মঙ্গলবার, ৪ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে

আলম রায়হান

বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে

সেনা উপদ্রুত পাকিস্তানে জেনারেল জিয়াউল হক রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর একটি গল্প বেশ চাউর হয়েছিল। আলোচিত ছিল এ গল্পটির বাইরেও জিয়াউল হককে কেন্দ্র করে আরও দুটি ঘটনা বেশ আলোচিত। এক. জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসি দেওয়া এবং দুই. রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ তাঁর ভবলীলা সাঙ্গ হওয়া। অনেকেই বলেন, জুলফিকার আলী ভুট্টোকে হত্যা করার বিনিময়ে প্রতিশ্রুত প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করার জন্যই বিমান দুর্ঘটনার ছদ্মাবরণে জেনারেল জিয়াউল হককে হত্যা করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন শক্তিকেন্দ্র একজোট হয়েছিল। এটি বিশ্বরাজনীতির জটিল প্রসঙ্গ। গল্পের প্রসঙ্গে আসি।

গল্পটি এরকম : জেনারেল জিয়াউল রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের এক সপ্তাহের মধ্যে কাকডাকা এক ভোরে বিভিন্ন পেশা এবং শ্রেণির লোক এবং প্রাণীকুল দলে দলে আসতে শুরু করল। তারা দায়িত্ব থেকে অবসর চাইল। কেউ আবার ছাড়তে চাইল দেশ। তাদের বক্তব্য হলো, যেখানে জিয়াউল হকের মতো সর্বকর্মা জেনারেল আছে সেখানে অন্য আর কারও প্রয়োজন হয় না। তিনি তো একলাই সব সামলাচ্ছেন! প্রথমদিকে বিষয়টি জেনারেল জিয়াউল হকের খুব ভালো লাগল। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মেজাজও চড়তে থাকল জেনারেলের। তবুও শান্ত থাকার চেষ্টা করলেন। কিন্তু শেষ বিকালে যখন একটি গাধা এলো তখন আর মেজাজ ধরে রাখতে পারলেন না সদ্য গদিসীন জেনারেল। রেগে গিয়ে বললেন, ‘কী হে গর্ধব তুমি কেন?’ গাধা খুবই বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘আপনিই তো আছেন মি. জেনারেল, তা হলে আমার আর কী দরকার!’ বহু বছর পর সেই গল্পের কথা মনে পড়ল ২৮ মার্চ। ওইদিন বিকালে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে মাঠে নামেন চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদ। বিকাল ৩টার দিকে রাজধানীর বেইলি রোডে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের তদারকি দলের মধ্যমণি ছিলেন তিনি। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের তদারকি দলে চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদের এ অংশ নেওয়ায় বিষয়টিকে তামাশা হিসেবে দেখছেন অনেকে। এর সঙ্গে আমার মনে পড়েছে জেনালের জিয়াউল হককেন্দ্রিক গল্পটি। এ গল্পটি এর আগেও একাধিকবার মনে পড়েছে বিভিন্ন সময়ে। বিশেষ করে পলিথিন বন্ধের নামে বিএনপি সরকারের পরিবেশমন্ত্রী সাবেক জাসদ নেতা শাজাহান সিরাজ কাঁচাবাজারে গিয়ে যখন দোকানদারের সঙ্গে প্রায় হাতাহাতি করেছেন। অবশ্য সেই তামাশাও এবার ফিকে হয়ে গেছে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ফেরদৌসকে মাঠে নামানোর তামাশায়। পাশাপাশি দেখা দিয়েছে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন।

প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে, ফেরদৌস কেন এই কাজ করবেন? সিনেমায় কাজ না থাকলে নাচ-গান-কৌতুক এবং ফ্যাশন শোর বিচারকের দায়িত্ব পালনে তিনি উপযুক্ত। করছেনও তাই। নির্বাচনী প্রচারণায়ও অংশ নিয়েছেন। এও মানা যায়। কারণ আকালের যুগে ডাক্তারের কাজ মোক্তারে করলে বলার তেমন কিছু থাকে না। বাস্তব কারণেই কাজের চাপ না থাকায় রুপালি পর্দার মানব-মানবীরা প্রথমে মঞ্চে এবং পরে রাস্তাঘাটে বিনোদন ছড়ায়। কেউ আবার শুরু থেকেই বিনোদন ছড়ায় ঘরের আঁধারেও। এদের পুরো বিষয়টিই এক ধরনের বিনোদন হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের চাপে মানুষের যখন নাভিশ্বাস উঠেছে তখন এই ছ্যাবলামির অর্থ কী? এই বিনোদন কি মানুষ গ্রহণ করবে? এ প্রশ্নে কোনো সরল উত্তর হয় না। তবে মোটামুটি একটি ধারণা করা যায়। আর এই ধারণার কোনো সীমা-পরিসীমা থাকার কথা নয়। এমনকি এ নিয়ে মতান্তরও হতে পারে। কিন্তু সবাই একমত হবেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ে ভোক্তার সঙ্গে লাগাতার তামাশা চলছে। আর চলমান এই তামাশায় এবারের সংযোজন চিত্রনায়ক ফেরদৌস। কিন্তু এই কান্ডে ভোক্তা অধিকারের নামে সরকারি সংস্থাটি যে কোথায় নেমেছে তার প্রমাণ হাতেহাতে পাওয়া গেল দুই দিনের মাথায় ৩০ মার্চ রাজধানীর প্রসাধনীর পাইকারি বাজারে। ধাওয়া খেয়ে পালিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের লোকজন। এ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সংস্থার তামাশার বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত জনক্ষোভের কিঞ্চিৎ প্রকাশ। এরপর হয়তো ধোলাইও খেতে হতে পারে। কারোরই অজানা নয়, সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি মানুষের জন্য প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিংহভাগ মানুষ দিন আনে দিন খায়। এ ক্ষেত্রে খাদ্যপুষ্টির বিষয়টি অনেক দূরের বিষয়। পেটে কিছু পড়লেই হলো। এই যখন অবস্থা, তখন নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির ফলে মানুষের জীবনধারণ দিনকে দিন কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে। যে হারে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে তুলনায় মানুষের আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে না।

ফলে লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কারণে চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জাঁতাকলে পিষ্ট দিনমজুর-শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা খুবই শোচনীয়। পরিস্থিতি যে দিকে ধাবিত হচ্ছে তাতে এক সময় হয়তো ‘পেটে পাথর বাঁধার’ প্রবচন বাস্তবে ধরা দেবে!

এ বিষয়ে গত ২৯ মার্চ গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) প্রকাশিত এক জরিপকে বিবেচনা করা যেতে পারে। এ জরিপে বলা হয়েছে, গত ছয় মাসে নিম্নআয়ের পরিবারপ্রতি ব্যয় ১৩ দশমিক ১ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু এ সময় তাদের আয় বাড়েনি। মূল্যস্ফীতির চাপে প্রায় ৭৪ শতাংশ নিম্নআয়ের পরিবার ধার করে চলছে। জরিপে বলা হয়েছে, পরিবারের ব্যয় বাড়ার এই হিসাবে গ্রাম এলাকায় বেড়েছে ১২ দশমিক ৪ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ। বেড়ে যাওয়া খরচের প্রভাবে নিম্নআয়ের মানুষের বিভিন্নভাবে সামঞ্জস্য করতে হচ্ছে। এ সময় খাদ্যে খরচ বেড়েছে ১৭ দশমিক ২ শতাংশ। এ ছাড়া শহর অঞ্চলে এ খরচ বেড়েছে ১৯ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলে বেড়েছে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ।

এ অবস্থায় নিত্যপণ্যের দাম জনগণের আওতার মধ্যে রাখা জরুরি ছিল। মানুষের আয়ের ধারাবাহিক বৃদ্ধির পরিমাণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যের পরিমাণ স্থিতিশীল ও সাধারণ মানুষের সামর্থ্যরে মধ্যে রাখার বিষয়টি ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু এর প্রতিফলন দৃশ্যমান নয়। অনুভব করাও যাচ্ছে না। বরং চলছে নানান ধরনের কথামালা এবং তামাশা।

এদিকে দ্রব্যমূল্য নিয়ে কথামালা এবং তামাশায় আমাদের মান্যবর বাণিজ্যমন্ত্রী বেশ অগ্রগামী বলে মনে হচ্ছে। কখনো কখনো মনে হয় তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চেয়েও এক ডিগ্রি সরেস। যেমন, গত ১৪ মার্চ রমজানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মানসিকতা বদলানোর জ্ঞান বিতরণ করলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। শুধু অসাধু ব্যবসায়ী নয়, একেবারে বেশি কেনাকে রোজার মাসে দ্রব্যমূল্য বাড়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, রোজা এলেই সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এটা দ্রব্যমূল্য বাড়ার অনেক বড় একটা কারণ। এতে বাজারে চাহিদা বাড়ে, আর এই সুযোগটা নেন ব্যবসায়ীরা। তাই সবাই ধৈর্য ধরে বাজার করার নসিয়তও করেছেন টিপু মুনশি। এরপর ১৯ মার্চ বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে ভয় পাওয়ার কারণ নেই। তিনি আরও বলেন, রমজানে জিনিসপত্রের দাম সহনীয় রাখতে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে। এর আগে ২৩ জানুয়ারি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে বলেছেন, রমজানে সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর চেষ্টা করলে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর মাঠে থাকবে। অবশ্য ১৭ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারের কিছুই করার নেই। বাণিজ্যমন্ত্রীর এই কথার পর তো আর বলা যায় না, ‘কাজ নাই তো খই ভাজ!’ একে তো মন্ত্রী বলে কথা।

দ্রব্যমূল্য নিয়ে আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি লাগাতারভাবে যেসব কথা বলে যাচ্ছেন তা যে মানুষকে কতটা বিরক্ত করে তা হয়তো তিনি জানেন না। কারণ আমাদের দেশে বাস্তবতায় মন্ত্রীদের ঘিরে নানান রকমের বলয় ও খোলস সৃষ্টি হয়। যা ভেদ করে বাস্তবতা অনুধাবনে যে প্রজ্ঞা থাকা উচিত তা কতজন মন্ত্রীর আছে সেটি গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার গবেষণায় হয়তো দেখা যাবে, মেধা-মননে আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী বেশ অগ্রগামী। যে কারণে তিনি সাবেক জেনারেল এরশাদের মতো একেক সময় একেক ধরনের কথা বলেন। যাতে দ্রব্যমূল্য প্রসঙ্গে সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে মানুষ নিজের কপালে হাত দিয়ে আসমানের দিকে তাকিয়ে থাকে। সাধারণত নিরুপায় হলে মানুষ যা করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়- আকাশের দিকে তাকাইয়া আকাশের মতোই নীরব হয়ে থাকা মানুষকে কবি বলা যায় না। মানে এই তাকিয়ে থাকার কোনো প্রভাব নেই। কিন্তু দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষ নীরবে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা শুরু করলে মোটেই তুচ্ছ কোনো ঘটনা হবে না। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন যখন সমাগত।

                লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর