সোমবার, ৬ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

শীর্ষ বোদ্ধাদের বিরল, দ্বিধাহীন বক্তব্য

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

শীর্ষ বোদ্ধাদের বিরল, দ্বিধাহীন বক্তব্য

গত ১ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে দেশে মুক্ত বুদ্ধিচর্চার সর্বোচ্চ শৃঙ্গে অবস্থানরতদের এক মহামিলন ঘটে গেল আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারপতি ওবায়দুল হাসান (শাহিন)-এর লেখা বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এবং তার স্ত্রী নাফিসা বানুর লেখা বঙ্গবন্ধু শুদ্ধাচার নারীর ক্ষমতায়ন- বই দুটির মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে। সেই সমাবেশে দেশের শ্রেষ্ঠতম কয়েকজন বুদ্ধিজীবী অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় এমন কটি সত্য বাণী উচ্চারণ করেছেন যা বিগত বহু বছর প্রকাশ্যে এ ধরনের উচ্চমার্গের ব্যক্তিত্বদের কাছ থেকে শোনা যায়নি।

সভায় বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, রাষ্ট্রের পদমর্যাদায় যার অবস্থান ৩ নম্বরে, কোনো প্রকার রাখঢাক না রেখেই স্পষ্ট ভাষণ দিয়েছেন। একই ধরনের ভাষণ দিয়ে সবাইকে অভিভূত করেছেন প্রাক্তন মাননীয় প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক, প্রাক্তন মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান (ননি) যিনি অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন এবং স্বনামধন্য ইতিহাসবিদ, মুক্তিযোদ্ধা গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার এবং গণহত্যা জাদুঘর-প্রধান অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। আরও ভাষণ দিয়েছেন দেশের সুপ্রসিদ্ধ মহিলা রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রওশন আরা।

মাননীয় প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী স্পষ্টবাদিতার বিরল উদাহরণ সৃষ্টি করে দেশের কিছু সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট মানুষের তীর্যক সমালোচনা করে বলেছেন, যারা গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে ধর্ম নিরপেক্ষতার পক্ষে বুলি আওড়াতে থাকে, রাষ্ট্রধর্ম তত্ত্বের বিরুদ্ধে কথার ঢেউ তোলে, সেই একই গোষ্ঠী বাংলাদেশে কোনো সাম্প্রদায়িক অঘটন ঘটলে তাতে আবার ইন্ধন জোগায়- এই হচ্ছে তাদের দ্বৈত অবস্থান। দ্বিধাহীন ভাষায় তিনি বলেন, দেশে বহু লোক বঙ্গবন্ধুকে এবং এমনকি বাংলাদেশকেও স্বীকার করে না। মাননীয় প্রধান বিচারপতি আরও বলেছেন, শেষ বিচারের দিন সৃষ্টিকর্তা কারও ধর্মীয় পরিচয় জানতে চাইবেন না, বরং জিজ্ঞেস করবেন তাদের কৃত কর্মকান্ডের কথা। দেশের বিচার অঙ্গের প্রধান থেকে এমন স্পষ্ট বার্তা অতীব গুরুত্বসহকারে অনুধাবন এবং অনুসরণ উভয়ই সময়ের প্রয়োজন বটে। যারা বঙ্গবন্ধু তথা বাংলাদেশকে মানে না তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত সেটিও ভাবনার জগতে বিরাজমান রাখা প্রয়োজন।

মাননীয় সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক বলেছেন, ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ১৯৭০ সালে লন্ডন ভ্রমণের প্রাক্কালে তদানীন্তন পূর্ববাংলায় রাস্তাঘাটে দেখতে পেয়েছিলাম শুধু নৌকা আর বঙ্গবন্ধুর ছবি। ব্যারিস্টারি পাস করে ১৯৭৬ সালে দেশে ফিরে একই স্থানগুলোতে আর নৌকা বা বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখতে পাইনি। এই হচ্ছে আমাদের বহু লোকের দ্বৈত বৈশিষ্ট্য।

তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, পাকিস্তানি পিশাচরা ৫ লাখ মা-বোনকে ধর্ষণ করেছে অথচ এর পরেও পাকিস্তানি ক্রিকেট দল বাংলাদেশে এলে কিছু তরুণী ‘আমাকে বিয়ে কর আফ্রিদি’ কথা গালে লিখে স্টেডিয়ামে যায়। তিনি আরও বলেছেন, শুদ্ধাচারী হতে হলে ধার্মিক হতে হবে এ কথা ঠিক নয়, নাস্তিকরাও শুদ্ধাচারী হতে পারেন। সাবেক আরেক মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন অসাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, এ জন্য মনোজগতে শুদ্ধাচার অপরিহার্য। আরেক আলোচক আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম অসাম্প্রদায়িকতায় বঙ্গবন্ধুর চিরজীবনের প্রত্যয়কে জনসম্মুখে তুলে ধরার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

অনুষ্ঠানে মুখ্য আলোচক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন যে স্পষ্টবাদিতা প্রদর্শন করেছেন তাতে কবিগুরুর ভাষায় বলতে হয়- ‘তুমি ঊষার সোনার বিন্দু, প্রাণের সিন্ধু কুলে।’ তিনি বলেছেন, এখনো দেশের ৩০% লোক বাংলাদেশকেই বিশ্বাস করে না। তাঁর কথা অনুযায়ী রাজাকার কোনোদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমর্থক হতে পারে না বিধায় বাংলাদেশকে স্বীকার করা মরীচিকায় পানি খোঁজার শামিল। তিনি তাঁর একটি বহু উল্লিখিত উক্তির অবতারণা করে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু একটি অনিচ্ছুক জাতিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে নামিয়েছিলেন।’ তিনি বলেছেন, একটি জনগোষ্ঠীর মনে এখনো ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনিত হয়, তাদের মনের মণিকোঠায় বিরাজ করছে পাকিস্তান। দুঃখ করে তিনি আরও বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা কাগজ-কলমেই রয়ে গেছে, বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যায় না। তিনি বিস্ময়ের সুরে বলেন, নিম্ন আদালতগুলো হাই কোর্ট-সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা মানে না। দুর্নীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ৫০০ টাকার চোরকে সাজা দিতে কেউ ভোলে না। ৫ লাখ টাকার দুর্নীতি করলে তাদেরও অনেক সময় ছাড়া হয় না; কিন্তু যে লোক ৫ কোটি টাকার দুর্নীতি করে তাকে সবাই স্যার ডাকে। অনুষ্ঠানের সভাপতি মাননীয় বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান (ননি) তাঁর মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে প্রশ্ন করেন- কেন এবং কীভাবে এ পরিস্থিতি উল্টে গেল তা নিরীক্ষা করে গবেষণামূলক লেখার জন্য মুনতাসীর মামুনদের মতো গুণী এবং নিবেদিত গবেষকদের আরও সময় দেওয়া আজ জরুরি হয়ে পড়েছে। নিম্ন আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট এবং বিচারকরা যে হাই কোর্ট-সুপ্রিম কোর্টের আদেশ মানেন না, মাননীয় বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান (ননি) তা স্বীকার করে বলেন, অধ্যাপক মামুনদের উচিত এই ম্যাজিস্ট্রেট-বিচারকদের পরিচিতি খোলাসা করা, যাতে উচ্চ আদালত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে, যে ক্ষমতা উচ্চ আদালতের রয়েছে। দেশের একজন শীর্ষ মহিলা রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রওশন আরা (যিনি অবসরপ্রাপ্ত মাননীয় বিচারপতি আবদুর রশিদের স্ত্রী)  বলেছেন, যেই ঘৃণীত দ্বিজাতিতত্ত্বের জাঁতাকলে চাপা পড়ে ভারত বিভক্তির সময় উপমহাদেশের পবিত্র মাটি উভয় ধর্মের লাখ লাখ মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আশা করা হয়েছিল সেই তত্ত্বের ভূত দেশ ছেড়ে পালাবে, কিন্তু দুঃখজনকভাবে এহেন প্রত্যাশা সুদূর পরাহত রয়ে গেছে। সেই ভূত এখনো বহু লোকের ঘাড়ে চেপে বসে আছে। তিনি সেসব মাননীয় বিচারপতি এবং অবসরপ্রাপ্ত মাননীয় বিচারপতিদের ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে কলম ধরার জন্য আরও অধিক সময় অতিবাহিত করার পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি এ কথাও বলেন, যারা বাংলাদেশে বিশ্বাস করে না তাদের কোনো অধিকার নেই এ দেশে বসবাস করার।

যেসব মাননীয় বক্তা নীরবতা বা সংকোচের অবাঞ্ছিত ঢাকনা সরিয়ে দিয়ে উল্লিখিত সভায় জাতির বিবেক নাড়া দিতে সক্ষম কথাগুলো বলেছেন তাদের সবাই হয় মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। যারা উপস্থিত ছিলেন তাদেরও সবাই জ্ঞানচর্চায় ব্যস্ত ব্যক্তিত্ব। মাননীয় প্রধান বিচারপতি দেশে এখনো বসবাসকারী মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িকতায় নেশাগ্রস্ত লোকদের সম্পর্কে যা বলেছেন, অতীতে তাঁর মতো উঁচু অবস্থানে থাকা কেউ এমন কথা বলার মানসিকতা প্রদর্শন করেননি বলে মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে সাধুবাদ জানানোই যথেষ্ট নয়, তাঁকে ঋষিসমই বলতে হয়। তিনি যেভাবে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের তাঁবু উপেক্ষা করে সত্য প্রকাশের তাড়নায় মুখ খুলেছিলেন সেটি কবিগুরুর সেই লাইনটিই মনে করিয়ে দেয়- ‘সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান’। আশা করা যায় ভবিষ্যতে অন্যরাও তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক লোকদের ডানা কেটে দিতে পারবেন। তাঁর বক্তব্য নিশ্চয়ই রাষ্ট্রীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে কর্মরত এমন বহুজনকে মুখ খুলে সত্য কথা প্রকাশ করতে অনুপ্রাণিত করবে যারা বিভিন্ন কারণে মনের মধ্যে চেপে থাকা কথাগুলো প্রকাশ করার ব্যাপারে অনীহাগ্রস্ত।

সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক শুধু সত্যের সাধকই নন, বিচারপতির পদ অলংকৃত করাকালে তিনি এমন সব মুক্তিযুদ্ধপন্থি, গণতন্ত্রপন্থি, সামরিক একনায়কতন্ত্রবিরোধী রায় দিয়েছেন, যেগুলো চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে। উল্লিখিত সভায় তিনি যা বললেন তা প্রগতির ধারক-বাহক মানুষের মননে নতুন উদ্যম জাগাবে। কবিগুরুর ভাষায়- ‘এবার তোর মরা গাঙ্গে বান এসেছে, জয় মা বলে ভাসা তরী।’

অধ্যাপক মামুন শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং গণহত্যা গবেষকই নন, একজন নির্ভীক এবং দ্বিধাহীন স্পষ্টবাদী হিসেবে তাঁর খ্যাতি বাংলাদেশের বাইরেও রয়েছে। সত্যের মুখে কুলুপ দেওয়া লোকদের প্রতি তাঁর বিরাগসুলভ অনুভূতি সর্বজনবিদিত। তিনি বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধা তিনি যিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের সামনে জয় বাংলা বলে গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েছেন, যে মহিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করায় তাকে পাকিস্তানি সামরিক গাড়ির পেছনে বেঁধে শহরের রাস্তায় গড়াতে গড়াতে খুন করা হয়েছে। সর্বোপরি তাঁর সেই বহুল আলোচিত উক্তি যে, বঙ্গবন্ধু একটি অনিচ্ছুক জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের পথ দেখিয়েছিলেন, তা সেদিন উপস্থিত সবার মনোজগতে কম্পন তুলেছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিশ্চয়ই স্বাধীনতার পক্ষে থেকে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন, কিন্তু এমন অনেকেই যারা ধর্মীয় রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের অভ্যুত্থান চায়নি, যে কথার ইঙ্গিত মাননীয় প্রধান বিচারপতির ভাষণেও রয়েছে। অধ্যাপক মামুনের ভাষায় তারা দেশের নাগরিকদের ৩০%। আগে বলা হতো নির্যাতিত নারীর সংখ্যা ২ লাখ। কিন্তু অধ্যাপক মামুনের গবেষণায় দেখা যায় তাদের সংখ্যা ৫ লাখের নিচে নয়, যে সংখ্যাতত্ত্ব বহু বিদেশির নিরীক্ষা দ্বারাও প্রমাণিত।

সপ্তাহ দুয়েক আগে বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান গাউস সুলতান প্রণীত ‘বিশ শতকের বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন সভায় জনপ্রিয় এবং সংশয়হীন সংসদ সদস্য এরোমা দত্ত বলেছিলেন, পাকিস্তান আমলে তিনি ভিকারুননিসা স্কুলের ছাত্রী ছিলেন এবং তখন ক্লাস শুরুর আগে পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত পাকসার জমিন গানের বদলে কবিগুরুর ‘সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান’ গান গাওয়া হতো অথচ আজ ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে আমরা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কালো হাতের চাপে এমনভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছি যে সে চিন্তা-চেতনা আমরা জিইয়ে রাখতে পারছি না।

১ মার্চের অনুষ্ঠানে দেশের অতি বিশিষ্ট একান্ত পূজনীয় এবং প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিদের সংকোচ এবং সংশয়বর্জিত বার্তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং  অসাম্প্রদায়িকতার অকাট্য প্রত্যয় সংশ্লিষ্ট সবাইকে নতুন মাত্রায় অনুপ্রাণিত করবে বলে বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে, আর তাহলেই সেদিনের অনুষ্ঠানে বক্তাদের ভাষণের স্বার্থকতা প্রস্ফুটিত হবে।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

সর্বশেষ খবর