রবিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
ইতিহাস

অনন্য সোনারগাঁ

সোনারগাঁ বাংলাদেশের এক প্রাচীন জনপদ। মহাভারতে বর্ণিত কুরুপা-ব যুদ্ধের সময় এবং সম্ভবত এর আগেও এ জনপদের অস্তিত্ব ছিল বলে অনুমিত হয়। এ জনপদের অবস্থান নির্ধারণ করতে গেলে বলা যায় যে, প্রাচীনকালে এ জনপদের অবস্থান ছিল শীতলক্ষ্যা ও মেঘনার মধ্যবর্তী ওই ভূখন্ডে যা বর্তমানে নরসিংদী এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা।

সম্ভবত তের শতকের সত্তরের দশকে রাজা দনুজ রায়ের অধীনে সোনারগাঁ স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের রাজধানীতে পরিণত হয়। তখন থেকে পূর্ববঙ্গে স্বাধীন হিন্দু রাজত্বের অবসানের (১৩০২) পূর্ব পর্যন্ত সোনারগাঁ বঙ্গরাজ্যের রাজধানী ছিল। এ সময়ের পর থেকে গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহের উত্থান এবং পূর্ববঙ্গে স্বাধীন সালতানাত শাসন প্রতিষ্ঠার (১৩১৭) পূর্ব পর্যন্ত সময়ে সোনারগাঁয়ের গৌরব সাময়িক ম্লান হয়ে পড়ে। পূর্ববঙ্গে বাহাদুর শাহের সালতানাতের রাজধানী ছিল সোনারগাঁ। বাহাদুর শাহের পতন (১৩২৮) এবং বাংলাকে মুহাম্মদ বিন তুগলকের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার পর পরবর্তী এক দশককাল সোনারগাঁ নগরী ছিল বাংলার পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের প্রশাসনিক কেন্দ্র।

সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলার প্রথম স্বাধীন মুসলিম সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। তার রাজধানী ছিল সোনারগাঁ। তখন থেকেই শুরু হয় সোনারগাঁয়ের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের। ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে লখনৌতির সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের হাতে ফখরুদ্দীনের রাজবংশের পতনের আগ পর্যন্ত ১৪ বছর সোনারগাঁ সমগ্র পূর্ববঙ্গ ও দক্ষিণপূর্ববঙ্গের সুলতানি শাসনের রাজধানীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল। সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ ও সিকান্দর শাহের শাসনামলে সোনারগাঁ ছিল পূর্ববঙ্গ প্রদেশের রাজধানী। পূর্ববঙ্গে গিয়াসুদ্দীন আযম শাহের স্বাধীন শাসনামলে তার রাজধানী ছিল সোনারগাঁ। ঈসা খান মসনদ-ই-আলা প্রতিষ্ঠিত ভাটি রাজ্যের রাজধানী ছিল সোনারগাঁয়ে।

মুঘলের কাছে স্বাধীনচেতা শাসক মুসা খান মসনদ-ই-আলার পতনের পর সোনারগাঁয়ের রাজনৈতিক প্রাধান্য লোপ পায় এবং মুঘলদের বাংলা সুবাহ্র একটি প্রশাসনিক কেন্দ্রে পর্যবসিত হয়। ঢাকায় মুঘল রাজধানী প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সোনারগাঁ নগরীর দ্রুত অবক্ষয় ঘটে।

সোনারগাঁয়ে হিন্দু শাসনামলের রাজধানী শহরটি ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যা নদীর এবং পুরনো ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার সঙ্গমস্থলের সন্নিকটে ধলেশ্বরী নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত ছিল। শহরটির অবস্থান ছিল বর্তমান ঢাকা নগরীর প্রায় ২৭ কিলোমিটার দক্ষিণপূর্ব দিকে। সোনারগাঁয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে অবস্থিত মোগরাপাড়া থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত বর্তমান পানাম এলাকায় হিন্দু শাসনামলের রাজধানী শহর অবস্থিত ছিল বলে ধারণা করা হয়। মুসলিম রাজধানী শহরের কেন্দ্রস্থল সম্ভবত ছিল মেনিখালী নদীর তীরবর্তী মোগরাপাড়া। বিদ্যমান স্থাপত্য নিদর্শনাদি থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, সমগ্র মোগরাপাড়া ও গোয়ালদি এলাকায় এক সময় সুবিস্তৃত মুসলিম বসতি গড়ে উঠেছিল। সম্ভবত মুসলিম রাজধানী শহরটি মেনিখালী নদীর উত্তর তীরবর্তী মোগরাপাড়া ও এর চতুষ্পার্শ্বস্থ এলাকায় এবং গোয়ালদি ও বৈদ্যেরবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বর্তমান পানাম ও খাসনগরের মধ্যবর্তী এলাকায় বিস্তৃত হিন্দু আমলের রাজধানী শহর মুসলিম আমলে সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়নি। অনুমান করা হয়, এ এলাকায় প্রথমদিকের মুসলিম শাসনকর্তাদের আবাসস্থল ছিল।

চৌদ্দ শতকের দ্বিতীয় পাদে সোনারগাঁ একটি বাণিজ্য শহররূপে গড়ে ওঠে। সমুদ্রপথে পশ্চিম এশীয় ও দক্ষিণপূর্ব এশীয় দেশ থেকে বাণিজ্য-তরী সহজেই সোনারগাঁয়ে পৌঁছতে পারত। ইবনে বতুতা (১৩৪৬) সোনারগাঁকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী রূপে বর্ণনা করেন এবং চীন, ইন্দোনেশিয়া (জাভা) ও মালয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে এর সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন। চীনের পরিব্রাজক মা হুয়ান (১৪০৬) সোনারগাঁকে একটি বিরাট বাণিজ্যিক শহররূপে প্রত্যক্ষ করেন। হৌ-হিয়েন (১৪১৫) সোনারগাঁকে বহু পুকুর, পাকা সড়ক ও বাজারসমৃদ্ধ একটি সুরক্ষিত প্রাচীরবেষ্টিত নগর এবং বাণিজ্যকেন্দ্ররূপে উল্লেখ করেন, যেখানে সব ধরনের পণ্যসামগ্রী মজুদ ও বিক্রয় করা হতো।

রালফ ফিচ (১৫৮৬) এ নগরকে একটি ব্যস্ত বাণিজ্যকেন্দ্ররূপে বর্ণনা করেন। সোনারগাঁয়ে প্রস্তুত মসলিন, বিশেষত ‘খাস’ নামীয় অত্যুৎকৃষ্ট মসলিন সমগ্র বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করে। সতের শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে রাজনৈতিক মর্যাদা হারানোর ফলে ধীরে ধীরে সোনারগাঁয়ের বাণিজ্যিক গুরুত্বও হ্রাস পেতে থাকে।

উনিশ শতকে সুতিবস্ত্রের, প্রধানত বিলাতি থান কাপড়ের ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে পানাম নগরের অভ্যুদয়ের ফলে সোনারগাঁ বাণিজ্য ক্ষেত্রে কিছুটা প্রাধান্য লাভ করে। পানাম নগরের বর্তমান ভগ্নপ্রায় দালানকোঠা হচ্ছে হিন্দু ব্যবসায়ীদের তৈরি আবাসিক ভবন। ইউরোপীয় অনুপ্রেরণায় নতুন ঔপনিবেশিক স্থাপত্য রীতিতে এগুলো নির্মিত।

বোখারার জ্ঞানতাপস মাওলানা শরফুদ্দীন আবু তওয়ামার নেতৃত্বে সোনারগাঁ ইসলামী শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়। তিনি সম্ভবত ১২৭০ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁয়ে এসে স্বীয় খানকা ও একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এ মাদরাসায় ইসলামী শিক্ষার সব শাখায় এবং লৌকিক বিজ্ঞানের ওপর শিক্ষাদান ও অধ্যয়নের ব্যবস্থা ছিল। সমগ্র উপমহাদেশে এ মাদরাসার বহুল সুখ্যাতি ছিল এবং দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে শিক্ষালাভের জন্য সমবেত হতো। বিহারের বিখ্যাত সুফি ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ শরফুদ্দীন ইয়াহিয়া মানেরী এ মাদরাসায়ই শিক্ষালাভ করেন। সম্ভবত মোগরাপাড়ার বর্তমান দরগাহবাড়িতে অবস্থিত ছিল এ জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র। ইতিহাসখ্যাত সোনারগাঁ নগর এখন শুধু নামেই রয়েছে। ঢাকা নগরীর প্রতিষ্ঠার পর থেকে সোনারগাঁ তার প্রাধান্য হারাতে থাকে এবং উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের মধ্যে সোনারগাঁ পরিণত হয় ‘গভীর জঙ্গলে আচ্ছাদিত গ-  গ্রামে’।  কিন্তু প্রায় এক শতক কালের ব্যবধানে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যোগাযোগ সুবিধার ফলে শীতলক্ষ্যা ও মেঘনার মধ্যবর্তী ভূভাগ এখন পরিণত হয়েছে একটি উৎপাদনশীল এলাকায়।

                সুদীপ্ত সুজন

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর