শুক্রবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা

মেজর আখতার (অব.)

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা

সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে। অনেকে রাষ্ট্রপতিকে রাজনৈতিক সংকটের নামে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ বা বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষের মধ্যে মোড়লিপনা করার জন্য এক ধরনের উসকানি দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু এগুলো করার আদৌ কোনো সাংবিধানিক বা আইনগত ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির আছে কি না তা কেউ তলিয়ে দেখছে না বা না দেখে পরিবেশ ঘোলাটে করার চেষ্টা করছে। তাহলে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনার শুরুতেই দেখা যাক সংবিধান কী বলে। সংবিধানের চতুর্থ ভাগের প্রথম অনুচ্ছেদের ৪৮ ধারার (১) উপধারায় বলা হয়েছে ‘‘৪৮। (১) বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকিবেন, যিনি আইন অনুযায়ী সংসদ-সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত হইবেন’’। খুবই স্পষ্ট ও পরিষ্কার বিধান। বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকিবেন এবং নিঃসন্দেহে আমাদের একজন রাষ্ট্রপতি বহাল তবিয়তে আছেন। এখানে কোনো শূন্যতা নেই। তারপর বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি আইন অনুযায়ী সংসদ-সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত হইবেন। বর্তমান রাষ্ট্রপতির নির্বাচন নিয়েও কোনো জটিলতা নেই। তিনি যথারীতি সংসদ সদস্যগণ কর্তৃক আইন অনুযায়ী নির্বাচিত হয়েছেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে একের অধিক প্রার্থী না থাকায় ভোট দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি, যা নির্বাচিত হওয়ার জন্য আইনগত বাধা বা জটিলতা সৃষ্টি হয়নি। কাজেই বর্তমান রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৪৮(১) অনুচ্ছেদ অনুয়ায়ী একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি যা নিয়ে কারও আপত্তির সুযোগ নেই।

এবার দেখা যাক সংবিধান এর পরে কী বলে। সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের (২) উপধারায় বলছে : ‘‘(২) রাষ্ট্রপ্রধানরূপে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সকল ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করিবেন এবং এই সংবিধান ও অন্য কোন আইনের দ্বারা তাঁহাকে প্রদত্ত ও তাঁহার উপর অর্পিত সকল ক্ষমতা প্রয়োগ ও কর্তব্য পালন করিবেন’’। এই উপচ্ছেদে তিনটি অংশ দেখা যাচ্ছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি ‘‘রাষ্ট্রপ্রধানরূপে’’ রাষ্ট্রের অন্য সকল ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করিবেন। এখানে খুবই গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, রাষ্ট্রপতিকে কোনো প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃত্ব হিসেবে নয়, ‘‘রাষ্ট্রপ্রধানরূপে’’ একজন ব্যক্তি হিসেবে রাষ্ট্রের অন্য সব ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছে। এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, রাষ্ট্রের ব্যক্তির ক্রমানুসারে রাষ্ট্রপতির নাম এক নম্বরে তালিকাভুক্ত হবে অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের এক নম্বর কর্তৃপক্ষও নন এবং এক নম্বর হিসেবে কর্তৃত্ব করারও সাংবিধানিক ও আইনগত কোনো অধিকার নেই। একই উপচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে, ‘‘এবং এই সংবিধান ও অন্য কোন আইনের দ্বারা তাঁহাকে প্রদত্ত ও তাঁহার উপর অর্পিত সকল ক্ষমতা প্রয়োগ ও কর্তব্য পালন করিবে’’। এখানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব আরও পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির ওপরে কোনো ক্ষমতা প্রদত্ত ও অর্পিত না হলে রাষ্ট্রপতি কোনো ক্ষমতা প্রয়োগও করতে পারবেন না এবং কর্তব্যও পালন করতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতির ওপর কোনো ক্ষমতা বা কর্তব্য প্রদত্ত ও অর্পিত না হলে রাষ্ট্রপতির স্বাধীনভাবে কিছু করার আইনগত কোনো ক্ষমতা নেই। রাষ্ট্রপতি শপথ নিয়েছেন তার প্রথমটি হলো ‘‘আমি আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদের কর্তব্য বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব’’। কাজেই রাষ্ট্রপতির যে কোনো ধরনের স্বাধীন মতামত ও নড়াচড়া অবশ্যই তাঁর গৃহীত শপথ ভঙ্গ হিসেবে গণ্য হতে পারে। এখন প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, তাহলে কি রাষ্ট্রপতির কোনো ক্ষমতা নেই। আছে এবং অবশ্যই আছে। রাষ্ট্রপতির অফুরন্ত ক্ষমতা। তবে তা প্রদত্ত ও অর্পিত হতে হবে। রাষ্ট্রপতিকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের (৩) উপ-অনুচ্ছেদে। ওই উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘‘(৩) এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন; তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোন পরামর্শদান করিয়াছেন কি না এবং করিয়া থাকিলে কী পরামর্শ দান করিয়াছেন, কোন আদালত সেই সম্পর্কে কোন প্রশ্নের তদন্ত করিতে পারিবেন না’’। কাজেই রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ে বা কর্তব্য পালন নিয়ে কারও কোনো দ্বিধা থাকা সমীচীন নয়। রাষ্ট্রে কখনোই দ্বৈত ক্ষমতার সুযোগ থাকা কোনো রাষ্ট্রের জন্যই নিরাপদ নয়। পৃথিবীতে বর্তমানে মূলত দুই ধরনের শাসন ব্যবস্থা আছে। যার একটি হলো সংসদীয় পদ্ধতি এবং অন্যটি প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি। ভাবগতভাবে রাষ্ট্রপতি বা প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি এক মনে হলেও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে যোজন পরিমাণ পার্থক্য রয়েছে যা অন্য সময় আলোচনা করা যাবে। তবে আমরা নীতিগতভাবে সংসদীয় পদ্ধতি কায়েম করেছি, যদিও এ নিয়ে প্রচুর মতভেদ রয়েছে। অনেকে বর্তমান শাসন ব্যবস্থাকে প্রধানমন্ত্রীর একক কর্তৃত্বের শাসন হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু এর সাংবিধানিক বা আইনগত ভিত্তি নেই। সংবিধান মোতাবেক আমাদের শাসন ব্যবস্থা সংসদীয়। আমাদের সংবিধানের প্রথম ভাগে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্র এবং একই ভাগের ৭ অনুচ্ছেদের (১) ও (২) উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : ‘‘৭। (১) প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে। (২) জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে’’। কাজেই বাংলাদেশ একটি প্রজাতন্ত্র, যার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সব ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্ব কার্যকর হবে। একই সঙ্গে (২) উপ-অনুচ্ছেদে পরিষ্কার করে বলে দেওয়া হয়েছে সংবিধানের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য দিয়ে। কাজেই সংবিধানকে বিবেচনায় না নিয়ে যদি কেউ তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চায় তাহলে সংবিধান তার প্রয়োজনীয় বিধি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সংবিধান পরিষ্কার করে বলে দিয়েছে, জনগণের পক্ষে ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল সংবিধান অনুযায়ীই হতে হবে। সংবিধানের পঞ্চম ভাগে আইনসভা প্রতিষ্ঠা করে প্রথম পরিচ্ছেদ সংসদ গঠন করে ৬৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : ‘‘সংসদ-প্রতিষ্ঠা ৬৫। (১) ‘জাতীয় সংসদ’ নামে বাংলাদেশের একটি সংসদ থাকিবে এবং এই সংবিধানের বিধানাবলি-সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়ন-ক্ষমতা সংসদের উপর ন্যস্ত হইবে’’। দেশের শাসন পরিচালনা তথা জনস্বার্থে আইনগত ক্ষমতা প্রয়োগ করার জন্য জনগণের চরম অভিপ্রায় সংবিধান সংসদ গঠন করে দিয়েছে যারা জনগণের আইন তৈরি করে দেবে যাতে কেউ আইনের বাইরে কোনো কাজ করতে না পারে। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জনগণের চরম অভিপ্রায় হিসেবে সংবিধানের সপ্তম ভাগে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কারণ সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে পরিষ্কারভাবে বলে দেওয়া হয়েছে : ‘‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ১১। প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে’’। একইভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সংবিধানের চতুর্থ ভাগে নির্বাহী বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা গঠন করে দিয়ে ৫৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “মন্ত্রিসভা ৫৫। (১) প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি মন্ত্রিসভা থাকিবে এবং প্রধানমন্ত্রী ও সময়ে সময়ে তিনি যেরূপ স্থির করিবেন, সেইরূপ অন্যান্য মন্ত্রী লইয়া এই মন্ত্রিসভা গঠিত হইবে। জনগণের চরম অভিপ্রায়রূপে সংবিধানের (২) উপ-অনুচ্ছেদে ‘‘প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাঁহার কর্তৃত্বে এই সংবিধান-অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে’’ বলে নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছে। তবে উপ-অনুচ্ছেদ (৩) প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ তথা “মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকিবেন” বলে সুস্পষ্ট বিধান করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া (৪), (৫) ও (৬) উপচ্ছেদে বিধান করে দেওয়া হয়েছে যে, “(৪) সরকারের সকল নির্বাহী ব্যবস্থা রাষ্ট্রপতির নামে গৃহীত হইয়াছে বলিয়া প্রকাশ করা হইবে, (৫) রাষ্ট্রপতির নামে প্রণীত আদেশসমূহ ও অন্যান্য চুক্তিপত্র কিরূপে সত্যায়িত বা প্রমাণীকৃত হইবে, রাষ্ট্রপতি তাহা বিধিসমূহ-দ্বারা নির্ধারণ করিবেন এবং অনুরূপভাবে সত্যায়িত বা প্রমাণীকৃত কোন আদেশ বা চুক্তিপত্র যথাযথভাবে প্রণীত বা সম্পাদিত হয় নাই বলিয়া তাহার বৈধতা সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না ও (৬) রাষ্ট্রপতি সরকারি কার্যাবলি বণ্টন ও পরিচালনার জন্য বিধিসমূহ প্রণয়ন করিবেন।’’

আমাদের শাসন ব্যবস্থায় কোনো শূন্যতা নেই। সবকিছু পরিষ্কার করে বলে দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতাও কারও কাছে কুক্ষিগত হয়নি। সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা হিসেবে আমাদের সংবিধান খুবই সুস্পষ্ট এবং পরিষ্কার। কিন্তু সমস্যা হলো, আমাদের সংসদের মান এবং নির্বাচনের দুর্বলতা। সংসদে যোগ্যদের আসার সুযোগে যেমন চরম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে, তেমনি নির্বাচনও সঠিক হওয়ার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছি না। রাজনীতিতে নীতি ও নৈতিকতা না থাকায় দলীয় রাজনীতিতে মাফিয়াতন্ত্র কায়েম হচ্ছে। দলগুলোতে গণতন্ত্র না থাকায় প্রায় প্রতিটি দলই আদর্শহীন হয়ে ব্যক্তির কাছে জিম্মি হয়ে যাচ্ছে। এর পুরো সুযোগ নিচ্ছে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, বাজার অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়ন, অতি-দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা, কলুষিত মিডিয়া, অতিমাত্রার ধর্মীয় চেতনা ও ধর্মভিত্তিক ভ্রান্ত-রাজনীতি এবং সর্বোপরি আন্তর্জাতিক অপ-রাজনীতি ও আধিপত্যবাদের নগ্ন প্রতিযোগিতা। এ থেকে মুক্তি হতে না পারলে সবকিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। আইনের শাসন ও নীতি-নৈতিকতার প্রাধান্যই এ অবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারে। ব্যক্তির পূজা তথা ব্যক্তি বা ধর্মের প্রাধান্য থেকে বেরিয়ে এসে মানবকল্যাণ তথা জনস্বার্থবান্ধব রাজনীতি ও প্রশাসন প্রতিষ্ঠায় দিতে হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। সবার আগে প্রয়োজন রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়নমুক্ত করা। এককেন্দ্রিক নেতৃত্ব রাজনীতির অবক্ষয়ের চূড়ান্ত কারণ। এ থেকে মুক্তি না পেলে সব অর্জন ব্যর্থ হয়ে যাবে।

                লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

সর্বশেষ খবর