বুধবার, ১৭ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুকন্যার দেশে ফেরার সেই দিন

এনামুল হক শামীম, এমপি

বঙ্গবন্ধুকন্যার দেশে ফেরার সেই দিন

স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ঘাতকরা মনে করেছিল সব শেষ হয়ে যাবে। আর কখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ চলবে না। দেশ আবার পরাজিত শক্তি পাকিস্তানের ভাবধারায় চলবে। কিন্তু তা হয়নি,  বরং বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ তা প্রমাণিত হয়েছে। জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে দেশের হাল ধরেছেন যাঁর ধমনিতে বঙ্গবন্ধুর রক্ত প্রবাহিত, যাঁর নেতৃত্বে আজ বাংলাদেশ বদলে গেছে, যাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সম্ভাবনাময় দেশ হয়েছে, তিনি আর কেউ নন, বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরি আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বাংলাদেশের সবকিছুতেই আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন। তিনি যা যা ঘোষণা করেছিলেন তার সবই একে একে বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দিয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকান্ডের পর প্রায় ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয় তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয় শেখ হাসিনা তখন তার ছোট বোন শেখ রেহানা, স্বামী ও দুই সন্তানসহ তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। ফলে প্রাণে বেঁচে যান তাঁরা। পশ্চিম জার্মানি থেকেই স্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা এবং শিশুপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও শিশুকন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং প্রাণ রক্ষার জন্য ভারত সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন প্রখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়া। সেই কঠিন সময়ে তাঁদের হাতে যথেষ্ট টাকা-পয়সা ছিল না।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে বাঙালি জাতির অস্তিত্বকে বিপন্ন করতে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু করে ঘাতক গোষ্ঠী। বাঙালি জাতির জীবনে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে ঘোর অমানিশার অন্ধকার। ঠিক এমনই ক্রান্তিলগ্নে ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁকে সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার পবিত্র দায়িত্ব অর্পণ করা হয় জাতির পিতার কন্যার হাতে। বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বকে ভয় পায় ঘাতক গোষ্ঠী। খুনি সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান শেখ হাসিনাকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করতে না দেওয়ার জন্য সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তন ঠেকানোর জন্য খুনি জিয়াউর রহমান সরকারের উদ্যোগে ‘শেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি গঠন’ করা হয়েছিল, যার আহ্বায়ক ছিলেন জিয়ার সংসদের স্পিকার মির্জা গোলাম হাফিজ। এর আগে শেখ হাসিনা দেশে ফিরছেন জানতে পেরে জিয়া সাপ্তাহিক ছুটির দিনে (তখন রবিবার) ৩ মে মন্ত্রী পরিষদের বৈঠক ডেকে সিদ্ধান্ত নেন, শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না। বৈঠক শেষে জিয়ার প্রধানমন্ত্রী রাজাকার শাহ আজিজ সাংবাদিকদের বলেন, ‘শেখ হাসিনার দেশে ফেরা নিয়ে আমরা দেশে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করছি।’ পরদিন ৪ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এস এম মোস্তাফিজুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন ‘জননিরাপত্তার স্বার্থে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না।’ এই মোস্তাফিজুর রহমান, যিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন। কিন্তু সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলায় আলোর মশাল হাতে কান্ডারি হয়ে এসেছিলেন জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ কন্যা, গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা। জননেত্রী শেখ হাসিনার দেশে ফেরার মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ পর্ব শুরু হয়। সেদিন ছিল রবিবার। ১৯৮১ সালের এ দিনে বাংলাদেশের লাখো মানুষের সঙ্গে স্কুলপড়ুয়া একজন ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য আমারও হয়েছিল। লাখো নেতা-কর্মী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তাদের ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে প্রকম্পিত করে তেজগাঁও বিমানবন্দর এলাকা। এ ছাড়া ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম পিতৃ হত্যার বদলা নেব, আমরা সবাই মুজিব হব, মুজিব হত্যার বদলা নেব’ বলেও স্লোগান দেওয়া হয়।

দেশে ফিরেই মানিক মিয়া এভিনিউয়ে আয়োজিত লাখো জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেছিলেন, ‘আমি আপনাদের মাঝে ফিরে এসেছি আপনাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’ তাঁর পিতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকান্ডের পর তিনি স্বদেশ থেকে নির্বাসিত হয়েছিলেন। তিনি, এ দেশের কোটি কোটি মানুষের মুক্তির শ্রেষ্ঠ মুখ শেখ হাসিনা, জননেত্রী শেখ হাসিনা যদি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন না করতেন তবে আজ আমরা কিছুতেই এ সমৃদ্ধির উত্তরণে এগিয়ে চলা বাংলাদেশকে পেতাম না। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে বিবিসি তার সংবাদ ভাষ্যে ১৯৮১ সালের ১২ জুন বলেছে, ‘তাঁর পিতার নৃশংসতম মৃত্যুর পর বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন নিঃসন্দেহে একটি বড় ব্যাপার। এই সাহস সম্ভবত তিনি অর্জন করেছেন তাঁর পিতার কাছ থেকে।’ কার্যত স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর শেখ হাসিনা স্বকীয় প্রতিভা গুণে এ দেশ ও জাতির মহানায়কের আদর্শকে প্রবলভাবে পুরো জাতির মনে পুনরায় জাগিয়ে তোলেন।

১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে স্রোতের বিপরীতে সেই যে উজানে নাও বাওয়া শুরু করেছিলেন জাতির জীবনে সাফল্যের পালক পরিয়েই তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। জীবনে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে কুড়িবারের বেশি। যারা স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ আর কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না, তাদের সব হিসাব-নিকাশ যেন মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে গেল। তাঁরই বলিষ্ঠ ও সাহসী নেতৃত্বগুণে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। স্বপ্ন দেখছে উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছার। অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা থেকে শুরু করে সর্বত্রই আজ উন্নয়নের জোয়ার। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। যে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল, জননেত্রী শেখ হাসিনা সেই বিশ্বব্যাংককে পদ্মা সেতুর সুভেনিয়ার (ছবি) দিয়ে প্রমাণ করেছেন আমাদের সক্ষমতা।  ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকথা এখন গল্প নয়, বাস্তব। এখন লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ।

 

 লেখক : উপমন্ত্রী, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সাবেক জাকসু ভিপি, সাবেক সভাপতি-বাংলাদেশ ছাত্রলীগ

সর্বশেষ খবর