আয়ুর্বেদীয় ওষুধ কোম্পানি সাধনা ঔষধালয়ের নাম বোধহয় অনেকেই শুনে থাকবেন। এই কোম্পানির একটি বোতলজাত সিরাপের নাম সারিবাদি সালসা। গত শতকের ষাট দশকের শেষের দিকে আমরা যখন মাধ্যমিকে পড়তাম তখন দেখেছি এই সারিবাদি সালসার নাম দেশব্যাপী গ্রামগঞ্জে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সময়ে আজকের মতো ফেসবুক, ইন্টারনেট ছিল না। ছাপানো দৈনিক খবরের কাগজ মফস্বলের বাজারে পাওয়া যেত এক দিন, আবার কখনো কখনো দুই দিন পর। লিখতে-পড়তে জানা মানুষের শতকরা হার দেশব্যাপী ছিল ১৮ ভাগ, গ্রামগঞ্জে ১০ ভাগের বেশি নয়। তারপরও কোম্পানির বিক্রয় শাখার শক্তিশালী নেটওয়ার্ক এবং তাদের প্রচারিত কথামালার কারণে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রায় মানুষই সারিবাদি সালসার নাম জানত। গ্রামের হাট-বাজারে মাইক লাগিয়ে তাদের বিক্রয় প্রতিনিধিরা প্রচার চালাতেন এই মর্মে যে, এক বোতল সারিবাদি সালসা পান করলে শরীরের সমস্ত রোগব্যাধি সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যাবে, সব রোগের মহৌষধ সারিবাদি সালসা, ৮০ বছরের বৃদ্ধ ২৫ বছরের যুবকে পরিণত হবেন। সারিবাদি সালসার আসল গুণাগুণ সম্পর্কে আমার প্রত্যক্ষ কোনো ধারণা নেই। তবে সারিবাদি সালসার তেলেসমাতি যদি এমনই চমকপ্রদ হতো তাহলে দেশে এত হাজার হাজার হাসপাতাল ও ডাক্তার থাকতেন না, প্রয়োজন হতো না। চলমান সময়ে প্রচারের এত সহজ মাধ্যম থাকার পরও সারিবাদি সালসার নাম এখন আর তেমন শুনি না। সম্প্রতি বিএনপি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে, তাদের ভাষায় মেরামতের জন্য যে ২৭ দফা প্রেসক্রিপশন দিয়েছে সেটি দেখে বহুদিন পর সেই স্কুলজীবনের স্মৃতিময় সারিবাদি সালসা কাহিনির কথা আজ আবার নতুন করে মনে পড়েছে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের গায়ে অনেক ক্ষত আছে এবং অসুখ-বিসুখও কম নয়। এর জন্য কোনো রাজনৈতিক পক্ষই দায় এড়াতে পারে না। কিন্তু নির্মোহ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, পঁচাত্তরের পর পর্যায়ক্রমে আবির্ভূত হওয়া দুই সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদই মূলত এবং প্রধানত এর জন্য দায়ী। এই লেখায় জিয়া-এরশাদের কর্মকাহিনিতে যাচ্ছি না। বিএনপির কথিত রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা প্রেসক্রিপশন অত্যন্ত আগ্রহভরে পড়েছি। ভেবেছি বিএনপির যদি শুভবুদ্ধির উদয় হয়ে থাকে তাতে মন্দ কী, রাষ্ট্রের জন্য যদি এমন এক সারিবাদি সালসা পাওয়া যায় তাহলে সেটা তো খুব ভালো হয়। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে পড়ার পর একদম হতাশ হয়েছি। এর মাধ্যমে স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। একই সঙ্গে গতানুগতিক ও স্ববিরোধী বক্তব্য পরিপূর্ণ। সস্তা বুলি, মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা, একেবারে ধোঁকাবাজি যাকে বলে। রাজনীতিতে ধোঁকাবাজি চিরকাল ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও হয়তো থাকবে। কিন্তু বিএনপির মতো একটি দল, যাদের সঙ্গে অনেক বুদ্ধিজীবী ও মেধাসম্পন্ন লোক রয়েছেন, সেই দল এমন একটা অসার দলিল মানুষের সামনে উপস্থাপন করে এমনভাবে ধরা খাবে, তা অন্তত আমার ধারণার বাইরে ছিল। তবে যা হয় আর কী। রাজনীতির লক্ষ্য যদি জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং নিজস্ব সংস্কৃতি বিবর্জিত হয় এবং দেশ ও মানুষের কল্যাণের জন্য না হয়ে কেবলই ক্ষমতার ভোগবিলাসের উদগ্র কামনা আর প্রতিহিংসাপরায়ণ হয় তাহলে এক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে। ২৭ দফা একে একে আলাদাভাবে এবং দফাগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক বিশদভাবে বিশ্লেষণ করলে সব দফাকে চারটি শ্রেণিতে ফেলা যাবে। প্রথমত, প্রতিহিংসাপরায়ণ ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী, দ্বিতীয়ত, গতানুগতিক, তৃতীয়ত, স্ববিরোধী এবং চতুর্থত অনেকগুলো দফাই অস্পষ্ট। প্রথম দফাটি যদি কেউ নির্মোহভাবে বিটুইন দ্য লাইন পড়েন তাহলে বুঝবেন এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, দর্শন, গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন যতটুকু যা, বর্তমান সংবিধানে আছে তার কিছুই আর থাকবে না। কারণ, একটি কথাই যথেষ্ট, আর তা হলো, বলা হয়েছে সবকিছু হবে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। আজব ও শেকড়হীন এই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবর্তক ছিলেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। প্রথম দফায় বলা হয়েছে, সংবিধান থেকে বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক ধারা বাদ দেওয়া হবে। তাদের রাজনৈতিক সততার বহিঃপ্রকাশ ঘটত যদি বলত বর্তমান সংবিধানের কোনো কোনো অনুচ্ছেদ বা উপ-অনুচ্ছেদ দল হিসেবে বিএনপির কাছে বিতর্কিত এবং অগণতান্ত্রিক মনে হয়। এতটুকু সততা তারা দেখাননি। তাই যেহেতু জিয়াউর রহমান এখনো বিএনপির আদর্শ এবং তার সবকিছুকে তারা বেদবাক্য মনে করেন, তাতে ধরেই নেওয়া যায় জিয়াউর রহমান সামরিক আদেশ দ্বারা বাহাত্তরের সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সংবলিত সবকিছু যেমন বাতিল করে দিয়েছিলেন, বিএনপি এখন আবার অন্যভাবে সেটাই করতে চায়। তাতে সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘মুক্তি’ ও ‘সংগ্রাম’ শব্দ দুটিসহ রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাতিল হবে। রাজনীতিতে ধর্মীয় উগ্রতা ঠেকাতে ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদে এখন যতটুকু যা আছে সেটাও বাদ হয়ে যাবে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সংবিধানের অংশ হিসেবে থাকবে না। বিএনপি হয়তো ধরেই নিয়েছে যখন তারা এটা করবে তখন আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী দলসমূহের কোনো অস্তিত্ব ও প্রভাব বাংলাদেশে থাকবে না। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী বুদ্ধিজীবী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের অস্তিত্ব থাকবে না। এগুলো অত্যন্ত বিপজ্জনক ধারণা।
পঁচাত্তরের পর জিয়াউর রহমান কর্তৃক তড়িঘড়ি করে সামরিক আদেশ দ্বারা বাহাত্তরের সংবিধানকে সংশোধনের মধ্য দিয়ে একাত্তরে এদেশীয় পরাজিত গোষ্ঠী এবং পাকিস্তানের প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কিন্তু সে সময় আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। বৃহত্তর মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এটা মেনে নেবে না। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে বিএনপি কি দেশকে একটা গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। এবার ২৭ দফায় দ্বিতীয় ও ১৩ নম্বর দফা দুটিকে পাশাপাশি রাখলে দেখা যাবে এ দুটি দফার মধ্য দিয়ে স্ববিরোধিতা ও প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। দ্বিতীয় দফায় বলা হয়েছে, প্রতিহিংসার রাজনীতি তারা করবে না, আর ১৩ নম্বর দফায় বলা হয়েছে গত ১৫ বছর দেশে যত দুর্নীতি হয়েছে তার জন্য শ্বেতপত্র প্রকাশ ও বিচার করা হবে। তার মানে ১৫ বছর আগে বাংলাদেশে কোনো দুর্নীতি ছিল না এবং তার পরের দুর্নীতির বিচার করা হবে। বিচার কে করবে বিএনপি নাকি আদালত। যদি আদালত করেন, তাহলে প্রশ্ন আসে দেশের সর্বোচ্চ আদালত তো বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে দুর্নীতির দায়ে শাস্তি দিয়েছেন, তার কী হবে। এবার প্রেসক্রিপশনের ১৯ দফার কথায় একটু আসি। বলা হয়েছে, বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হবে। এটা একদম গতানুগতিক কথা। কেউ অথবা কোনো রাজনৈতিক দল এর বিপরীত কিছু কখনো বলেনি, সবাই একই কথা বলে। তাহলে প্রশ্ন উঠে নতুন করে এ কথা বিএনপিকে বলতে হলো কেন? বিগত সময়ে দেখা গেছে, বিএনপি সরকার যেটাকে দেশের স্বার্থ মনে করেছে, অন্যান্য বড় রাজনৈতিক দল ও দেশের বৃহত্তর মানুষ সেটিকে দেশের স্বার্থ মনে করেনি, বরং উল্টোটি মনে করেছে। ছোট দুটি উদাহরণ দিই। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগের প্রথমবার সরকারের শেষ প্রান্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, দেশের চাহিদা সম্পূর্ণ পূরণ না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে কোনো গ্যাস প্রতিবেশী বা অন্য কোনো দেশে রপ্তানি করা হবে না। বাংলাদেশে গ্যাসের চাহিদা এবং অপ্রতুলতার কথা বিবেচনা করেই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু ২০০১-২০০৬ মেয়াদে ক্ষমতায় এসে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকের পর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তখন বিএনপির অর্থমন্ত্রী প্রয়াত সাইফুর রহমান বলেছিলেন, মাটির নিচে গ্যাস রেখে কী হবে, বরং সেটি রপ্তানি করলে টাকা পাওয়া যাবে। যে কেউ চাইলে ওই সময়ের সংবাদপত্র ও টিভি নিউজের খবরগুলো একবার দেখে নিতে পারেন। ১৯ দফায় আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ভূ-খন্ডের মধ্যে কোনো প্রকার সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাশত করা হবে না এবং সন্ত্রাস জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে কে সন্ত্রাসী আর কে নয়, বা কে স্বাধীনতাকামী তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। ১৯ দফার শেষাংশ পড়লেই বোঝা যায় বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সব ধরনের জঙ্গি সন্ত্রাস দমনে যেভাবে বিশ্ব অঙ্গনে সাফল্যের উদাহরণ সৃষ্টি করেছে তা নিয়ে বিএনপির ভিন্নমত ও অবস্থান রয়েছে।
বিগত সময়ে সরকারে থাকতে এ বিষয়ে বিএনপির নীতি ও অবস্থান কী, তার স্বরূপটা কিন্তু সবাই দেখেছেন। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপির সিনিয়র নেতারা জাতীয় সংসদে বক্তব্য প্রদানের সময় স্পষ্ট করে বলেছেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে যুদ্ধরত সশস্ত্র বিদ্রোহীরা স্বাধীনতাকামী তাই বাংলাদেশের উচিত ওই স্বাধীনতাকামীদের সর্বোতভাবে সমর্থন করা। তখন বিএনপি সরকার তাদের এই নীতি অনুসারে কাজ করেছে, যে কথা বার্টিল লিন্টনার ‘গ্রেট গেম ইস্ট’ গ্রন্থের পঞ্চম অধ্যায়ে বইয়ের ১৪৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন। বিএনপির এই নীতির যতটুকু যা সুবিধা তার সবটুকু পেয়েছে পাকিস্তান। ২০০৪ সালে ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান ধরা পড়ার পর দেশি-বিদেশি মিডিয়ার খবর ও মন্তব্য এবং এ বিষয়ে আদালতের রায় পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, গোপন প্রজেক্টের অংশ হিসেবে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই উল্লিখিত ভারতীয় সশস্ত্র বিদ্রোহীদের অস্ত্র-অর্থসহ সব রকম সমর্থন দিয়েছে, আর বিএনপি সরকার তার জন্য বাংলাদেশের ভূমি উন্মুক্ত করে দিয়েছে। অর্থাৎ এই কর্মের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের স্বার্থ হাসিল হলেও হুমকির মধ্যে পড়েছে বাংলাদেশের নিরাপত্তা। ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান ধরা পড়ার যে মামলা, তার রায়ে দেখা যায় তখন বিএনপি সরকারের মন্ত্রীসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের প্রধানরাও এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সুতরাং ২৭ দফা প্রদান করে রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজির মাধ্যমে বিএনপির বাজিমাত করার চেষ্টা অত্যন্ত কাঁচা হাতে তৈরি হওয়ার কারণে সেটি আঁতুড়ঘরেই মারা পড়েছে। বাংলাদেশের মানুষকে তারা এখনো বোকা মনে করে কি না জানি না। অতীত-বর্তমান সব জেনেশুনে বাংলাদেশের মানুষ সারিবাদি সালসা পান করবে, সে ধারণা বোধহয় ঠিক নয়।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক