মঙ্গলবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা

প্রফেসর ড. মনীন্দ্র কুমার রায়

দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা

এ পৃথিবীতে কিছু ক্ষণজন্মা মানুষ জন্মগ্রহণ করেন যাঁরা তাঁদের কর্ম ও কীর্তির মাধ্যমে কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। হয়ে ওঠেন প্রাতঃস্মরণীয় এবং বরণীয়। এমনই একজন ছিলেন টাঙ্গাইলের মির্জাপুর গ্রামের রণদা প্রসাদ সাহা। যিনি মানবসেবা ও জনহিতকর কর্মের মাধ্যমে হয়ে ওঠেন দানবীর, লাভ করেন রায় বাহাদুর উপাধি। রণদা প্রসাদ সাহা ১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর অর্থাৎ বাংলা ১৩০২ সালের উত্থান একাদশীর দি¦প্রহরে ঢাকার সাভারের অদূরে শিমুলিয়া ইউনিয়নের কাছৈড় গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা দেবেন্দ্র পোদ্দার, নিবাস টাঙ্গাইলের মির্জাপুর গ্রামে আর মাতা কুমুদিনী দেবী। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ ছিলেন দ্বিতীয়। রণদা প্রসাদের সাত বছর বয়সে মা কুমুদিনী দেবী সন্তান প্রসবের সময় ধনুষ্টংকারে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায়, বিনা পথ্যে, অযত্ন-অবহেলায় মৃত্যুবরণ করেন। মায়ের এ মর্মান্তিক মৃত্যু রণদা প্রসাদের মনে গভীর রেখাপাত করে। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যদি কখনো সম্পদশালী হন মায়ের নামে একটি দাতব্য প্রসূতি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করবেন, যাতে কোনো মা সন্তান প্রসবের সময় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ না করেন। পিতা দেবেন্দ্র পোদ্দার দ্বিতীয় বিয়ে করেন। পিতার অবহেলা, সৎ মায়ের নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচারে হাসি-খুশি আর প্রাণবন্ত রণদা প্রসাদ হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। তৃতীয় শ্রেণি পাস করার পর রণদাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মামাবাড়ি। মন টিকল না মামাবাড়িতে। মাত্র ১১ বছর বয়সে মামাবাড়ি থেকে পালিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান রণদা প্রসাদ। একদিন ক্ষুধার যন্ত্রণায় এক বনের ধারে অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলেন। ওই সময় মুক্তাগাছার জমিদার রাজা জগৎকিশোর চৌধুরী সেই বনে শিকার করতে আসেন এবং অলৌকিকভাবে অচেতন অবস্থায় রণদা প্রসাদকে উদ্ধার করে নিজ বাড়ি নিয়ে আসেন। জমিদারবাড়ি থেকে রণদা প্রসাদ ১৯১০ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে ভাগ্যান্বেষণে তৎকালীন ভারতবর্ষের রাজধানী স্বপ্নের শহর কলকাতায় আসেন। কলকাতায় তাঁর জীবন মোটেও সুখের ছিল না। না ছিল টাকাপয়সা, না মাথা গোঁজার ঠাঁই। এই সময় অনেক বাঙালি যুবকের মতো রণদা প্রসাদ স্বদেশী আন্দোলনের সশস্ত্র ধারায় জড়িয়ে পড়েন এবং ধরা পড়ে হাজতবাস করেন। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ইংল্যান্ড এ যুদ্ধে যোগদান করে। ভারতবর্ষকে স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এ যুদ্ধে ইংরেজকে সাহায্যের জন্য ভারতবাসীকে সেনাবাহিনীতে যোগদানের আহ্বান জানানো হয়। ১৯২০ সালেই তিনি বিয়ে করেন বালিয়াটির জমিদারকন্যা কিরণবালা দেবীকে। ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে ১৯৩২ সালে রেলওয়ের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে কয়লার ব্যবসা শুরু করেন। তিনি লক্ষ করেন, নৌযান ব্যবসা বেশ লাভজনক। প্রতিষ্ঠা করেন বেঙ্গল রিভার সার্ভিস কোম্পানি। ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নদীপথে মালামাল আনা-নেওয়া ছিল এ কোম্পানির কাজ। একসময় এ কোম্পানিতে ৭৫টি বড় বড় পণ্যবাহী জাহাজ ছিল। মূলত নৌপরিবহন ব্যবসার মাধ্যমেই রণদা প্রসাদ সাহা একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং আর পি সাহা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৩২ থেকে ১৯৩৮ সাল মাত্র ছয় বছরের মধ্যেই আর পি সাহা একজন ধনী, সম্পদশালী, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের প্রথম দিকে আর পি সাহা জর্জ অ্যান্ডারসন কোম্পানির সমস্ত জুট বেলিং ও প্রেসিং মেশিন, সমস্ত পাটের ব্যবসা, কোম্পানির প্রায় ১০০ একর জমিসহ যাবতীয় সম্পত্তি কিনে নেন। খানপুরে অ্যান্ডারসন কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ই আজ কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের প্রধান কার্যালয়। ১৯৪৩ সালে সারা বাংলায় মারাত্মক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় যা ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামে খ্যাত। এ সময় আর পি সাহা ২৭৫টি লঙ্গরখানা খুলে টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জের অভুক্ত ও বিপন্ন মানুষকে প্রায় আট মাস খাদ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখেন। এই মানবসেবার স্বীকৃতিস্বরূপ ভারতবর্ষের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়াভেল ১৯৪৪ সালের ৮ জুন রণদা প্রসাদ সাহাকে ‘রায় বাহাদুর’ খেতাবে ভূষিত করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি মানবকল্যাণে প্রতিষ্ঠা করেন ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল’ এবং তাঁর সমস্ত সম্পত্তি ট্রাস্টের নামে দান করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ব্যয় করেন মূলত শিক্ষা ও স¦াস্থ্য ক্ষেত্রে যা মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার অন্যতম দুটি। মির্জাপুরে প্রতিষ্ঠা করেন মায়ের নামে ‘কুমুদিনী জেনারেল হাসপাতাল’। ২০ বেডের প্রসূতি ওয়ার্ডের মাধ্যমে এর যাত্রা হয় যা উদ্বোধন করেন তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার গভর্নর আর জে কেসি। আজ এ হাসপাতালে বেডের সংখ্যা ১ হাজার ৫০। সমাজে অবহেলিত, নিপীড়িত, অধিকারবঞ্চিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন নারীদের স্বনির্ভর করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন প্রমাতামহীর নামে অবৈতনিক ও সম্পূর্ণ আবাসিক স্কুল ‘ভারতেশ্বরী হোমস’। মায়ের নামে টাঙ্গাইলে কুমুদিনী মহিলা ডিগ্রি কলেজ, বাবার নামে মানিকগঞ্জে দেবেন্দ্র কলেজ, মাগুরায় বন্ধু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ডিগ্রি কলেজ, বরিশালে দাঙ্গায় নিহত শহীদ আলতাফ হোসেনের নামে শহীদ আলতাফ হোসেন মেমোরিয়াল স্কুল, টাঙ্গাইলের ভুঞাপুর কলেজ, চৌমুহনী কলেজ, মির্জাপুরের এস কে পাইলট স্কুল, টাঙ্গাইলের মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ ও মির্জাপুরের ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। যশোরে মাইকেল মধুসূদন কলেজ তাঁরই অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি অর্থায়ন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের বর্বর হানাদার বাহিনী ও তাদের এ-দেশি দোসররা ১৯৭১ সালের ৭ মে কুমুদিনীর প্রধান কার্যালয় খানপুর থেকে রণদা প্রসাদ সাহা ও তাঁর একমাত্র কর্মক্ষম পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরপর আর তাঁদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। এখানে উল্লেখ্য, এ হত্যাকান্ডের বিচার হয়েছে এবং বিচারে হত্যাকারীর ফাঁসি হয়েছে। তাই তাঁর স্মৃতিবিজড়িত নারায়ণগঞ্জে রণদা প্রসাদ সাহার সুযোগ্য পৌত্র রাজীব প্রসাদ সাহা ২০১৩ সালে ‘রণদা প্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন।

 

লেখক : উপাচার্য, রণদা প্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয়

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর