বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

মানবাধিকার নিয়ে সুশীলদের বড় পরাজয়

ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী

মানবাধিকার নিয়ে সুশীলদের বড় পরাজয়

১০ ডিসেম্বর পালিত হলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। কোনো কোনো মহল বিশেষ করে বাংলাদেশের সুশীল সমাজের একটি অংশ এ দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। নানা কানাঘুষা ছিল এবারও মানবাধিকার দিবসে বাংলাদেশের কারও কারও ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়ন কেউই বাংলাদেশের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। এটা সুশীলদের এক বড় পরাজয়। মানবাধিকার দিবসের আগেই ঢাকায় ১৫টি দেশের দূতাবাস এক যৌথ বিবৃতি দেয়। গত ৭ ডিসেম্বর অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়ার গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করেছে দূতাবাসগুলো। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, মানবাধিকার বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে। বাংলাদেশে মানবাধিকারের বর্তমান পরিস্থিতি কেমন, বাংলাদেশে মানবাধিকারের চিত্র কেমন হওয়া উচিত এ সম্বন্ধে তারা নিশ্চয়ই অনেক কিছু বলতে পারতেন। সেটার সঙ্গে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার কথা একেবারেই যে আসতে পারে না তা নয়। এটা কোনো নিষিদ্ধ বিষয়বস্তু নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তারা মানবাধিকার বিষয়ে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে হঠাৎ করে নির্বাচনের দিকে এত গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন?

মানবাধিকারের বিষয়ে যেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়টি আলোচনা করে তারপর তারা নির্বাচন বিষয়ে আলোচনা করলে সেটা বেশি গ্রহণযোগ্য হতো। কিন্তু তারা সেটি করলেন না। এর পরবর্তীতে আবার দেখলাম যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে, দুই প্রধান দল ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলের সভা ডেকেছে, সুতরাং সাবধানে চলাচল করতে। আমরা তো এ দেশেই আছি এবং পত্র-পত্রিকাও পড়ি। দুই দল তো শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে সভা-সমিতি ডেকেছে এরকম কোনো জ্ঞান আমাদের নেই। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব মোড়ল। তাই সব দেশের ব্যাপারেই তাদের নাক গলাতে হয়। এটা সবাই স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিয়েছে।

তবে বিশ্ব রাজনীতি পরিবর্তিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুও পরিবর্তিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় নীতি সব দিক থেকে চিন্তা করলে পুরো বিশ্ব একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং ইতিহাসে এটি প্রথম নয়। কিছুদিন আগেই ইউরোপের একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা এতই দুর্বল হয়ে গেছি যে, রাশিয়া কিংবা অন্য কোনো দেশ আক্রমণ করলে আমেরিকার সাহায্য ছাড়া আমরা সেটাকে মোকাবিলা করতে পারব না। এটা তাদের নিজের স্বীকারোক্তি। অথচ এক সময় ছিল যখন ইউরোপ পুরো বিশ্ব শাসন করত। সুতরাং কারও ক্ষমতাই চিরস্থায়ী নয়।

এখন মানবাধিকারের বিষয়ে আসি। আজকে মানবাধিকার বিষয়ে অনেক বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে। অনেক বড় বড় কথা বলা হচ্ছে। আমি আমার পাঠকদের কিছু সময়ের জন্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে নিয়ে যেতে চাই। আমি তখন লন্ডনে অবস্থান করছি। লন্ডনে এফআরসিএসের ফাইনাল প্রিপারেশনের জন্য। তখনই ইতিহাসের জঘন্যতম ঘটনাটি ঘটে। দেশি এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা মিলে সেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। বর্তমানে কূটনীতিকরা যে ভাষায় আমাদের মানবাধিকারের সবক দিয়ে চলেছেন তাতে মনে হচ্ছে ১৫ আগস্টের ঘটনায় তারা শুধু যে খুশি হয়েছে তা নয়, বরং তারা এ প্রক্রিয়ার ভিতরেই ছিল। ঘাতকদের হাত থেকে ১০ বছরের শেখ রাসেলও রেহাই পায়নি। বিশ্বের অনেক নেতাই ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন। কিন্তু ১০ বছরের রাসেলকে কেন হত্যা করা হলো?

আমি বিলেতের প্রতিটি পত্রিকা পর পর অনেক দিন ধরে পড়েছি। এমনকি মণি ভাইয়ের বিপক্ষেও তখন একটি লেখা পড়েছিলাম এক পত্রিকায়। কিন্তু কোনো একটি পত্রিকায় একটি লাইনও লেখা হলো না যে, ১০ বছরের শিশুকে হত্যা করা কতটা জঘন্য অপরাধ। কোনো জায়গায় এটি উল্লেখ করা হলো না। তখন তাদের মানবাধিকার কোথায় ছিল? তখন কিন্তু তারা কোথাও কোনো জায়গায় এ বিষয়ে কিছু বলেনি। এরপর ইনডেমনিটি দিয়ে বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হলো। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে তখন কোনো শব্দ করতে দেখিনি। এখন মনে হচ্ছে যে যারা বিশ্বের মোড়ল তারা একেক সময় একেক পলিসি গ্রহণ করে। কখনো তারা কোনো রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করে, কখনো আবার সবচেয়ে জালেম শাসক তাকে প্রতিপালন করে। আবার মানবাধিকারও তারা তাদের ডেফিনেশন অনুযায়ী যখন যেখানে তাদের স্বার্থ আছে সেখানে প্রয়োগ করে।

যুদ্ধে যে গ্রনেড ব্যবহার করা হয় ২১ আগস্ট সেই গ্রেনেড দিয়ে বিরোধী দলের নেত্রী এবং তাঁর সঙ্গে সহকর্মীদের হত্যা করার জন্য নিখুঁত পরিকল্পনা করা হলো। তখনো মানবাধিকারের কোনো চেঁচামেচি দেশে-বিদেশে কোথাও শোনা গেল না। অথচ পশ্চিমারা এত বড় বড় বক্তব্য দেয়, তাদের তো সেদিন বলা উচিত ছিল যে, এত বড় অন্যায় কেন করা হচ্ছে। তখন মানবাধিকার কোথায় ছিল?

আবার ফিরে আসি কূটনীতিকদের মিশন নিয়ে। কূটনীতিকরা বাংলাদেশে আসলে কী মিশন নিয়ে কাজ করছেন সেটা আমি ঠিক বুঝতে সক্ষম হচ্ছি না। কেননা স্বাভাবিক কূটনীতিকদের যেসব কাজ তারা সেই কাজের বাইরে চলে যাচ্ছেন। তারা  এমন সব কাজ শুরু করেছেন যেগুলো তাদের সত্যিকারেই সীমারেখার মধ্যে পড়ে না। অন্ততপক্ষে এটা প্রায়োরিটির মধ্যে পড়ে না। তারা যে শুধু ওই পাগলা পানি খাবেন সুশীল সমাজের সঙ্গে মিলে এবং তারা যেসব বক্তব্য দেবেন সেটাকেই আপনারা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলবেন সেটা হতে পারে না। এটার ড্রাফটও তারা করে দেন কি না আমি জানি না। তবে আমার মনে হয় অন্ততপক্ষে ড্রাফটের সময় নিশ্চয়ই তারা সাহায্য নেন। কারণ তাদের টাকা দেন, তাদের সাহায্য নেবেন না কেন।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্বের একেক দেশের জন্য একেক রকমের স্টেটমেন্ট আসছে। আমি  মোটামুটি সব গুরুত্বপূর্ণ স্টেটমেন্টগুলো পড়ে দেখেছি। এগুলোর মধ্যে একদম আকাশ-পাতাল পার্থক্য আছে। সেখানে মানবাধিকার পরিস্থিতির সঙ্গে যে বিবৃতি আসছে তার মিল নেই। দেখবেন যাদের ক্ষমতা আছে তাদের মামলা এমনি মীমাংসা হয়ে যায়। তারা যত বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন করুক না কেন। আর যারা গরিব এদের পলিসি হচ্ছে ওই আমাদের গ্রামের কথায় যেটা দার্শনিক শেখ হাসিনা কিছুদিন আগেও তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, গরিবের সুন্দরী বউ সবার ভাবি। আমার মনে হয় সেই পলিসিই তারা অনুসরণ করছেন। তারা আমাদের ভাবছেন যে, আমরা গরিবের সুন্দরী বউ। বাংলাদেশ যেহেতু দার্শনিক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে এবং তিনি টানা তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন আবারও তাঁর দলই বিজয়ের দিকে যাচ্ছে সেটা দেখেই তাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। পাগলা পানি খেলে সবার তো এক রকম মাথা খারাপ হয় না।

কূটনীতিকরা আমাদের বন্ধু। আমরা এখনো মনে করি যেটা আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন। যেটা এখন জাতিসংঘ গ্রহণ করেছে। সেটা হলো- সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। যেটা দার্শনিক শেখ হাসিনা সবসময় বলে থাকেন। আমরা তো সেটাই চাই। আপনারা কেন পায়ের ওপর পা দিয়ে ঝগড়া বাধাতে চান। তারা কি মনে করেছেন, আপনারা আমাদের ধ্বংস করে দিয়ে আপনারা আরও ওপরে যাবেন। বাংলাদেশ এখন একটা নিজস্ব ক্ষমতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। ইচ্ছা করলেই যে কেউ আমাদের তাদের করতে পারে না। আমি মনে করি, মানবাধিকারের নামে এ কূটনীতিবিদরা যারা এ সুশীল সমাজকে হাতের পুতুল বানিয়ে রেখেছেন অথবা টাকা-পয়সা দিয়ে সুশীল সমাজকে এক ধরনের খেলায় নামিয়েছেন তাদের বলব, বাংলাদেশে যতদিন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা জীবিত আছেন ততদিন এ বাংলার মানুষকে আপনারা বোকা বানাতে পারবেন না।

দার্শনিক শেখ হাসিনার প্রতিটি কাজে একটি দর্শন আছে এবং দার্শনিক হলে তাদের কাজের একটা রোডম্যাপ থাকে। তাঁর এত বছরের রাজনৈতিক জীবনে তিনি কম আঘাত ও ষড়যন্ত্রের শিকার হননি। দার্শনিক শেখ হাসিনা ঠিকই জানেন কাকে কখন কী পদক্ষেপ নিতে হবে, কাকে কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে। আর এখন মানবাধিকার নিয়ে যারা ষড়যন্ত্র করছে আমার ধারণা দার্শনিক ঠিকই জানেন তারা কী বলবে এবং তারা কী চায়। সেই অভিজ্ঞতা দার্শনিকের আছে। কারণ মনে রাখবেন যে, বিশ্বে বর্তমানে দার্শনিক শেখ হাসিনার সমকক্ষ কোনো রাষ্ট্রপ্রধান নেই। সমস্ত বিশ্বে নির্বাচনের মাধ্যমে একমাত্র দীর্ঘদিন দেশ পরিচালনা করেছেন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা।

পরিশেষে আমি বলব, দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা সঠিক পথেই আছেন। বাংলার ৮০ ভাগ জনগণ তাঁর সঙ্গেই আছে এবং সঠিক নির্বাচনই হবে এবং সঠিক নির্বাচনে যার ভোট সে দেবে, নির্বাচন কমিশন যেভাবে চায় সেভাবেই নির্বাচন হবে এবং এ নির্বাচনে আবার দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার দলই বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে। আর যারা ক্ষমতায় আসতে চান তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুন। এবার নির্বাচনে না পারলেও হতাশ হবেন না। আপনারা সঠিক পথে চললে এর পরবর্তীতে কোনো নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে পারবেন। আশা করি সেই সুযোগটা আপনারা নষ্ট করবেন না।

লেখক : সাবেক উপদেষ্টা, চেয়ারম্যান, বিএমআরসি

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর