শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ২৫ বছর

সৌরেন চক্রবর্ত্তী

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ২৫ বছর

আজ ২ ডিসেম্বর, পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদনের ২৫তম বার্ষিকী। ১৯৯৭ সালের এ দিনেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক জাতীয় কমিটির সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির এ ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদিত হয়। এ দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিশেষ দিন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের এক-দশমাংশ আয়তনজুড়ে তিনটি পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। এখানে উপজাতি জনগোষ্ঠী নিজ নিজ ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির স্বকীয়তা বজায় রেখে দীর্ঘদিন ধরে বাঙালি জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি বসবাস করে আসছে। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর পার্বত্য অঞ্চল দীর্ঘদিন স্বাধীনতা-পূর্বকালে যথেষ্ট পশ্চাৎপদ ও অনুন্নত অবস্থায় ছিল। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বিভিন্ন বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে উন্নয়নের গতিধারায় যুক্ত হচ্ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্রীদের হাতে বঙ্গবন্ধু স্বজনদের সঙ্গে নিহত হওয়ার পর ওই অঞ্চলের বহুমুখী উন্নয়ন পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়। উন্নয়নের এ অচলাবস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের কারণে প্রায় দুই যুগব্যাপী স্থায়ী হয়।

১৯৯৬ সালে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। বঙ্গবন্ধুকন্যা সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করে পার্বত্য অঞ্চলের শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং সেখানকার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে এগিয়ে আসেন। ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে জাতীয় সংসদে সরকারদলীয় চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এমপির নেতৃত্বে ১১ সদস্যবিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক জাতীয় কমিটি গঠিত হয়। একই বছর ডিসেম্বরে খাগড়াছড়ির সার্কিট হাউসে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও সরকারের সঙ্গে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা অক্ষুণ্ন রেখে সংবিধানের আওতায় এককেন্দ্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই উপজাতীয় জনগণের ন্যায়সংগত দাবি পূরণের সম্ভাব্য সর্বোত্তম সমাধান খুঁজতে উভয় পক্ষ ঐকমত্যে পৌঁছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বের গুণে ও প্রচেষ্টায় জাতীয় কমিটি ও জেএসএসের মধ্যে অনুষ্ঠিত সপ্তম বৈঠকে চূড়ান্ত সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মন্ত্রিসভার সদস্য, ঊর্ধ্বতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও বিদেশি কূটনীতিকদের উপস্থিতিতে সরকারের পক্ষে জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং জনসংহতি সমিতির পক্ষে জেএসএস সভাপতি ও শান্তিবাহিনীর প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করেন। যেটাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বলা হয়। তৃতীয় কোনো দেশ বা পক্ষের মধ্যস্থতা ছাড়াই দীর্ঘ বিরাজমান সশস্ত্র বিদ্রোহের অবসান ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান অর্জিত হয়। এটা একমাত্র সম্ভব হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিচক্ষণ নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ফলে। এ ঐতিহাসিক মুহূর্তে উপস্থিত থেকে তা দেখার বিরল সৌভাগ্য আমার হয়েছে।

১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে শান্তিবাহিনীর প্রথম দলটি সন্তু লারমার নেতৃত্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে। পর্যায়ক্রমে চার ধাপে অস্ত্র সমর্পণ প্রোগ্রাম হয়। সর্বশেষ দুদকছড়িতে শান্তিবাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করে। যে অনুষ্ঠানে আমার উপস্থিত থাকার স্মৃতি আজও মনে পড়ে। চুক্তির শর্তানুযায়ী ১৯৯৮ সালের ৬ মে স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন সংশোধন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন মহান জাতীয় সংসদে পাস হয়। এবং ১৯৯৮ সালের ১৫ জুলাই এক গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। কল্পরঞ্জন চাকমাকে মন্ত্রী নিয়োগ করা হয় এবং জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমাকে (সন্তু লারমা) আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান (প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা) নিয়োগ করা হয়। পরবর্তীতে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে তিনজন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোকে পার্বত্য এলাকার উন্নয়নের গুরুদায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। এতে পার্বত্য এলাকার সার্বিক উন্নয়ন, বহুমুখী কল্যাণ ও সুষম উন্নয়নের যাবতীয় কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৯ সালের মার্চে সরকার আমাকে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক পদে পদায়ন করে। তিন বছরের অধিক কর্মকালে বাস্তবে এ অঞ্চলের সব নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন কত ত্বরান্বিত হয়েছে তা দেখেছি। সেখানকার লোকজ ও ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির পাশাপাশি মূলধারার সাংস্কৃতিক চর্চা সমানভাবে প্রবহমান। মহাসমারোহে বৈসাবি উৎসবের পাশাপাশি পালিত হয় বাংলা নববর্ষ। একইভাবে মহা আনন্দে উদযাপিত হয় ঈদ উৎসব ও দুর্গাপূজা। সংস্কৃতির বিবর্তনের এসব নবরূপ পরিস্থিতি আমাদের পার্বত্য সংস্কৃতিকে বিকশিত করছে বিভিন্নভাবে। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য- কি চমৎকার। পার্বত্য শান্তিচুক্তি এবং এর বাস্তবায়ন বিষয়ে পার্বত্যবাসীর কারও কারও মধ্যে কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও এ কথা অনস্বীকার্য যে, পার্বত্য চুক্তির ফলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধিকার এবং জাতিসত্তাগত স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ন রাখার পাশাপাশি জাতীয় মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে এ অঞ্চলে বসবাসরত পাহাড়ি ও বাঙালি নির্বিশেষে সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে সমৃদ্ধ জনপদ গড়ার সম্ভাবনা দিনে দিনে বিকশিত হচ্ছে; যা বাস্তবে সবাই দেখতে পাচ্ছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগ, বিচক্ষণ নেতৃত্ব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা, তাঁর সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা, সফল সংলাপ এবং শান্তি স্থাপনে উভয় পক্ষের সদিচ্ছার ফলেই সুদীর্ঘ সময়ব্যাপী চলমান এ জটিল সমস্যা সমাধানকল্পে এ ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন সম্ভব হয়েছে। দেশে-বিদেশে রাষ্ট্রনায়ক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের এ উদ্যোগ ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। পার্বত্য শান্তিচুক্তির মাধ্যমে কোনো তৃতীয় পক্ষের ভূমিকা ছাড়াই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান এবং শান্তি স্থাপনের স্বীকৃতিস্বরূপ শান্তির দূত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মর্যাদাপূর্ণ বহু সম্মাননা লাভ করেন।

লেখক : সাবেক সিনিয়র সচিব

[email protected]

সর্বশেষ খবর