শিরোনাম
শনিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

শেখ হাসিনার ফসলি উঠোন

শাইখ সিরাজ

শেখ হাসিনার ফসলি উঠোন

“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ

খুঁজিতে যাই না আর...”

কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার পঙ্ক্তিতে উঠে আসা বাংলাদেশের চিরায়ত যে রূপ তাই যেন আমি অন্বেষণ করে আসছি গ্রামে গ্রামে কৃষকের খেত থেকে খেতে ঘুরে ঘুরে। কর্মজীবনের ৪০টি বছর ছুটে চলেছি দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। টেলিভিশনে কিংবা পত্রিকায় আমি তুলে ধরতে চেয়েছি এ দেশের কৃষি ও কৃষকের কথা। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমার সুযোগ হয়েছে বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রযন্ত্রের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলার। কাছাকাছি যাওয়ার। এবার আমার বড় একটি সুযোগ হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কৃষি ভাবনা খুব কাছ থেকে জানার, দেশবাসীকে জানানোর। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জাতীয় সংসদ ভবনের উত্তর কোণে গণভবন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন। এক অসাধারণ ভূমিখন্ড। বাঙালির জীবনের অসাধারণ বৈচিত্র্য, প্রাণসংস্কৃতি আর গণমানুষের আশা আকাক্সক্ষার বাতি জ্বলে এখান থেকেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের অনুমতি দিলেন সেখানে তাঁর কৃষি অনুশীলন দেখতে যাওয়ার। পৌষে শীতের এক বিকালে আমার শুটিং টিম নিয়ে হাজির হলাম গণভবনে। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানের বাসভবনেই ক্ষমতা, শৃঙ্খলা, স্বপ্ন আর শাসনের অনুশীলন থাকে। কিন্তু গণভবন অনেকটা আলাদা। এখানে শৌখিনতার অনুশীলনের চেয়ে অপরূপ, সমৃদ্ধশালী আর শান্ত সবুজে ভরপুর এক বাংলাদেশের আদি রূপটি অঙ্কিত হয়ে আছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পদস্পর্শ রয়েছে এখানকার ফসলি মাঠে, ভিতরের মেঠোপথে। তাঁর হাতের স্পর্শ লেগে আছে গণভবনের প্রান্তরের সব খানে। তাঁর ছায়ার ওপর দিয়েই বিচরণ করছেন বাংলাদেশের বারোতম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় প্রভাবশালী নারীদের একজন।

বিশ্বসভায়, যেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, সেখানেই খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে আগামীর ব্যবস্থাপত্র। সেখানেই বিস্মিত নেত্রে পৃথিবী দেখছে, একটি জাতির ভাগ্য পাল্টে দেওয়ার পেছনে কতটা লাগসই হতে পারে কৃষির প্রতি মনোযোগ। সেই বিষয়টি আমরা দেখেছি বিশ্বের বিভিন্ন সভা-সেমিনারে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী। যেখান থেকে দেখি বজ্রকঠিন নেতৃত্ব, দূরদর্শী সিদ্ধান্ত আর দেশকে ওপরে তুলে ধরার ইস্পাত কঠিন শপথ, বহু সংকট জর্জরিত অর্থনীতিকে সক্রিয় ও সফল করে তুলতে যত পথ হাঁটতে হয়, হেঁটেছেন তিনি। এখনো হাঁটছেন সদর্পে। বাবার স্বপ্নের সোনার বাংলাকে সর্বতোভাবে গুছিয়ে তুলতে সবখানেই রোপণ করেছেন দিন বদলের বৃক্ষ। যার ফসলও পৌঁছে যাচ্ছে বাঙালির ঘরে ঘরে। আর এখানে এ গণভবনের পূর্ণ আঙিনা, তারই এক সংক্ষিপ্ত সার। গণভবনের হেলিপ্যাডের ছোট্ট পরিসরেই বাংলার কৃষি সভ্যতার এক সুসজ্জিত রূপ দেখতে পাই।

বিকালের উজ্জ্বল আলোয় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে তাঁর নিজস্ব আলোয় যেন আরও আলোকিত হয়ে ওঠে গণভবনের ফসলের মাঠ। তিনি আমাদের নিয়ে যান সবজির মাঠে। শীতের সব সবজিই সেখানে উৎপাদিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে বলি, ‘এই ফসলের মাঠ দেখে মনে হচ্ছে এটা আপনার কোনো গবেষণা প্লট।’ তাঁর ঠোঁটে লেগে থাকে স্বভাবসুলভ হাসি। বলেন, ‘নতুন নতুন অনেক কিছুই এখানে পরীক্ষামূলক চাষাবাদ হয়। আমাদের নজরুল কিউরেটর যশোর থেকে একটা আদি ভ্যারাইটির চাল এনেছিল। বাঁশফুল। এর দারুণ ফলন হয়েছে এখানে।’ মাঠের মাঝখানে হেলিপ্যাডে টেবিলে সাজানো খেতের শাকসবজি ও ফলমূলের সঙ্গে প্যাকেট করা গণভবনের মাঠে উৎপাদিত চালও ছিল। তিনি বাঁশফুলের প্যাকেটটি দেখিয়ে বললেন, ‘চালটি দেখতে সরু কিন্তু ভাত রান্নার পর মোটা হয়। আতপ চালের সুন্দর ঘ্রাণ আসে।’ বুঝলাম দেশের কৃষির সবকিছুই তিনি রেখেছেন তাঁর গভীর চিন্তা-ভাবনায়। এ সবুজ ফসলি মায়ার ভিতর দিয়েই প্রতিদিন নিজেকে প্রস্তুত করে তোলেন দেশের মানুষের জন্য।

গণভবনের মাঠের এক কোণে সরিষার ফলন হয়েছে দারুণ। তার পাশেই ৮টি মৌ বক্সে মৌমাছির মাধ্যমে উৎপাদন হচ্ছে খাঁটি মধু। বহুমুখী উন্নয়ন তৎপরতা যতখানি উন্নত দেশের তালিকা ছুঁয়ে ফেলার স্বপ্ন দেখায়, তার চেয়ে বেশি স্বপ্ন দেখায় আমাদের কৃষি। মাঠের কৃষকের বাইরেও বিভিন্ন পেশার অগণিত বাঙালি আজ কৃষিতে নিয়োজিত, সেখানে সবচেয়ে উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি নিজেই কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের যশস্বী কৃষক। ফল ফসলের মায়া আর ভালোবাসার সঙ্গে নিজেও মিশে আছেন গভীরভাবে। আমরা তাঁর ফসলি মাঠ ধরে হেঁটে বেড়াই। সেখানে দেশি লাউ-শিমের মাচা থেকে শুরু করে বথুয়া (স্থানীয়ভাবে যাকে বলে বুইত্তা শাক), লেটুস, ব্রুকলি, ক্যাপসিকামসহ নানা বিদেশি সবজির ফলন। জনবহুল ঢাকা মেট্রোপলিটনের কেন্দ্রে বসে অনেক জায়গায় ঋতু বৈচিত্র্য ও বাংলাদেশের আদি দৃশ্যপট খুঁজে না পাওয়া গেলেও গণভবনের ভিতরে আছে ষড়ঋতুর পালাবদল। এখানে একের পর এক আবর্তিত হয় ফসলি মৌসুম। আসে নবান্ন। আসে নতুন ফসলের বিস্ময়। যেন দেশজোড়া অগণিত টুকরো টুকরো কৃষি সাফল্যের একটি সংক্ষিপ্ত সন্নিবেশ।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিলাম। তিনি বলছিলেন তাঁর শৈশবের কথা। বাইগার নদীর তীরঘেঁষা টুঙ্গিপাড়ায় দেখা কৃষিসংস্কৃতি কিংবা সেগুনবাগিচায় ভাই কামালের সঙ্গে বাগান সাজানোর গল্প। আমরা তাঁর সঙ্গে হাঁটছিলাম আর কান পেতে শুনছিলাম, মনে হচ্ছিল গণভবনের ফসলের মাঠটি শীতের শেষ বিকালের রোদে মিশে গিয়ে মায়া ছড়াচ্ছিল। প্রতিদিন সময় করে খেতের ফসল আর গৃহপালিত প্রাণী বা পাখিকুলের একান্ত বান্ধব হয়ে ওঠেন প্রধানমন্ত্রী। তিতির, কবুতর, হাঁস, মুরগি থেকে শুরু করে গরু এবং ছাগলও আছে গণভবনে। যেমনটা থাকে গ্রামের কৃষকের বাড়িতে। সবকিছুর প্রতিই প্রধানমন্ত্রীর স্নেহ মমতা দেখার মতো। মাটির সানকিতে সদ্যোজাত দুটি ঘুঘু ছানা শীতে কাঁপছিল। তিনি পরশের হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠলেন, ‘আহারে..!’ সেখান থেকে আমরা হেঁটে চললাম লেকের দিকে। যেখানে মাছ, হাঁস আর মুক্তার চাষ। যেতে যেতেই চোখে পড়ল ফুলের বাগান। তেজপাতা গাছ। তমাল গাছ। প্রধানমন্ত্রী জানালেন তিনি তমাল গাছ সংগ্রহ করেছেন টাঙ্গাইল থেকে। সবকিছুর দিকেই প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি। সিঁড়ির ধাপ পেরোনোর সময় আমাকে সতর্ক করলেন, ‘দেখবেন!’ শুরু থেকে এর মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে দেড় ঘণ্টা সময়। আমরা গিয়ে দাঁড়ালাম লেকের ধারে। এখানে মাছ চাষ করছেন তিনি। মাছ আর হাঁসের দলকে নিজ হাতে খাবার দিলেন। মোড়া পেতে বসলেন। আমাকেও পাশে বসতে বললেন। সেখানে বসেই দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিলাম। কৃষকের প্রত্যাশার জায়গাগুলো এখন দিনে দিনে পূরণ হচ্ছে। কৃষক এখন আগামীর উন্নত বাংলাদেশ রচনার উন্নয়ন অংশীদার। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্পর্শ লাগে এখন তাদের চোখেমুখেও। এর সূচনা তাঁর সরকারের হাত ধরেই। এখন পূর্ণতা পাচ্ছে ধীরে ধীরে। এসব কথা বলছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, ‘২০০৮ সালের নির্বাচনের পর প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের শপথের দিন, মাঘের শেষে, সেদিন বৃষ্টি হয়েছিল। সেদিন আমার সুযোগ হয়েছিল আপনার সাক্ষাৎকার নেওয়ার। আমি বলেছিলাম খনার বচনে আছে, ‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্যি রাজার পুণ্য দেশ।’ আপনি বলেছিলেন, ‘আমরা প্রত্যাশা করি মহান আল্লাহ আমাদের ওপর রহম করবেন। সরকার খাদ্য নিরাপত্তার দিকেই দৃষ্টি রাখবে সবার প্রথমে। আর সে জন্যই কৃষির প্রতি গুরুত্ব থাকবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে।’ প্রধানমন্ত্রী জানালেন কীভাবে কৃষি অনুরাগী হলেন। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে কৃষিকে তিনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন। কৃষির যাবতীয় বিষয় নিয়ে কথা হলো তাঁর সঙ্গে। শুধু তাই নয়, আগামীর কৃষি ভাবনা সম্পর্কেও জানতে চাইলাম আমি। তিনি বলে গেলেন তাঁর স্বপ্নের কথা। আমরা তন্ময় হয়ে শুনলাম। প্রিয় পাঠক, ১১ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টা ৩০ মিনিটে চ্যানেল আই-তে প্রচার হবে ‘শেখ হাসিনার ফসলি উঠোন : গণভবনে বাংলার মুখ’ শীর্ষক প্রামাণ্য প্রতিবেদনটি। বিস্তারিত সাক্ষাৎকার আর এক দিন আপনাদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরব।

             লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, [email protected]

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর