শনিবার, ৭ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

রাহুল গান্ধীতে বিজেপির ভয়

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

রাহুল গান্ধীতে বিজেপির ভয়

কংগ্রেস নেতা তথা ইন্দিরা গান্ধীর পৌত্র সংসদ সদস্য রাহুল গান্ধী যে ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা  করেছেন, সেই যাত্রা নিয়ে দেশে-বিদেশে সর্বত্র আলোচনা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। কন্যাকুমারী থেকে দিল্লি ৩ হাজার কিলোমিটার যাত্রা করেছেন। ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ তিনি যখন দিল্লিতে প্রবেশ করেন, তখন দিল্লি পুলিশ তাঁকে নিরাপত্তা দেয়নি। পদে পদে তাঁকে বাধা দেওয়া হয়েছে। ভিডিও তুলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি লিখে উদ্বেগ প্রকাশ করে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) কে সি বেণুগোপাল লিখেছেন, ‘আমরা আমাদের দুজন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধীকে সন্ত্রাসবাদীদের হাতে হারিয়েছি। কংগ্রেস দাবি করছে, রাহুল গান্ধীর যাত্রায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হোক।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওই চিঠির জবাব না দিয়ে সিআরপিএফকে দিয়ে একটি বিবৃতি প্রচার করেছেন। কংগ্রেস এই বিবৃতি মানতে নারাজ। তারা পাল্টা বিবৃতি দিয়ে বলেছে, সিআরপিএফও অমিত শাহের অধীনে। তারা বলেছে, সিআরপিএফের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০২০ থেকে রাহুল গান্ধী ১০০-এর বেশি জায়গায় নিরাপত্তা প্রটোকল ভেঙেছেন। এ নিয়ে ভারতের মিডিয়ায় তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই। সবাই প্রশ্ন তুলেছেন, রাহুলের নিরাপত্তার কী হবে? দিকে দিকে স্লোগান উঠেছে- রাহুল গান্ধীর নিরাপত্তা চাই।

গত বছর ৭ সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরু হয়। চলবে ৩১ মার্চ পর্যন্ত। এ যাত্রা শুধু নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য নয়। এ যাত্রা ভারতের ঐক্য সংহতি, ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য। হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে বিভাজন- এরই বিরুদ্ধে রাহুল গান্ধীর এই যাত্রা। রাহুল একটি বক্তৃতায় বলেছেন, ‘আমার এই যাত্রাকালে হিন্দু-মুসলমান, হিন্দু-মুসলমান, হিন্দু-মুসলমান শুনিনি। ভারত জোড়ো যাত্রায় সমস্ত জাতপাতের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।’ দিল্লিতে কংগ্রেস সদর দফতর ২৪ আকবর রোডে একটাই কথা শোনা যাচ্ছে। তা হলো, কংগ্রেস রাহুল গান্ধীর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। বড়দিনের ছুটির পর নতুন করে যাত্রা শুরু হয় ৩ জানুয়ারি। বেণুগোপালের চিঠিতে বলা হয়েছে, নিরাপত্তার সর্বোচ্চ পর্যায় নিয়ে যেতে। কারণ ওই সময় রাহুলের যাত্রা সীমান্তের দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য পাঞ্জাব ও জম্মু-কাশ্মীরে পদযাত্রা করবে।

কংগ্রেসের তরফে পাঠানো চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, রাজ্যে রাজ্যে এ যাত্রায় যারাই যোগ দিচ্ছেন, তাদের নানাভাবে হেনস্তা করছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগের অফিসাররা। সংশ্লিষ্ট রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আটকানোর পাশাপাশি যাত্রায় যারাই যোগ দিচ্ছেন, পরে তাদের জেরা করে জেরবার করে দিচ্ছে অমিত শাহের গোয়েন্দা ও কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনী। হরিয়ানায় যাত্রার মধ্যেই কিছু লোক ঢুকিয়ে দিয়ে গোলমাল পাকানোর চেষ্টাও করা হয়েছিল বলে এই চিঠিতে বলা হয়েছে। সে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ওই রাজ্যের সোহনা শহরে একটি এফআইআরও দায়ের করা হয়েছে। বেণুগোপাল বলেছেন, সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকেরই স্বাধীনভাবে যে কোনো জায়গায় চলাফেরা করার অধিকার রয়েছে। দ্বিতীয়ত, ভারত জোড়ো যাত্রা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়। শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ আবার ফিরিয়ে আনার জন্য ‘দেশ জোড়ো’ পদযাত্রায় বেরিয়েছেন রাহুল। দলের মুখপাত্র পবন খেরা অভিযোগ করেছেন, যাত্রার শুরু থেকেই নানাভাবে তা বানচালের চেষ্টা করছে শাসক দলের মদদপুষ্ট দুষ্কৃতিরা। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে অভিযোগ করেছেন, রাহুলের যাত্রাপথে যদি কেউ অপকর্ম করার চেষ্টা করে, শুধু ভারতই জেগে উঠবে না, গোটা বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় উঠবে। ঝড় উঠবে বাংলাদেশেও। কারণ বাংলাদেশের পুরনো আওয়ামী লীগ নেতারা এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও উদ্বিগ্ন হবেন। কারণ শেখ হাসিনা রাহুলকে ছেলেবেলা থেকে দেখেছেন। খাগড়ে আরও বলেছেন, আসুন আমরা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি রাহুলের সুস্বাস্থ্য এবং তাঁর যাত্রা সফল করার জন্য।

সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী কেরলের এ কে অ্যান্টনি এক বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, শুধু সংখ্যালঘুদের ওপর নির্ভর করে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তাই তিনি একটু নরম হিন্দুত্বের লাইন নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। কংগ্রেস কর্মকর্তারা এ লেখা পর্যন্ত তার কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি। ড. মনমোহন সিং মন্ত্রিসভার প্রধান সদস্য পি চিদাম্বরম একই দিনে এক বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ভারত জোড়ো মানে কী? এর মানে হলো সারা দেশে বিজেপি যে বিভাজন সৃষ্টি করেছে তা দূর করে আবার একত্র করা।

কংগ্রেসের অন্য এক সংসদ সদস্য মনীশ তিওয়ারি টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘চীন-ভারত সমস্যা নিয়ে তিনি সংসদে আলোচনার জন্য ৫৬ বার নোটিস দিয়েছেন। কিন্তু ৫৬ বারই বিজেপি স্পিকার তা প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে ভারত জোড়ো যাত্রা ছাড়া আর উপায় কী? সংসদে আমাদের কথা শোনা হয় না। মিডিয়াও কোনো অজ্ঞাত চাপে আমাদের কথা বলে না। তাই রাহুল সরাসরি মানুষের কাছেই চলে গেছেন। মানুষই এই চরম অবস্থার জবাব দেবে।’ টিভির পর্দায় এ আলোচনায় অংশ নিয়ে ভারতের দক্ষ গোয়েন্দা ও পুলিশ অফিসার উত্তর প্রদেশের সাবেক ডিজি বিক্রম সিং সরাসরি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে আক্রমণ করে বলেন, দিল্লির পুলিশ তাঁরই অধীনে। তিনি দিল্লি পুলিশের ব্যর্থতার জন্য তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। এ আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন আরএসএস নেতা পিকেডি নাস্বিয়ার। তিনি বলেছেন, রাহুলের এ যাত্রা ব্যর্থ হয়ে গেছে। ফলে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি আরও ৫০ বছর দেশ শাসন করবে।

একজন তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেন মোদির বর্তমান বয়স ৭৫। আরও ৫০ বছর পরে তাঁর বয়স কত হবে? কংগ্রেস নেতারা আরও মনে করেন, রাহুল গান্ধীর এই ভারত জোড়ো যাত্রা সফলতার দিকে যাচ্ছে বলেই বিজেপি ও আরএসএস নেতারা উদ্বিগ্ন। তাঁরা মনে করেন, রাহুলকে সরিয়ে দিলেই কংগ্রেসমুক্ত ভারত হবে না। ১৪০ বছরের এই দল পরিচালনার দায়িত্ব তাঁরাই নেবেন, যাঁরা কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী।

রাহুলের যাত্রা শেষ হওয়ার পর প্রিয়াঙ্কা গান্ধী মহিলাদের নিয়ে সারা দেশে যাত্রা শুরু করবেন বলে এআইসিসি সূত্রে ঘোষণা করা হয়েছে। বিজেপি নেতারা কটাক্ষ করে বলেছেন, প্রিয়াঙ্কা তো উত্তর প্রদেশ নির্বাচনের দায়িত্বে ছিলেন। একটি আসনও তারা পেয়েছেন কি? তর্কবিতর্ক চলছে। প্রিয়াঙ্কার নেতৃত্বেই কংগ্রেস হিমাচল প্রদেশে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। এ বছর (২০২৩) ভারতের একটি রাজ্যে নির্বাচন হবে। দুটি রাজ্যে কংগ্রেস ক্ষমতায় আছে আর পাঁচটিতে সর্বশেষ নির্বাচনে জিতে ছিল। কিন্তু টাকা দিয়ে বিধায়কদের কিনে নিয়ে বিজেপি সেই রাজ্যগুলোর ক্ষমতা দখল করেছে। পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস পিছিয়ে নেই। সিপিএমের সঙ্গে জোট বেঁধে তারা রাস্তায় নেমে পড়েছে। অধীর চৌধুরী তিন দিন ধরে সুন্দরবন এলাকায় পদযাত্রা করছেন। রাহুল গান্ধী দিঘা থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত পদযাত্রা করার কর্মসূচি নিয়েছেন। পাঞ্জাব, জম্মু-কাশ্মীর যাত্রা শেষ করে উত্তর প্রদেশে ঢুকবেন। সেখানেই কংগ্রেসের ভয়। সেখানে সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব ও মায়াবতী উভয়েই বিজেপির পক্ষে থাকবেন। সমাজবাদী পার্টি যাতে কংগ্রেসের দিকে না যায় তা দেখার জন্য জ্যোতিবসু মন্ত্রিসভার এক বাঙালি লক্ষেèৗতে গিয়ে ঘাঁটি গেড়েছেন। দুর্নীতির দায়ে জ্যোতিবসু তাকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে কিরণময় নন্দ অখিলেশ যাদব ও মমতা ব্যানার্জির মধ্যে সেতুর কাজ করছেন। ২০২৩-২৪ এ দুটি বছর ভারতের পক্ষে কঠিন সময়। প্রথমে ৯টি রাজ্যে নির্বাচনের ফলের ওপর নির্ভর করবে ২০২৪-এ ভারতবর্ষে কারা ক্ষমতায় আসবে। আরএসএস রাজ্যে রাজ্যে ভয় ও হুমকি দেখিয়ে সংখ্যালঘুদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করছে।

মাত্র কয়েক দিন আগে মধ্যপ্রদেশ থেকে বিজেপির সংসদ সদস্য প্রজ্ঞা ঠাকুর হুমকি দিতে শুরু করেছেন। ওই রাজ্যে কংগ্রেসের এক বছর শাসনকালের পর তাদের বিধায়কদের কিনে এখন বিজেপি ক্ষমতায় আছে। সেই রাজ্যে রাহুল তাঁর যাত্রা শেষ করেছেন। এখন দেখার বিষয়, পাঞ্জাব ও কাশ্মীরে রাহুলের যাত্রায় কী হয়।

লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর