মঙ্গলবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

অন্যায়ের সঙ্গে আপস করা ঠিক নয়

মেজর জিল্লুর রহমান (অব.)

অন্যায়ের সঙ্গে আপস করা ঠিক নয়

সমালোচনায় সমঝোতা নিহিত থাকে। ইংরেজিতে বলে, we disagree to agree a perfct decision. গণতান্ত্রিক মানবধিকার, সুশাসন, ন্যায়বিচার, নিরপেক্ষ নির্বাচন- এগুলো নিয়ে বিতর্ক আছে প্রতিবাদ নেই। কালবৈশাখী ঘূর্ণিঝড়ের কালো মেঘের মতো ক্ষণস্থায়ী তথ্য গণমাধ্যমে আসে ব্যাংকে অর্থ নেই, অর্থ পাচার, প্রজেক্টে হরিলুট, ঋণ কেলেঙ্কারি, রিজার্ভ কত আছে নির্ভুল হিসাব নেই, নিজের জমানো ডলার দিতে পারছে না ব্যাংক। গ্রাহককে বলছেন, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করুনই। এসব নিয়ে কলমধারীদের যেমন জোরালো লেখনী দেখা যায় না সরকারও এ অপরাধে জড়িতদের শায়েস্তা করেছে শোনা যায়নি। মাঠের বিরোধী দলগুলো জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি গত ১৪ বছর। ইদানীং নড়েচড়ে উঠেছে মনে হয়। কুম্ভকর্ণের ঘুম থেকে জেগেছে। বিরোধীদলীয় সমাবেশে মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়ছে দিন দিন। রাজধানীর সভাস্থল নিয়ে জটিলতায় পুলিশি অ্যাকশন, সরকারি দলের নানামুখী প্রতিবন্ধকতায় জনসম্পৃক্ততার স্রোতে বিঘ্ন হয়েছে। বড় অর্জন এত বাধার মধ্যেও তারা সভা করেছে। নেতা-কর্মীরা জেল-জুলুম, কারাবরণ করে সমর্থনের পারদ আগের চেয়ে ঊর্ধ্বগামী করতে পেরেছেন। তাদের আন্দোলনের কৌশল নিয়ে গভীরে যেতে হবে দেড় যুগেও কেন সরকার অস্থির হলো না। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। নয়াপল্টন, প্রেস ক্লাব, টক শো, বিবৃতি, সমমনাদের নিয়ে সেমিনার সরকারকে কাবু করার আন্দোলন নয়। অর্থ পাচার, মানি লন্ডারিং যা-ই বলুন কথা উঠলেই রিজার্ভ বিশেষজ্ঞরা প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো টাকা নিয়ে মাতামাতি শুরু করেন। অথচ আমাদের গর্ব রাষ্ট্রের নির্ভেজাল অর্থনৈতিক শক্তি বিদেশে কর্মরত এই শ্রমজীবী মানুষের পাঠানো টাকা ব্যাংকিং খাতের পাশাপাশি একাংশ হুন্ডির হাত ধরে দেশে আসে। রিজার্ভ কম দেখলেই তাদের ওপর দোষ চাপাই মানি লন্ডারিং অভিযোগ থেকে দায় মুক্ত থাকতে। তারা রোজগার করে হাড় ভাঙা খেটে দেশে পাঠানোর সময় ব্যাংক আর হুন্ডির মধ্যে প্রতি ডলারে ১০ টাকা ফারাক হলে রক্ত পানি করা ডলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ব্যাংকে পাঠাবে এমন বোকা দেমপ্রেমিক কোথাও নেই। খোলা বাজার আর ব্যাংকের বিনিময় হার সমান করার পদক্ষেপ নিলে ফল দেবে।

রিজার্ভ লুট, পোস্টঅফিস লুট, ব্যাংক লুটের কীর্তিমানদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক সাজার কোনো ব্যবস্থা নেই। বড় পাচার হয় এলসির মাধ্যমে বড় বণিকদের পাচার করা টাকা দেশে আসে না। প্রবাসীদের টাকা যেভাবে হোক কমবেশি দেশে খাটায়। লুটেরা পাচারকারীরা যথেচ্ছভাবে অর্থ রোজগার করছে, আলাদিনের চেরাগ পেয়েছে হাতে। জনজীবন ওষ্ঠাগত। খাবারের পয়সা পকেটে না থাকার অবস্থাকে যদি ভালো থাকা বলে তবে ভালো আছি বলা যায়।

সংসার চালানো সার্বিক কষ্টের কথা তুলে না ধরে কলমধারীরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। অনাচারের প্রতিবাদে কলম, কণ্ঠ, কার্টুন কি বিলীন হয়ে গেল? ন্যায়নীতি সততার উচিত কথার চর্চায় বড় দুর্দিন। নৈতিকতার বাবা-মা পরকালে পাড়ি দিয়েছে স্বাধীন দেশের রাজনীতির বেসামাল ধাক্কায়। দিন দিন অবস্থা এমন দাঁড়াচ্ছে সততা ও নিরপেক্ষতা বিন্দুমাত্র কারও চরিত্রে থাকলে তাকে অভুক্ত থেকে মরণের পথে যাত্রা শুরু করতে হবে। পাপ অসত্য ক্ষমতার উত্তাপ দাপটের সঙ্গে ন্যায্যতাকে শুধু খেদিয়ে দেয়নি যত দিন যাচ্ছে ততই আক্রমণাত্মক হয়ে চোখ রাঙিয়ে অপদস্থ করে ভীতি প্রদর্শন করেই চলেছে। মালে ভেজাল, ওজনে কম, অযোগ্য অথর্ব দলীয় লোক সরকারি পদে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিচ্ছে। শিক্ষায় নকল, বিনা বিদ্যায় উঁচু সনদ, বিচারালয়ে মুখ দেখে বিচার বিতরণ হচ্ছে। জনসেবার দোহাই দিয়ে অযোগ্য সমাজবিরোধীরা দলীয় কমিটির পদে উৎকোচ নজরানা দিয়ে স্থান খরিদ করে নিচ্ছে। নমিনেশন বাণিজ্য তো জায়েজের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, তা না হলে জাতীয় সংসদের ৬০-৭০ শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ী কী করে হয়?

ব্যাংক লুটেরা তেজ দেখায়। অর্থ ফেরত চাইলে ব্যাংকারের ওপর ছড়ি চালায়। বিচারে জেলহাজত হলে দলীয় ব্র্যান্ডের কেরামতিতে মুহূর্তে বিচারক চালান হয়ে যায়। অধীন বিচারক বসিয়ে আদালতের ঘোষিত আদেশ উলটে দিয়ে জামিন মঞ্জুর করে, বিচারককে ন্যক্কারজনকভাবে ত্বরিত বদলি করা হয়। নিরীহ কৃষক কৃষিঋণে হাজতবাস করছে আইনের প্যাঁচে। এ জুলুম দেখার কি কেউ আছে? যারা বিবেকবান দেশপ্রেমী তারা রোষানলে পড়ার ভয়ে সব অন্যায় দেখে জেগে জেগে ঘুমিয়ে থাকে। টাকা পাচারকারীদের নাম সরকার নিতে শরম পায় আরও খোলাসা করে বললে ভয় পায়। খন্দকার ইব্রাহীম খালেদের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করতে ভয় পান অর্থমন্ত্রী, অসহায়ের মতো সংসদে অপারগতার জানান দিলেন।

সরকারের আশকারা ছাড়া ঋণ কেলেঙ্কারি অর্থ আত্মসাৎ- পাচার হয় না। প্রতিবাদের সৎ মানুষগুলো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সমাজজীবন থেকে নিজেদের কাছিমের মতো শেলের অন্দরে গুটিয়ে নিচ্ছে।

অবৈধ অস্ত্রধারীদের নিয়ে শাসকরা যেমন সমস্যায় থাকে তেমনি সরব কণ্ঠধারী, কলমওয়ালাদের নিয়ে উদ্বেগে থাকে। সমালোচনাকারীদের নিয়ে মন্ত্রীদের বচন আর ঢাকা রাখা যাচ্ছে না। পত্রিকা, রেডিও, টিভি ক্ষমতার জাদু লাঠির তেলেসমাতিতে সরকার বশে রেখেছে। কলমধারীরা দেশের স্বার্থে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ঘুষের বিরুদ্ধে সর্বত্র প্রতিবাদ করে জনমত গড়ে তোলে। দু-এক জন ঝুঁকি নিয়ে লিখলেও পত্রিকা তা ছাপায় না; বিরক্তবোধ করে টেবিলের নিচে আবর্জনার ঝুড়িতে ছুড়ে ফেলে।

অজুহাত দেখায় আপনি যা লিখেছেন আমরা আরও বেশি জানি। কিন্তু মিডিয়া হাউসে শত কোটি টাকা বিনিয়োগ হাজার হাজার লোকের রুটি-রোজগার, চাকরি বাঁচানো ফরজ কাজ। শাসক বেজার হলে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ বিদ্যা লেখকের নেই। এসব যাত্রাগানের বিবেক চরিত্র ছাপালে মালিক সম্পাদককে তলব করে বলবে আপনাকে চাকরি দিয়েছি কি আমার বিনিয়োগ বারোটা বাজাতে? বাড়ি ফেরার পথ দেখিয়ে আদেশ দেবে Quick March. তখন এতগুলো লোকের জীবন-জীবিকা এই দুর্মূল্যের বাজারে ঝুঁকিতে পড়বে। কোনো বিচক্ষণ সম্পাদক এই অপরিপক্ব কাজ করবে না। পরিণতি জেনে কেউ আগুনে হাত দেয় না। জ্ঞানী-অভিজ্ঞ, প্রথিতযশা সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, রাজনীতিক তারাও মুখ বুজে জেগে জেগে ঘুমিয়ে ‘চাচা আপন জান বাঁচা’ নীতিতে শামিল হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। কেউ কেউ মোসাহেবি দালালি তেলবাজিতে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে পদপদবি পাচ্ছে সরকারের অনুকম্পায়। বাকিরা বেশিদিন বোকা থাকতে পারেনি তাদের উত্থান দেখে।

বন্দুকওয়ালা নিয়ে যেমন সমস্যা, তেমন সমস্যা কলমওয়ালাকে নিয়েও হয় শাসকের। মন্ত্রী ও নেতাদের বচনেই উপলব্ধ হয় প্রশংসা শুনতে চায় শুধু, হেরফের হলে সব রাতজাগা সিঁদুর কাটা চোর। আরেক রাজনীতিক সুশীলের ব্যাখ্যা দিয়েছেন সংসদে। তার তরজমা ‘সু’ মানে ভালো, ‘শীল’ মানে নাপিত। মোদ্দা কথা দাঁড়ায়, যারা শাসকের অপছন্দের ধারায় মত দেয় তারা ভালো নাপিত। শাসকদের কণ্ঠ সরব করে বয়ান করতে হবে আয়নাকে বাসি ভালো সে যে আমার আধার ঘরের আলো। আদতে কলমধারীরা অন্যায় কাজ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বত্র প্রতিবাদ করে থাকেন। সচেতন ব্যক্তিরা সমাজের নানা সমস্যা ও দুর্নীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার জন্য কলমকে হাতিয়ার করে থাকেন। যদিও এমন কলমধারীর সংখ্যা ক্রমে পড়তির দিকেই। অযথা হয়রানি বিড়ম্বনা এড়াতে, শান্তিতে দিনযাপন করার তাগিদে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শাসকের অন্যায্য কাজ দেখেও চোখ-মুখ বুজে সহ্য করে আপন স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন বহু কলমজীবী। শাসন কবজায় রাখতে শাসকরা গণতান্ত্রিক দেশেও নাগরিকের কণ্ঠ রোধে সচেষ্ট হয়। শাসকরা তাদের কাজের সমর্থন সব যুগে চেয়ে এসেছে, না দিলে আদায় করে ছলেবলে -কৌশলে। কলমধারীর প্রতিবাদ সভ্যসমাজে আশীর্বাদ, যা দেশকে অনিষ্ট থেকে রক্ষা করে। নিজস্ব শক্তি আছে গতি আছে। তার সঙ্গে লেখকের লেখনী যুক্ত হলে কল্যাণরাষ্ট্র গড়ে উঠবে, সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মঙ্গল ঘটবে।

                লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর