জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে শেখ হাসিনা ৪২ বছর ধরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আছেন। এর মধ্যে ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত প্রথম এবং ২০০৯ সাল থেকে টানা চতুর্থবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১১ জানুয়ারি শপথ নিয়েছেন। তার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ নির্মাণের পথে আমরা আরেকটি ধাপ অতিক্রম করলাম। কিন্তু সামনের পথ এখনো অনেক লম্বা এবং কণ্টকাকীর্ণ। তাই এগোনোর জন্য সামনের সঙ্গে পেছনের কথাও সর্বদা স্মরণে রাখতে হবে। পঁচাত্তরের শত্রুরা এখনো সক্রিয় এবং শক্তিশালী। রাজনীতির ধ্রুপদী লক্ষ্য জনকল্যাণ সাধন। কিন্তু রাষ্ট্র ও রাজনীতি ঠিক না হলে জনকল্যাণ হয় না। সে পথে অনেক বহুমুখী ফ্যাক্টর কাজ করলেও সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর রাজনৈতিক নেতৃত্ব। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছেন, ‘ভুল করে নেতারা, আর তার খেসারত দেয় জনগণ।’ রাজনীতির শীর্ষ নেতৃত্ব সঠিক হলে উত্তাল সমুদ্র ও দুর্গম পাহাড়সম বাধা পেরিয়ে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়, যার উজ্জ্বল উদাহরণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর অসীম ত্যাগ ও নৈতিক সাহস এবং দিগন্তহীন দূরদৃষ্টির ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ২৩ বছর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের মাধ্যমে তিনি বিশাল প্রেক্ষাপট ও শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করেন, যার ওপর দাঁড়িয়ে মাত্র ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়, এমন উদাহরণ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। প্রেক্ষাপট ও ভিত্তি শক্তিশালী এবং পূর্ণ প্রস্তুতি ছিল বলে তা সম্ভব হয়েছে, যার সবকিছুই করেছেন বঙ্গবন্ধু। তাই ইতিহাসের সত্য এই, গত শতকের ষাট দশকের মধ্যভাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বে না এলে বাংলাদেশ কোনো দিন স্বাধীন হতো না। এজন্য বাংলাদেশের অপর নাম শেখ মুজিবুর রহমান। ঠিক একইভাবে ১৯৭৫ সালের পর দুই সামরিক শাসকের হাত ধরে বাংলাদেশের রাষ্ট্র রাজনীতিতে যা ঘটেছে তাতে ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা যদি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে না আসতেন, তাহলে নিশ্চিত করে বলা যায় বাংলাদেশ আজ আরেকটি পাকিস্তান, আর নয়তো আফগানিস্তানের মতো একটি রাষ্ট্র হতো। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত মূল্যবোধ ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও ৩০ লাখ মানুষের জীবন বিসর্জনের সবকিছু বহমানতা হারিয়ে ইতিহাসের কবরস্থানে চলে যেত। এসবের সামান্যতম মূল্য এ দেশে থাকত না। এই যে আবার এর সবকিছু এখন তরুণ প্রজন্মের মনের গহিনে প্রচন্ড স্রোতের মতো বহমান তার সব কৃতিত্ব শেখ হাসিনার।
.jpg) এ জগতে কোনো কিছুই একতরফা নয়, সবকিছুই তুলনামূলক। ভালোর থেকেও আরও ভালো আছে এবং খারাপের থেকেও আরও খারাপ থাকে। তাই ৪২ বছরে শেখ হাসিনার রাজনীতি থেকে বাংলাদেশের মানুষ কী পেয়েছে তার যথার্থ মূল্যায়ন করতে হলে কত বড় চ্যালেঞ্জ ও কত বড় বিপদসংকুল পরিস্থিতি তাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে সেটি প্রথমে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। প্রথমত, শেখ হাসিনা যখন নেতৃত্ব নিলেন তখন আওয়ামী লীগ বহুভাগে বিভক্ত। কেউ কেউ আবার সামরিক শাসকের লেজুড় ধরেছেন। দ্বিতীয়ত, দুই সামরিক শাসক মুক্তি-সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, ঐতিহ্য, চিন্তা-চেতনা, আদর্শ, দর্শন ইত্যাদি সবকিছুকে প্রায় কবরস্থ করে ফেলেছেন। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেওয়াটাও ছিল কঠিন কাজ। একাত্তরে পরাজিত এ দেশের জামায়াত, মুসলিম লীগসহ সবাই রাষ্ট্র ও রাজনীতির সর্বত্র জেঁকে বসেছেন। প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী, এমপিসহ এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদ নেই, যা ওই পরাজিত পাকিস্তানিপন্থিরা দখল করেনি। আর এর সবকিছুর সুযোগ করে দিয়েছেন দুই সামরিক শাসক জিয়া ও এরশাদ। দুই সামরিক শাসকের কারণে সামরিক বাহিনী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান ঠেকাতে মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলারের বদৌলতে দুই সামরিক শাসক ধর্মান্ধ উগ্রবাদীদের শুধু রাজনীতিতে এনেছেন তা নয়, কট্টর ওয়াহাবিপন্থি কওমিসহ হাজার হাজার মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাদের সবার একমাত্র মিশন শহর ও গ্রামগঞ্জে সর্বত্র সব পন্থায় এই মর্মে প্রচার চালানো যে, আওয়ামী লীগ হলো হিন্দু ভারতের দালাল এবং বাঙালি সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের সবকিছু ইসলাম ধর্মবিরোধী ও বেদাত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ইসলাম ধর্ম থাকবে না ইত্যাদি। মাদরাসার লাখ লাখ শিক্ষক-ছাত্রকে রাস্তার রাজনীতিতে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করেছেন, যার প্রত্যক্ষ উদাহরণ আমরা সে সময় থেকে দেখে আসছি এবং এখনো দেখছি। রাজনীতি চলে যায় হোল্ডা-গুন্ডা আর মানি ও মাসলের কবজায়। সুস্থ মূল্যবোধ ও সৎ মানুষের রাজনীতিকে বিদায় দিয়ে প্রথম সামরিক শাসক জিয়া ঘোষণা দেন, তিনি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দেবেন। বাস্তবে সেটাই ঘটেছে। সৎ ও মেধাবী মানুষ রাজনীতি থেকে চলে গেছেন। এটা নিয়ে এখনো আমরা আফসোস করি। স্বাধীনতা প্রাপ্তির শুরুতে বঙ্গবন্ধুর সময় বার্ষিক শতকরা ৭.৫ ভাগ প্রবৃদ্ধির বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে যে রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হয়, সেই রাষ্ট্র দুই সামরিক শাসকের জাঁতাকলে পড়ে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দরিদ্রতম সম্ভাবনাহীন দেশে পরিণত হয়। বার্ষিক প্রবৃদ্ধি নেমে আসে শতকরা ৩ ভাগে। জনকল্যাণ নয়, ধর্মীয় উন্মাদনা ও চরম সাম্প্রদায়িকতাকে অবলম্বন করে রাষ্ট্রক্ষমতাকে ধরে রাখাই হয় সামরিক শাসকদের লক্ষ্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অসামান্য ভূমিকা রাখা ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। কিন্তু বিপরীতে গণহত্যাকারী পাকিস্তানের সঙ্গে দৃষ্টিকটুভাবে দহরম-মহরম শুরু হয়ে যায়। তারপর দেশের প্রায় এক-দশমাংশ এলাকা, পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করে। ভ্রাতৃঘাতী রক্তক্ষরণে প্রতিদিনই বাংলাদেশের পবিত্র মাটি রক্তে রঞ্জিত হতে থাকে। খুবই সংক্ষিপ্তভাবে ওপরে কিছু বিষয়ের উল্লেখ করলাম, শুধু বিবেচনায় রাখার জন্য যে, কী রকম একটা ভয়াবহ অবস্থা ও পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পদার্পণ করেন বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনা। তিনি রাজনীতিতে পদার্পণ করার সঙ্গে সঙ্গে দুই সামরিক শাসক ও তাদের উত্তরসূরি এবং একাত্তরের পরাজিত ও পঁচাত্তরের পর পুনরুত্থিত গোষ্ঠীগুলো উপলব্ধি করেছে তাদের রাজনীতি আবার পরাস্ত হবে যদি শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সফল হন। তাই সংগত কারণেই ওইসব সম্মিলিত পক্ষের টার্গেটে পরিণত হন তিনি। সে কারণেই ১৯ বার তাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়, যার ভয়াবহ একটি উদাহরণ ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। বাংলাদেশে তো আরও নেতানেত্রী আছেন, অনেকেই প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। তাদের হত্যাচেষ্টার কথা তো একবারও শোনা যায় না, কারও গায়ে তো একটা টোকাও এ পর্যন্ত লাগেনি। তাই সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে কীসের জন্য এবং কারা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চায়। ২০০৪ সালে ২১ আগস্টের ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়ে গেছে ওরা কে বা কারা। আদালতে প্রমাণ হয়েছে এর সঙ্গে জড়িত বিএনপি-জামায়াত, ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। পাকিস্তানের জঙ্গি মজিদ ভাট ও আবদুল মালেক ফাঁসির দন্ড মাথায় নিয়ে এখন বাংলাদেশের কারাগারে। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করি। একটু গভীরে প্রবেশ করলে বোঝা যায় ভদ্রবেশী একশ্রেণির সুশীল, যারা নিরপেক্ষ ছদ্মবেশ ধারণ করে চললেও শেখ হাসিনার প্রচন্ড বিরোধী। দেশ গোল্লায় গেলেও তারা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। এদের বৈদেশিক কানেকশন খুবই শক্তিশালী। তবে এরকম একটি সুবিধাবাদী শ্রেণি সব যুগেই বাংলাদেশে ছিল, এখনো আছে এবং আগামীতে থাকবে। তাই এদের সম্পর্কে দেশের মানুষের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এদের চেনার একটা সহজ উপায় আছে। একটি বড় রাজনৈতিক দল জাতির পিতাকে অস্বীকার ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে অমান্য করে রাজনীতি করছে, অথচ এ সম্পর্কে সুশীল নিরপেক্ষদের কোনো বক্তব্য নেই, বরং তাদের এই অধিকার, সেই অধিকার নিয়ে খুবই সোচ্চার। তারা সুশীল ও ভদ্রলোকের ছদ্মবেশে কথার ফুলঝুরিতে দেশপ্রেমিক সাজেন। অথচ ঝড়-তুফান, সাইক্লোন-বন্যার সময় তাদের কখনই অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায় না। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বৈশ্বিক শক্তিগুলোকে খেপিয়ে তোলার জন্য তারা অসত্য তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে সভা-সেমিনার করে থাকেন এবং তার ব্যাপক প্রচার চালান। যে কোনো জাতীয় উদ্যোগ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে হতাশা ছড়ান। যেমনটি দেখা গেছে, পদ্মা সেতু নির্মাণ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময়। জঙ্গি সন্ত্রাস দমনে শেখ হাসিনার সাফল্য এখন বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। অথচ তখন তারা উঠেপড়ে প্রচার চালিয়েছেন, সভা-সেমিনার করেছেন, বিদেশি বিশেষজ্ঞ ডেকে এনে বলিয়েছেন, জঙ্গি দমন বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই বিদেশি শক্তির সাহায্য নেওয়া উচিত। এটা দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কত বড় চক্রান্ত ছিল তা ভাবলে শঙ্কিত হতে হয়। আবার ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা যখন বানের পানির মতো বাংলাদেশে ঢুকতে থাকে, তখন তারা সভা-সেমিনার করে উসকানি দিয়েছে যাতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা সামরিক সংঘর্ষ বেধে যায়। ২০০৯ সালে পিলখানার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেও একই রকম দেখেছি, একটি পক্ষ এমন উসকানি দিয়েছে যাতে দেশব্যাপী বাহিনীগুলোর মধ্যে একটা অনিয়ন্ত্রিত সংঘর্ষ বেধে যায় এবং সাধারণ মানুষের ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। রোহিঙ্গা ও পিলখানা, দুটো ঘটনাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসীম ধৈর্য ও দারুণ দূরদৃষ্টির কারণে বাংলাদেশ দুটি ভয়াবহ রক্তক্ষরণ থেকে বেঁচে যায়।
এ জগতে কোনো কিছুই একতরফা নয়, সবকিছুই তুলনামূলক। ভালোর থেকেও আরও ভালো আছে এবং খারাপের থেকেও আরও খারাপ থাকে। তাই ৪২ বছরে শেখ হাসিনার রাজনীতি থেকে বাংলাদেশের মানুষ কী পেয়েছে তার যথার্থ মূল্যায়ন করতে হলে কত বড় চ্যালেঞ্জ ও কত বড় বিপদসংকুল পরিস্থিতি তাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে সেটি প্রথমে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। প্রথমত, শেখ হাসিনা যখন নেতৃত্ব নিলেন তখন আওয়ামী লীগ বহুভাগে বিভক্ত। কেউ কেউ আবার সামরিক শাসকের লেজুড় ধরেছেন। দ্বিতীয়ত, দুই সামরিক শাসক মুক্তি-সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, ঐতিহ্য, চিন্তা-চেতনা, আদর্শ, দর্শন ইত্যাদি সবকিছুকে প্রায় কবরস্থ করে ফেলেছেন। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেওয়াটাও ছিল কঠিন কাজ। একাত্তরে পরাজিত এ দেশের জামায়াত, মুসলিম লীগসহ সবাই রাষ্ট্র ও রাজনীতির সর্বত্র জেঁকে বসেছেন। প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী, এমপিসহ এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদ নেই, যা ওই পরাজিত পাকিস্তানিপন্থিরা দখল করেনি। আর এর সবকিছুর সুযোগ করে দিয়েছেন দুই সামরিক শাসক জিয়া ও এরশাদ। দুই সামরিক শাসকের কারণে সামরিক বাহিনী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান ঠেকাতে মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলারের বদৌলতে দুই সামরিক শাসক ধর্মান্ধ উগ্রবাদীদের শুধু রাজনীতিতে এনেছেন তা নয়, কট্টর ওয়াহাবিপন্থি কওমিসহ হাজার হাজার মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাদের সবার একমাত্র মিশন শহর ও গ্রামগঞ্জে সর্বত্র সব পন্থায় এই মর্মে প্রচার চালানো যে, আওয়ামী লীগ হলো হিন্দু ভারতের দালাল এবং বাঙালি সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের সবকিছু ইসলাম ধর্মবিরোধী ও বেদাত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ইসলাম ধর্ম থাকবে না ইত্যাদি। মাদরাসার লাখ লাখ শিক্ষক-ছাত্রকে রাস্তার রাজনীতিতে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করেছেন, যার প্রত্যক্ষ উদাহরণ আমরা সে সময় থেকে দেখে আসছি এবং এখনো দেখছি। রাজনীতি চলে যায় হোল্ডা-গুন্ডা আর মানি ও মাসলের কবজায়। সুস্থ মূল্যবোধ ও সৎ মানুষের রাজনীতিকে বিদায় দিয়ে প্রথম সামরিক শাসক জিয়া ঘোষণা দেন, তিনি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দেবেন। বাস্তবে সেটাই ঘটেছে। সৎ ও মেধাবী মানুষ রাজনীতি থেকে চলে গেছেন। এটা নিয়ে এখনো আমরা আফসোস করি। স্বাধীনতা প্রাপ্তির শুরুতে বঙ্গবন্ধুর সময় বার্ষিক শতকরা ৭.৫ ভাগ প্রবৃদ্ধির বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে যে রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হয়, সেই রাষ্ট্র দুই সামরিক শাসকের জাঁতাকলে পড়ে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দরিদ্রতম সম্ভাবনাহীন দেশে পরিণত হয়। বার্ষিক প্রবৃদ্ধি নেমে আসে শতকরা ৩ ভাগে। জনকল্যাণ নয়, ধর্মীয় উন্মাদনা ও চরম সাম্প্রদায়িকতাকে অবলম্বন করে রাষ্ট্রক্ষমতাকে ধরে রাখাই হয় সামরিক শাসকদের লক্ষ্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অসামান্য ভূমিকা রাখা ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। কিন্তু বিপরীতে গণহত্যাকারী পাকিস্তানের সঙ্গে দৃষ্টিকটুভাবে দহরম-মহরম শুরু হয়ে যায়। তারপর দেশের প্রায় এক-দশমাংশ এলাকা, পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করে। ভ্রাতৃঘাতী রক্তক্ষরণে প্রতিদিনই বাংলাদেশের পবিত্র মাটি রক্তে রঞ্জিত হতে থাকে। খুবই সংক্ষিপ্তভাবে ওপরে কিছু বিষয়ের উল্লেখ করলাম, শুধু বিবেচনায় রাখার জন্য যে, কী রকম একটা ভয়াবহ অবস্থা ও পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পদার্পণ করেন বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনা। তিনি রাজনীতিতে পদার্পণ করার সঙ্গে সঙ্গে দুই সামরিক শাসক ও তাদের উত্তরসূরি এবং একাত্তরের পরাজিত ও পঁচাত্তরের পর পুনরুত্থিত গোষ্ঠীগুলো উপলব্ধি করেছে তাদের রাজনীতি আবার পরাস্ত হবে যদি শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সফল হন। তাই সংগত কারণেই ওইসব সম্মিলিত পক্ষের টার্গেটে পরিণত হন তিনি। সে কারণেই ১৯ বার তাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়, যার ভয়াবহ একটি উদাহরণ ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। বাংলাদেশে তো আরও নেতানেত্রী আছেন, অনেকেই প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। তাদের হত্যাচেষ্টার কথা তো একবারও শোনা যায় না, কারও গায়ে তো একটা টোকাও এ পর্যন্ত লাগেনি। তাই সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে কীসের জন্য এবং কারা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চায়। ২০০৪ সালে ২১ আগস্টের ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়ে গেছে ওরা কে বা কারা। আদালতে প্রমাণ হয়েছে এর সঙ্গে জড়িত বিএনপি-জামায়াত, ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। পাকিস্তানের জঙ্গি মজিদ ভাট ও আবদুল মালেক ফাঁসির দন্ড মাথায় নিয়ে এখন বাংলাদেশের কারাগারে। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করি। একটু গভীরে প্রবেশ করলে বোঝা যায় ভদ্রবেশী একশ্রেণির সুশীল, যারা নিরপেক্ষ ছদ্মবেশ ধারণ করে চললেও শেখ হাসিনার প্রচন্ড বিরোধী। দেশ গোল্লায় গেলেও তারা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। এদের বৈদেশিক কানেকশন খুবই শক্তিশালী। তবে এরকম একটি সুবিধাবাদী শ্রেণি সব যুগেই বাংলাদেশে ছিল, এখনো আছে এবং আগামীতে থাকবে। তাই এদের সম্পর্কে দেশের মানুষের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এদের চেনার একটা সহজ উপায় আছে। একটি বড় রাজনৈতিক দল জাতির পিতাকে অস্বীকার ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে অমান্য করে রাজনীতি করছে, অথচ এ সম্পর্কে সুশীল নিরপেক্ষদের কোনো বক্তব্য নেই, বরং তাদের এই অধিকার, সেই অধিকার নিয়ে খুবই সোচ্চার। তারা সুশীল ও ভদ্রলোকের ছদ্মবেশে কথার ফুলঝুরিতে দেশপ্রেমিক সাজেন। অথচ ঝড়-তুফান, সাইক্লোন-বন্যার সময় তাদের কখনই অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায় না। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বৈশ্বিক শক্তিগুলোকে খেপিয়ে তোলার জন্য তারা অসত্য তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে সভা-সেমিনার করে থাকেন এবং তার ব্যাপক প্রচার চালান। যে কোনো জাতীয় উদ্যোগ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে হতাশা ছড়ান। যেমনটি দেখা গেছে, পদ্মা সেতু নির্মাণ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময়। জঙ্গি সন্ত্রাস দমনে শেখ হাসিনার সাফল্য এখন বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। অথচ তখন তারা উঠেপড়ে প্রচার চালিয়েছেন, সভা-সেমিনার করেছেন, বিদেশি বিশেষজ্ঞ ডেকে এনে বলিয়েছেন, জঙ্গি দমন বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই বিদেশি শক্তির সাহায্য নেওয়া উচিত। এটা দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কত বড় চক্রান্ত ছিল তা ভাবলে শঙ্কিত হতে হয়। আবার ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা যখন বানের পানির মতো বাংলাদেশে ঢুকতে থাকে, তখন তারা সভা-সেমিনার করে উসকানি দিয়েছে যাতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা সামরিক সংঘর্ষ বেধে যায়। ২০০৯ সালে পিলখানার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেও একই রকম দেখেছি, একটি পক্ষ এমন উসকানি দিয়েছে যাতে দেশব্যাপী বাহিনীগুলোর মধ্যে একটা অনিয়ন্ত্রিত সংঘর্ষ বেধে যায় এবং সাধারণ মানুষের ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। রোহিঙ্গা ও পিলখানা, দুটো ঘটনাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসীম ধৈর্য ও দারুণ দূরদৃষ্টির কারণে বাংলাদেশ দুটি ভয়াবহ রক্তক্ষরণ থেকে বেঁচে যায়।
এত সময় যে বর্ণনা দিলাম সেগুলো বিবেচনায় রেখে বলতে গেলে বলতে হবে- ৪২ বছরে শেখ হাসিনার রাজনীতির ফলে বাংলাদেশের যা অর্জন তা এক কথায় দৃষ্টান্তহীন। প্রথমত, একটা জাতির এগিয়ে যাওয়ার পথে সবচেয়ে বড় সম্পদ তার সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য। পঁচাত্তরের পর এই সম্পদকে পরিপূর্ণভাবে কবর দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এখন সবকিছু আবার রাষ্ট্রের মূল স্রোতে ফিরে এসেছে। তরুণ প্রজন্ম তাতে উজ্জীবিত ও উদ্বুদ্ধ। এ তরুণরাই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও স্বাধীনতাকে রক্ষা করবে। দ্বিতীয়ত, শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ভূমিকাতেই সামরিক শাসনের অবসান ঘটেছে এবং গণতন্ত্র ফিরে এসেছে। তা না হলে পাকিস্তানের মতোই প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে সামরিকতন্ত্রের কবলে পড়ে থাকত বাংলাদেশ।
তৃতীয়ত, যে কোনো গণতান্ত্রিক জনসম্পর্কিত রাজনৈতিক দল একটা রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ও স্বাধীনতার রক্ষাকবচ। পঁচাত্তরে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হওয়া আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করে শক্তিশালী এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। পাঁচবার নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী দলকে ক্ষমতায় এনেছেন। চতুর্থত, জাতির পিতার হত্যাকান্ড ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে একদিকে যেমন রাষ্ট্রকে কলঙ্কমুক্ত করেছেন, তেমনি প্রতিষ্ঠা করেছেন জাতি-রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ করে কেউ রক্ষা পাবে না। সামরিক শাসক কর্তৃক রুদ্ধ হওয়া আইনের শাসনের পথকে খুলে দিয়েছেন। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে নয়, প্রচলিত আদালতে জাতির পিতা হত্যাকান্ডের বিচার করে প্রমাণ দিয়েছেন তিনি প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বাংলাদেশকে বের করতে চান। তারপরও বিএনপি-জামায়াত তাকে হত্যা করার জন্য চরম প্রতিহিংসার পথ বেছে নেয়। পঞ্চমত, যে দেশের প্রধান বিরোধী দলের নেতা বিদেশে রপ্তানিতে জিএসপি সুবিধা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে পত্রিকায় কলাম লিখেন শেখ হাসিনা সেই বাংলাদেশকে দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছেন। ষষ্ঠত, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দুর্দিনের পরীক্ষিত বন্ধু ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে তলানি থেকে আবার একাত্তরের পর্যায়ে উন্নীত করেছেন। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে যুগের পর যুগ জিইয়ে থাকা সমুদ্র সীমানার দ্বন্দ্ব মীমাংসার ফলে প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসম্পদের ওপর বাংলাদেশের একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা এক অসাধারণ জাতীয় অর্জন।
সপ্তম, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বের মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা আজ কোথায় উঠেছে তার কিছু প্রতীকী দৃশ্য গত বছর দিল্লিতে জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের সময় দেখা গেছে এবং বিশ্ব জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনের সময় প্রতি বছর দেখা যায়। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনা যে ভূমিকা রেখেছেন তার সমান্তরাল কিছু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি। সে কারণেই ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীর চক্রান্ত ষড়যন্ত্রসহ সব অপচেষ্টা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উদ্ভাবনী শক্তি ও সৃজনশীলতার কাছে পরাস্ত হয়েছে। ভারত, চীন, রাশিয়া, জাপান, সৌদি আরব, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় আনুষ্ঠানিক অভিনন্দন জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য জরুরি ছিল বলে মন্তব্য করেছেন এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কান্ট্রি ডাইরেক্টর। কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে এমন মন্তব্য আগে কখনো শোনা যায়নি। এত কিছুর পরও বড় দুটি বাধা এখনো বাংলাদেশের সামনে দন্ডায়মান। প্রথমটি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনীতি, যারা জাতির পিতাকে অস্বীকার ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে প্রত্যাখ্যান করে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে দেশব্যাপী ধর্মান্ধতার বিস্তার। তবে এই দুটি অপশক্তি আবার পারস্পরিকভাবে সম্পর্কিত। তাই বাংলাদেশের প্রধান শত্রু মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনীতির অবসান ঘটলে বাংলাদেশের আকাশ থেকে সব কালো মেঘ কেটে যাবে এবং চলমান অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা অনেক সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু কাজটি অবশ্যই কঠিন। অনেক কঠিন কাজ ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুর মেয়ের হাত ধরে হয়ে গেছে। তার অসাধারণ উদ্ভাবনী শক্তি ও সক্ষমতা আছে। তাই মানুষ মনে করে এ কাজটিও পারলে শেখ হাসিনাই পারবেন।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        