মানুষের নৈতিক গুণাবলি লোপ পাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বলে মূল্যবোধের অবক্ষয়। মূল্যবোধ তথা শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, সততা, কর্তব্যপরায়ণতা, নিষ্ঠা, ধৈর্য, উদারতা, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃজনশীলতা, পারস্পরিক মমত্ববোধ, আস্থা, বিশ্বাস, মান্যতা ইত্যাদি মূল্যবোধের আজকে দিন দিন চরম অবক্ষয় বা ‘ক্ষয়প্রাপ্তি’ হচ্ছে। আজকের চারদিকে তাকালে দেখা যায় পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং শিক্ষাঙ্গনসহ সব ক্ষেত্রে অবক্ষয়ের ছাপ। নৈতিক মূল্যবোধগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। সবার মধ্যে ভীতসন্ত্রস্ততা, অশান্তি ও অস্থিরতা বাড়ছে। যেখানে নৈতিকতা অনুপস্থিত সেখানে সামাজিক অবক্ষয় সবচেয়ে বেশি। দেশের সর্বস্তরে নৈতিকতার অনুপস্থিতির কারণে এ অবক্ষয় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে নিপীড়ন থেকে মুক্তি, চাটুকারিতা, তোষামোদী ও পদ-পদবির লোভে মানুষ নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আজকের অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে অসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব, প্রকৃত শিক্ষা ও পদ-পদবিতে যোগ্যতাহীনতার প্রচন্ড ঘাটতি। এ অবক্ষয়ের গতি আরও নিম্নমুখী করেছে অর্থ-সম্পদ ও ভোগ-বিলাসের প্রতি লাগামহীন লোভ ও বাসনা। যেখানে নৈতিকতা অনুপস্থিত সেখানে সামাজিক অবক্ষয় সবচেয়ে বেশি। সেই সঙ্গে শিক্ষার অতিমাত্রায় বাণিজ্যকরণ, অযোগ্য তথা কুশিক্ষিত রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্বের কারণে সামাজিক বিশৃঙ্খলা, সুশাসনের অভাব, পারস্পরিক দূরত্ব বৃদ্ধি, দায়িত্ব এড়িয়ে চলার প্রবণতা, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, প্রতিহিংসা-প্রতিশোধের রাজনীতি, সমাজে পেশিশক্তির প্রভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি দিন দিন বেড়েই চলেছে।
বিগত করোনায় সামাজিক অবক্ষয়ের মাত্রা বেড়েছে অনেক। শুভবোধগুলো সংকুচিত হওয়ায় হতাশার আগুনে পুড়ছেন অনেকে। মানসিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। মেধাশূন্যতার শঙ্কাতেও উৎকণ্ঠা বাড়ছে। বিভিন্নভাবে শুভ ভাবনায় বাধা সৃষ্টি করছে। আদর্শ মানুষ হওয়ার পথ হচ্ছে সংকুচিত। বাস্তবতা হলো- সামাজিক অবক্ষয় এখন বহুল আলোচিত বিষয়। অবক্ষয়ের কারণ শুধু দারিদ্র্য, কর্মহীনতা, অভাব, অনটন তা ঠিক নয়। মানসিকতার দৈন্যও অবক্ষয়ের কারণ। সামাজিক মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার অভাবে সামাজিক অবক্ষয়ের পথ প্রশস্ত হচ্ছে। মানুষ ভালোর চেয়ে মন্দটা গ্রহণ করছে সহজেই। জানা কথা যে আদর্শ মানুষের মধ্যেই থাকে নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ। সমাজের বিভিন্ন স্তরে অবক্ষয়ের থাবা দিন দিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যাংক ঋণ শোধ না করার প্রবণতা, ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ, ই-কমার্স ব্যবসার নামে প্রতারণা চলছেই। মানুষের মধ্যে আস্থা, বিশ্বাস, দায়বদ্ধতা, অঙ্গীকার, সচেতনতা, আনুগত্য দিন দিন কমে যাচ্ছে। রাজনৈতিক শিষ্টাচার, সুস্থ প্রতিযোগিতার মানসিকতা ও ন্যায়-অন্যায়বোধ আজকে বিলুপ্তির পর্যায়ে।
মূল্যবোধ ও অবক্ষয় পরস্পর বিরোধী ও সাংঘর্ষিক। মূল্যবোধ যেখানে দুর্বল, অবক্ষয় সেখানেই প্রবল। তাই অবক্ষয় ও মূল্যবোধ একসঙ্গে চলতে পারে না। মূল্যবোধ স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাগ্রত হয় না বরং রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক পরিসরে এ জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে নৈতিক শিক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রই নাগরিকের সবকিছু দেখভাল করে, তাই মূল্যবোধের লালন ও চর্চার পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্বও রাষ্ট্রের। নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্রের অন্যতম কর্তব্য হবে নৈতিক শিক্ষা ও মূলবোধের চর্চাকে উৎসাহিত করা এবং সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া। সেই সঙ্গে দল, মত, বিশ্বাস, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রতি নিরপেক্ষ আচরণ ও প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সঠিক শিক্ষা ও সচেতনতা তথা মূল্যবোধকে অবারিত করাকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। তবে সব শিক্ষিতই যে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন হবে বা অবক্ষয়মুক্ত থাকবে এমনটা আশা করাও ঠিক নয়। যেসব মানুষ সুশিক্ষিত হতে পারেনি অর্থাৎ শিক্ষার মাধ্যমে সুকুমার বৃত্তির পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারেনি তাদের মাধ্যমে মূল্যবোধ ও ন্যায্যতার চর্চা কখনো সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সুশিক্ষা বা সঠিক শিক্ষাই সবচেয়ে বেশি কাক্সিক্ষত ও প্রত্যাশিত। যখন কেউ সঠিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত হয়ে ওঠে তখন তার মধ্যে আপনা-আপনিই নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সচেতনতা সৃষ্টি হয়, যা তাকে অবক্ষয় থেকে মুক্ত থাকতে সহায়তা করে। আর তখন তা ফুলে-ফলে সুশোভিত করার জন্য প্রয়োজন হয় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অনুকূল পরিবেশ বা পৃষ্ঠপোষকতা। সুশিক্ষিত সেই ব্যক্তি যে তার শিক্ষাকে সৎ আর ন্যায়ের পথে নিয়োজিত করে। যৌক্তিক বিষয়াদিকে যৌক্তিক বোঝার পর নিজ স্বার্থের দিকে নজর না দিয়ে অযৌক্তিকতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে সুন্দরকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্রত গ্রহণ করেন। নিজের, গোত্রের, প্রতিষ্ঠানের, বংশের বা শ্রেণিস্বার্থের ওপরে সত্য তথা ন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করতে ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকে। নিজের বিশ্বাস, শ্রেণিস্বার্থ, প্রতিষ্ঠান, আঞ্চলিক ও দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে ন্যায় ও সত্যের সামষ্টিক স্বার্থকেই ঊর্ধ্বে রাখা উচ্চ মূল্যবোধের সর্বজনীন প্রমাণ। আমাদের এখন সব ক্ষেত্রেই অবক্ষয় সর্বগ্রাসী রূপ লাভ করেছে। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়- সব পর্যায়েই এর পরিসর বিস্তৃত। অবক্ষয় আমাদের দেশে এখন প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে তা বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহ থেকেই প্রমাণিত। সম্প্রতি সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, গুপ্তহত্যা, গুম ও অপহরণ বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। মূল্যবোধের অনুপস্থিতি ও অবক্ষয়ের ব্যাপক বিস্তৃতির কারণেই এ ধরনের অপরাধ এখন ক্রমবর্ধমান। এ জন্য দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিচ্যুতিকেই অনেকে দায়ী করেন। সেই সঙ্গে অনৈতিক নির্বাচনী কার্যক্রম মূল্যবোধের অবক্ষয়কে আরও নিম্নমুখী করেছে। মূল্যবোধ ও ন্যায্যতার মজবুত ভিত্তি এবং রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ আচরণ কল্যাণের রাজনীতি নিশ্চিত করে। রাজনীতিবিদদের যদি মূল্যবোধের স্তর নিম্নমানের হয় তবে তা অপরাজনীতি হিসেবে বিবেচিত, যার কুপ্রভাবে পুরো জাতির মূল্যবোধ বিনষ্ট হয়। ব্যক্তির মূল্যবোধ নষ্ট হলে ক্ষতি শুধু একজনের কিন্তু শাসকশ্রেণির মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। শ্রুতি আছে, ‘রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট প্রজা কষ্ট পায়।’
রাজনীতিতে কলুষতা থাকতে পারে। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা স্বার্থপর, শঠ, চতুর, কুটিল, খল, চরিত্রহীন, সন্ত্রাসী, মিথ্যাবাদী, ধুরন্দর, দুর্নীতিবাজ, অপরাধপ্রবণ ইত্যাদি নানাবিদ নেতিবাচক চরিত্রের থাকতে পারে, তাতে কোনো সমস্যা নেই। কারণ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এসব নেতিবাচক রাজনীতিকে জনগণ সব সময় প্রত্যাখ্যান করে। সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনে খারাপ চরিত্রের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা কখনোই পার পায় না। তা ছাড়া উচ্চ মূল্যবোধসম্পন্ন সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ, বিচারব্যবস্থা সব সময়ই দুর্বৃত্ত ও ভ্রষ্ট রাজনীতিবিদদের আইনের বেড়াজালে আটকে রাখে। ফলে মূল্যবোধ বিবর্জিত রাজনীতিবিদরা কখনোই হালে পানি পায় না। কিন্তু সমস্যা হয় যখন রাষ্ট্রের সামরিক, বেসামরিক, আমলা, প্রশাসন, প্রশাসনের ওপরের স্তর, পুলিশ, বিচার বিভাগ, শিক্ষক, বিভিন্ন পেশাজীবী নিজেদের ব্যক্তিগত ও কায়েমি স্বার্থে মূল্যবোধের সঙ্গে আপস করে তখন তাবৎ জনগণের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। দেশে অনাচার, অবিচার, ভ্রষ্ট রাজনীতি ও দুর্বৃত্তায়ন সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করে। যুক্তির চেয়ে পেশি বেশি প্রাধান্য পায়। অপরাজনীতি সমগ্র জাতির ওপর চেপে বসে। তখন স্বাভাবিক ও নিয়মতান্ত্রিক পথে জাতির কোনো সমস্যার সমাধানের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। ষড়যন্ত্র, অস্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনা, কর্মযজ্ঞ মানুষের স্বাভাবিক ও শান্তিময় ভাবনাগুলোকে এক অসহায় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। তখন অস্বাভাবিক পরিণতিও মানুষ মেনে নিতে বাধ্য হয়, যার প্রচুর প্রমাণ ইতিহাসের পাতা উল্টালেই পাওয়া যায়। এরকম অস্বাভাবিক পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে অতিপ্রিয় আপনজনের বিয়োগেও বাকশূন্য হয়ে থাকতে হয়। এমনকি প্রতিবাদের ভাষা ও ক্ষমতাও স্থবির হয়ে যায়।
মূল্যবোধের পাশাপাশি আমাদের প্রয়োজন দেশপ্রেম জাগ্রত রাখা। দেশপ্রেম হচ্ছে একজন ব্যক্তি বা একটি জনগোষ্ঠী কর্তৃক মাতৃভূমির প্রতি এক ধরনের আবেগপূর্ণ অনুরাগ বা ভালোবাসা। আর দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ পরস্পর সম্পৃক্ত হওয়ায় এটাকে জাতীয় অনুভূতি কিংবা জাতীয় অহংকারও বলা যেতে পারে। নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসা ও গভীর শ্রদ্ধা দেখানোই হচ্ছে দেশপ্রেম। স্বদেশপ্রীতি মানুষের মধ্যে জন্ম দেয় মহৎ হওয়ার গুণাবলি। ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে- দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ। প্রতিটি মানুষ জন্ম নেয় পৃথিবীর একটা নির্দিষ্ট ভূখন্ডে যা তার কাছে স্বদেশ। এ স্বদেশের সঙ্গেই গড়ে ওঠে তার নাড়ির সম্পর্ক। মানুষের জীবনে দেশপ্রেম এক মহৎ চেতনা। এটি মানুষকে স্বার্থপরতা, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীগত সংকীর্ণতা, রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভেদাভেদ থেকে ঊর্ধ্বে উঠতে সহায়তা করে। উদ্বুদ্ধ করে দেশের কল্যাণে স্বার্থ ত্যাগ করে আত্মনিবেদন করতে। তাই ক্ষমতার লোভ ও দলীয় স্বার্থচিন্তা কখনো সত্যিকার দেশপ্রেম হতে পারে না। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। একুশ শতকের পৃথিবীতে বিশ্বসভায় মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য আজ দরকার দেশ গঠনের কাজে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করা। এ জন্য আজ চাই সমৃদ্ধ দেশ গঠনের লক্ষ্যে জাতীয় জাগরণ। তাহলেই দেশ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারায় অগ্রসর হতে পারবে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের লাখ লাখ ছেলেমেয়ে দেশের আর্থিক উন্নতির জন্য পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান, স্বামী, পরিবার, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন পরিত্যাগ করে কঠিন মরুভূমি ও দুর্গম পাহাড়-জঙ্গলে পড়ে আছে। জীবন বাজি রেখে, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে তারা দেশের উন্নতির জন্য বিদেশবিভুঁইয়ে পড়ে আছে। ফেসবুকে প্রতিনিয়ত দেখা যায় তাদের বুকফাটা কান্নার চিত্র। আমাদের কিছু রাজনৈতিক নেতার একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েমের বাসনা এবং সামরিক, বেসামরিক, আমলা, প্রশাসন, প্রশাসনের ওপরের স্তর, পুলিশ, বিচার বিভাগ, শিক্ষক, বিভিন্ন পেশাজীবী নিজেদের ব্যক্তিগত ও কায়েমি স্বার্থে মূল্যবোধের সঙ্গে আপস করে তখন তাদের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হয় তা শুধু বিস্ফোরণের অপেক্ষা মাত্র। আটকে যাওয়া গ্যাস যেমন আচমকা বিস্ফোরিত হয়ে সবাইকে হতচকিত করে দেয়, তেমনি একদিন হয়তো এ খেটে খাওয়া মানুষগুলো তাদের চরম বঞ্চনার প্রতিবাদে ফেটেও পড়তে পারে।
আজকে আমরা ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে যাচ্ছি। অতীত সরকার কী করেছিল সেগুলো বিবেচনার চেয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যারাই আমাদের সঙ্গে কোরাস গাইতে অনীহা প্রকাশ করে তাদের আমরা দাবিয়ে দিতে চাই। যারাই আমাদের কাজে ভুল দেখে আমরা তাদেরই শত্রু মনে করি। আমরা একবারও ভাবতে চাই না যে দেশটা আমাদের সবার। এখানে একজন বা একটি পক্ষকেই বাঁচলে হবে না, আমাদের সবাইকে বাঁচতে হবে। আমি যদি কারও বাঁচার পথে অন্তরায় হই তাহলে আমার কাজের প্রতিবাদ করা তার অধিকার। আমার ব্যর্থতা বা ভুল কর্মের জন্য আমিই দায়ী। এ জন্য আমাকে যে দায়ী করবে সে কখনোই দায়ী হতে পারে না। আমার বা আমাদের সামষ্টিক ব্যর্থতা কেউ তুলে ধরলে আমি বা আমরা, আমার বা আমাদের রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক ক্ষমতা যদি সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করি তাহলে হবে চরম বিশ্বাস ভঙ্গতা ও অতি নিম্নমানের মূল্যবোধের বহির্প্রকাশ।
মূল্যবোধ মানুষকে শিক্ষা দেয় সততা, ন্যায়পরায়ণতা, ন্যায়-অন্যায়বোধ ও সর্বোপরি নৈতিকতা। এমনকি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অভাব এবং দেশপ্রেম না থাকার কারণে আমরা অনেকেই নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ি। আজকে আমরা ক্ষমতার লোভে নিজেদের পশুত্বকে জাগিয়ে তুলছি বিভিন্ন ছল-চাতুরীতে। প্রমাণ করে দিচ্ছি বিখ্যাত ইংরেজ কবি ও ঔপন্যাসিক উইলিয়াম গোল্ডিংয়ের বিখ্যাত উক্তি- ‘মানুষের আদিমতা ও হিংস্রতা সহজাত যা সে রকম বুনো পরিবেশ পেলে মানুষ তার সভ্যতার লেবাস খুলে হিংস্র হয়ে ওঠে’। আমরা এখন নিজেকে সবকিছুর ওপরে ভাবতে খুব বেশি ভালোবাসি। আমরা বিশেষ করে সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপরের কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের সবকিছুর ঊর্ধ্বে মনে করি। কেউ আমাদের ভুল দেখাতে গেলে চরমভাবে ক্ষেপে যাই। আমাদের মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও দেশপ্রেমের অভাবে আমাদের মধ্যে চরম অসহিষ্ণুতা বিরাজ করছে, যার ফলে আমাদের চারপাশের কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। আমরা আমাদের চারপাশে কঠিন নিরাপত্তার বলয় তৈরি করে নিজেদের বানানো এক ধরনের কারাগারের ভিতর বন্দি করে নিজেদের চিরঞ্জীব করার চেষ্টা করছি, যার ফলে আমাদের চারপাশে মূল্যবোধহীন, নৈতিকতা বিবর্জিত ও দেশপ্রেমশূন্য এক দানব সৃষ্টি করে ফেলেছি, যারা রাষ্ট্রের ও সরকারের তথাকথিত নিরাপত্তার নামে আমাদের সব অর্জন তথা স্বাধীনতার চেতনা, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, নীতি-নৈতিকতা, মানবতা, পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার নিশ্চয়তা সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে, যা ফিরিয়ে আনতে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন পড়বে।
আজকে মূল্যবোধ, নৈতিক শিক্ষা ও দেশপ্রেমের অভাবে আমাদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের ব্যাপক অবক্ষয় শুরু হয়েছে। চারদিকে প্রবল হয়ে উঠেছে একে অন্যকে ঠকানোর বা দাবানোর নগ্ন প্রতিযোগিতা। আমরা যেন যে কোনোভাবে নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য রীতিমতো পাগল হয়ে ছুটছি। প্রতিটি লিঙ্গের মানুষ নিষ্পাপ হয়ে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়। তারপরে শুরু হয় শিক্ষা, যা প্রতিটি মানুষকে তার লক্ষ্যে নিয়ে যায়। প্রতিটি মানুষের কর্মক্ষমতা ও যোগ্যতা অর্জনের জন্য যেমন যথাযথ শিক্ষার প্রয়োজন তেমনি মানুষ তার নিজের সম্মান বৃদ্ধি, বিশ্বাসযোগ্যতা ও পারস্পরিক আস্থা অর্জনের জন্য প্রয়োজন নৈতিকতা শিক্ষার যা উচ্চমূল্যবোধ ও শক্তিশালী দেশপ্রেম গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি সহায়ক হবে। কিন্তু আজকে মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষার অভাবে আমাদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের ব্যাপক অবক্ষয় শুরু হয়েছে। ফলে আমরা আজ মিথ্যাচার, আদর্শহীনতা, উচ্ছৃঙ্খলতা, ঘুষ, জালিয়াতি, রাহাজানি প্রভৃতি সমাজবিরোধী কার্যকলাপে নিমজ্জিত হতে কোনো লজ্জাবোধ করি না বা বিব্রত হই না। কিন্তু এতে যে সমাজ ও রাষ্ট্র তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে তা অনুধাবন করতেও আমরা চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছি। শিক্ষা বলতে এখন আমরা বুঝি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া এবং ব্যক্তিগত উন্নতি বলতে বুঝি অঢেল সম্পদ অর্জন ও নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করা। ফলে শিক্ষার মধ্যে কেউ খুঁজে পায় না কোনো মহত্তর জীবন ও আদর্শবোধ। সবাই ভুলে গেছে যে শুধু সম্পদ ও প্রতিপত্তি কখনো মানুষের জীবনে সুখ এনে দিতে পারে না। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ মানুষের জীবনের অমূল্য সম্পদ এবং নিখাদ দেশপ্রেম সবচেয়ে বড় শক্তি, যার প্রতিপত্তির সামনে কোনো অপশক্তিই টিকে থাকতে পারে না। আমরা আজকে ভুলে যেতে বসেছি যে, মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই মানুষের জীবনের চরম শিক্ষা।
আমাদের এ অবস্থা থেকে অবশ্যই উত্তরণ হবে। হতেই হবে। না হলে রাষ্ট্র টিকবে না। তবে এর জন্য আমাদের চরম মূল্য দিতে হবে যদি না আমরা নিজেদের থেকে ইতিবাচক পদক্ষেপ সময় মতো নিতে ব্যর্থ হই। প্রকৃতি বড় নির্মম। সময় সবকিছুর সমাধান দিয়ে দেয়। আমি আশাবাদী উচ্চ মূল্যবোধ, নৈতিকভাবে আপসহীন এক লড়াকু দেশপ্রেমিক শক্তির আগমন হবেই হবে যারা নতুন সমীকরণ টানবে। পৃথিবীর ইতিহাস তাই বলে। আমি বা আমরা কেউ-ই শেষ ব্যক্তি নই এবং আমরা কেউ অবিনশ্বর বা চিরঞ্জীবও নই। নিষ্ঠুর প্রকৃতিই পরিবর্তন ঘটাবে, যা ঠেকানোর ক্ষমতা এখন পর্যন্ত কারও হয়নি। তাই পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য