর