শনিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

ত্রিশালে গ্লাস হাউসে বাণিজ্যিক কৃষি

শাইখ সিরাজ

ত্রিশালে গ্লাস হাউসে বাণিজ্যিক কৃষি

গ্লাস হাউস এগ্রিকালচার, কাচের ঘরে কৃষি অর্থাৎ গ্রিন হাউসে চাষ-আবাদ। শীতপ্রধান দেশে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় ফসল ফলাতে গ্রিন হাউসে চাষ হয়, এ সম্পর্কে আমরা কমবেশি জানি। ইতিহাস বলে গ্রিন হাউস কৃষির সূচনা সেই প্রথম শতাব্দীর গোড়ার দিকে। রোমান সম্রাট তাইবেরিয়াসের অভ্যাস ছিল প্রতিদিনের খাবারে সতেজ শসা খাওয়ার। কিন্তু সমস্যা হতো শীতকালে। বরফজমা রাজ্যে টাটকা শসা কোথায় পাওয়া যাবে!  তাই রাজার জন্য শীতকালেও শসা উৎপাদনের জন্য নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় কৃষিব্যবস্থার চেষ্টা থেকে আবিষ্কৃত হয় গ্রিন হাউসের কৃষি। চৌদ্দ শতকে কোরিয়ায় নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা ও পরিবেশে ঔষধি গাছ চাষের ইতিহাস আছে। সতের শতকে এসে ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসে শীতের মৌসুমেও সতেজ ফসল পেতে অনেকেই শুরু করেন গ্রিন হাউসে চাষ। কালের পরিক্রমায় বিংশ শতাব্দীতে এসে গ্রিন হাউস কৃষি ছড়িয়ে পড়ে উন্নত দেশগুলোতে। প্রযুক্তির উৎকর্ষ এবং নিজের খাদ্য নিজেই উৎপাদনের তাগিদ থেকে শুধু শীতপ্রধান দেশেই নয়, গ্রিন হাউস কৃষির সূচনা হয় মরুভূমির দেশেও। তবে গ্রিন হাউস কৃষিতে বিখ্যাত হয়ে ওঠে নেদারল্যান্ডস। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে তারা এ কৃষিকে নিয়ে গেছে অন্য মাত্রায়। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার তথ্যমতে, পৃথিবীজুড়ে ৯০ লাখ একর জমিতে গ্রিন হাউসে চলছে কৃষিকাজ। আর এখন গ্রিন হাউসের কৃষি মানেই নিরাপদ কৃষি।

হৃদয়ে মাটি ও মানুষের সূচনা থেকেই আমি তুলে ধরতে চেয়েছি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনা। এর ধারাবাহিকতায় চীনের কুনমিংয়ে এবং জাপানে গ্রিন হাউসে চাষ-আবাদের চিত্র আমি তুলে ধরেছি। মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে কীভাবে গ্রিন হাউসে ফসল ফলছে বাংলাদেশিদের হাতে, সে দৃশ্যও দেখিয়েছি। নেদারল্যান্ডসে গ্রিন হাউসের ফুল চাষের চিত্র দেখে বাংলাদেশের যশোরে গদখালীর কৃষক শের আলী বাঁশ আর পলিথিনে তৈরি করে নিয়েছিলেন নিজস্ব পলিনেট হাউস।

তুলে ধরেছি পর্তুগালের ফাজান্দে নোভায় হুবেল কোম্পানির বাণিজ্যিক কৃষি খামারের চিত্র। মোট ৪৯ একর জমিতে তাদের রাসবেরির চাষ। চারটি ভিন্ন স্থানে পাঁচটি ফার্মে রাসবেরি আর স্ট্রবেরি চাষ করে তারা। মাটিতে নয়, কোকোপিটে সারি সারি রাসবেরি গাছের চারা। হুবেল মূলত নার্সারি থেকে ছোট চারা সংগ্রহ করে। ফলে বেশ কিছু নার্সারির বড়সড়ো ব্যবসার একটা ক্ষেত্র বলা চলে হুবেলকে। সমুদ্র উপকূলস্থ শহর বলে ওই এলাকার প্রধান সমস্যা ছিল সেচব্যবস্থা। আর তাও তারা সমাধান করেছে ড্রিপওয়াটার ইরিগেশন সিস্টেমে। সারা বিশ্বই গ্রিন হাউসে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের দিকে ঝুঁকেছে। আমি ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর নানা প্রতিবেদনে দেখিয়েছি বিভিন্ন দেশে গ্রিন হাউসে হাইড্রোপনিক কৃষি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার থেকে শুরু করে নেদারল্যান্ডস, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন এমনকি আমাদের দেশেও বাণিজ্যিকভাবে হাইড্রোপনিক কৃষি শুরু হয়েছে। হুবেল কোম্পানির উৎপাদন মূলত রপ্তানির জন্য। শতকরা ৯০ ভাগ ফল তারা রপ্তানি করেন। আর শতকরা ৭০ ভাগ ফলই রপ্তানি হয় শীতকালে। ইংল্যান্ড, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শীতে যখন স্থানীয় ফল মেলে না তখনই তাদের রপ্তানির মৌসুম। রপ্তানিনির্ভর বলেই কমপ্লায়েন্সের নিয়ম তাদের মেনে চলতে হয় শতভাগ। গত এপ্রিলে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল নেদারল্যান্ডসের বারেনড্রেখট এলাকায়। সেখানে বিশাল বিশাল সব গ্লাস হাউস। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় বড় বড় সব কারখানা। সেখানে কোনো গ্লাস হাউসই ৭ হেক্টরের কম নয়। ২০১৪-২০১৫ সালের দিকে নেদারল্যান্ডসে এত বেশি গ্লাস হাউস নির্মাণের হিড়িক পড়ে যে, নেদারল্যান্ডস পরিচিত হয়ে উঠছিল গ্লাস হাউসের দেশ হিসেবে। পরবর্তীতে গ্লাস হাউস নির্মাণে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। সেখানকার গ্লাস হাউসের কোনোটিতে শসা, কোনোটিতে টমেটো, কোনোটিতে ক্যাপসিকাম চাষ হচ্ছে, এমনকি ফুলের চাষও হয় গ্লাস হাউসে। আবার ভেনলো এলাকার অ্যাগ্রো প্রসেসিং পার্কে দেখেছি অন্যরকম কর্মকাণ্ড। আমাদের দেশে যেমন এক্সপোর্ট জোন কিংবা শিল্পনগরী গড়ে উঠেছে। ভেনলোর ‘ফ্রেশ পার্ক’ও ঠিক সেরকম। নেদারল্যান্ডসে মোট ছয়টি অ্যাগ্রো প্রসেসিং পার্ক রয়েছে। আমাদের দেশেও প্যারামাউন্ট গ্রুপ গ্রিন হাউসে তরমুজ, রকমেলন ও শসার চাষ শুরু করে। প্যারাগন শুরু করে ফুলের চাষ। সাম্প্রতিক সময়ে গ্রিন হাউসে নিয়ন্ত্রিত কৃষির উদ্যোগ দেখেছি দেশের বিভিন্ন জায়গায়। সেসব চিত্রও তুলে ধরেছি হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে।

দেশে প্রথমবারের মতো ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের সেনবাড়িতে তিনটি বিশাল গ্লাস হাউসে গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির কৃষি ব্যবস্থাপনা। সপ্তাহখানেক আগে সেই কৃষি ব্যবস্থাপনা ঘুরে দেখার সুযোগ হয়। উদ্যোক্তা এম রশিদুজ্জামান মিল্লাত অভ্যর্থনা জানান। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। বাংলাদেশের মাটিতে এমন গ্লাস হাউস দেখে মনে হলো কৃষির এ বিবর্তনের স্বপ্নই আমি দেখে এসেছি বহুদিন ধরে। মিল্লাত বলছিলেন, হৃদয়ে মাটি ও মানুষ দেখেই তিনি উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এ কৃষি প্রকল্প গড়ে তোলার। প্রতিটি গ্লাস হাউসের আয়তন ২২ হাজার স্কয়ার ফুট। মোট ৬৬ হাজার স্কয়ার ফুট এলাকাজুড়ে তিনটি গ্লাস হাউসে চাষ হচ্ছে চেরি টমেটো, ক্যাপসিকাম, শসা ও রক মেলনের। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে চাষাবাদের প্রথম শর্ত হচ্ছে জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। ফলে আমাকেও অনুসরণ করতে হয় জৈব নিরাপত্তার সব শর্ত। গ্লাস হাউসের ভিতরে ঢুকে মনে হলো আমি বোধহয় নেদারল্যান্ডসের কোনো গ্লাস হাউসে প্রবেশ করেছি। স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় চলছে ঊর্ধ্বমুখী যান্ত্রিক কৃষি। সারি সারি স্টিলের ট্রেতে ককপিটে বীজ বপন করে চারা তৈরি করা হচ্ছে। ড্রিপওয়াটার সেচের মাধ্যমে পানি ও পুষ্টিকণা দেওয়া হচ্ছে গাছের চারাগুলোকে। গাছে সেচ ও পুষ্টি প্রদানের খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা করলেন একজন বিশেষজ্ঞ কর্মী।

বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকটের এ সময়ে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানিমুখী কৃষি বাণিজ্যের স্বপ্ন দেখছেন রশিদুজ্জামান মিল্লাত। আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে গড়ে তুলেছেন এ আধুনিক কৃষি খামার। এ ধরনের স্থাপনা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। সব মিলে ৬ কোটি টাকার বিনিয়োগ। লাভ-লোকসানের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করেই বিনিয়োগ করা হয়েছে। লাভের ব্যাপারে যথেষ্ট আশাবাদী তিনি। বললেন, শতভাগ রপ্তানির লক্ষ্য নিয়েই তিনি শুরু করেছিলেন। তবে যারা উচ্চমূল্যের ফল-ফসল আমদানি করেন তারা চাচ্ছেন এখান থেকে কিনতে। আমদানি করতে যেখানে কেজিপ্রতি ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা খরচ হয়, সেখানে ৭০০ টাকা করে ফসল বাগান থেকেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। আগেই বলেছি স্মার্ট কৃষি মানেই নিশ্চিত অঙ্কের কৃষি। প্রতিটি গাছ থেকে কী পরিমাণ উৎপাদন হবে আর উৎপাদন প্রতি খরচের বিষয়টিও হিসাব করে ফেলা যায়। এখানকার যন্ত্রের স্থাপনা ও উৎপাদন ব্যবস্থাপনার পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন চীনের উদ্যানতত্ত্ববিদ চাও। তার সঙ্গে কথা বলে উৎপাদনের অংকটা বিস্তারিত বোঝার চেষ্টা করলাম। চাও বললেন, ‘২২০০ স্কয়ার ফুটের গ্লাস হাউসের এক পাশে ক্যাপসিকামের সারি আছে ১৪টি। প্রতিটি সারিতে গাছ আছে ১৭৭টি করে। মোট ২ হাজার ৪৭৮টি গাছ। প্রতিটি গাছ ফলন দেবে ছয় মাস। প্রথমবার ফলন কম আসবে। ৪ থেকে ৫ কেজি। পরবর্তী ফলনে ৬ থেকে ৭ কেজি করে পাওয়া যাবে। টমেটো গাছের সংখ্যাও ক্যাপসিকামের মতোই। তবে টমেটো ফলন দেবে প্রায় ৮ মাস। মানুষ এখন সালাদ-জাতীয় খাবার খুব পছন্দ করে। ফলে এসব সবজির চাহিদা বাড়ছে। আর গ্লাস হাউসে চাষ করা এ ফল-ফসল বেশ নিরাপদ। বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ বেশ সম্ভাবনাময় বলে মনে করি আমি।’

এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্লাস হাউস ঘুরে দেখলাম। মনে হলো রশিদুজ্জামান মিল্লাতের এ উদ্যোগ বাংলাদেশে নতুন কৃষি ব্যবস্থাপনার সূচনাকারী। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে শিল্পোদ্যোক্তাদের হাতে সম্প্রসারিত হচ্ছে স্মার্ট কৃষি। এতে বাণিজ্যিক ও রপ্তানিমুখী কৃষিপণ্য উৎপাদনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অধিক উৎপাদন আর নিরাপদ খাদ্য এ দুই বিপরীতধর্মী তাগিদকে একই রেখায় আনতে পারে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের এ প্রযুক্তির কৃষি ব্যবস্থাপনা। টেকসই কৃষি অর্থনীতি বিনির্মাণে রশিদুজ্জামান মিল্লাতের মতো উদ্যোক্তাদের নেওয়া এসব উদ্যোগ রাখবে যুগান্তকারী ভূমিকা। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকেও এগিয়ে আসা উচিত। সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্র তৈরি করার এখনই সময়। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সূচনাতে জাতি হিসেবে আমরা পিছিয়ে থাকলেও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এ সময়ে উৎপাদনের প্রতিটি খাতে বিশেষ করে কৃষিতে প্রযুক্তির প্রসারে এগিয়ে থাকার সক্ষমতা আমাদের আছে। বর্তমান সময়ে কৃষিপণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে চাইলে কৃষিতে প্রযুক্তি ব্যবহারের বিকল্প নেই।  আমি স্বপ্ন দেখি, বাংলাদেশের আগামীর কৃষি রচিত হবে সুপরিকল্পিত এবং আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষে অনন্য হয়ে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর